হৃদরোগে আক্রান্ত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের অবস্থা ‘সঙ্কটজনক’ বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
তার চিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের কার্ডিওলজির অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান জানিয়েছেন, সেতুমন্ত্রীর তিনটি রক্তনালীতে ব্লক ধরা পড়েছে, যার একটি স্টেন্টিংয়ের মাধ্যমে অপসারণ করা হয়েছে।
উনার অবস্থা ওঠানামার মধ্যে আছে। দোয়া করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। … যেহেতু উনি ভেন্টিলেশনে আছেন, সেহেতু উনি জীবনশঙ্কায় আছেন বলতে পারেন।”
এই অবস্থায় উন্নত চিকিৎসার জন্য ওবায়দুল কাদেরকে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ।
তবে এই শারীরিক অবস্থায় কাদেরকে দেশের বাইরে নেওয়া সম্ভব কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত নন চিকিৎসকরা।
হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে রোববার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে ওবায়দুল কাদেরকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে এনে করোনারি কেয়ার ইউনিটে ভর্তি করা হয়। খবর পেয়ে আওয়ামী লীগ নেতারাও হাসপাতালে ছুটে আসেন।
পরে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের উপাচার্য অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ এক ব্রিফিংয়ে ওবায়দুল কাদেরর সর্বশেষ পরিস্থিতি সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন।
হানিফ বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডাক্তার ও পরিবারের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন, পরিস্থিতি মনিটর করছেন। উনি নির্দেশনা দিয়েছেন যেন হাসপাতালে অহেতুক ভিড় করা না হয়।”
দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভোরে ফজরের নামাজের পর হঠাৎ করেই কাদেরের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকলে তাকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে নিয়ে আসেন তার স্ত্রী ইশরাতুন্নেসা কাদের।
কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান বেলা ১১টার দিকে সাংবাদিকদের বলেন, হাসপাতালে আনার সঙ্গে সঙ্গে ওবায়দুল কাদেরের সিটি স্ক্যান করা হয়। রক্তচাপ কিছুটা স্থিতিশীল হলে করা হয় এনজিওগ্রাম। তাতে কাদেরের তিনটি আর্টারিতে ব্লক ধরা পড়ে। এর মধ্যে একটি অপসারণ করা হয়।
কিন্তু যে কোনো মুহূর্তে পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে জানিয়ে সৈয়দ আলী আহসান সে সময় বলেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য সেতুমন্ত্রীকে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
ঘণ্টাখানেক পর আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, তাদের সাধারণ সম্পাদককে সিঙ্গাপুর জেনারেল হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।
সেই প্রস্তুতির জন্য বাসায় ফিরে যান কাদেরের স্ত্রী ইশরাতুন্নেসা। বেলা সোয়া ২টার দিকে আবারও তিনি হাসপাতালে আসেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সালমান এফ রহমান, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, মির্জা আজম, অসীম কুমার উকিল, এনামুল হক শামীম, বিপ্লব বড়ুয়াসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকেই ততক্ষণে হাসপাতালে এসে ওবায়দুল কাদেরের খোঁজ খবর নিয়ে গেছেন।
এই পরিস্থিতিতে বেলা সোয়া ২টার পর হাসপাতালের নিচে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন ডা. সৈয়দ আলী আহসান।
তিনি বলেন, “তিনটা নালীতে ব্লক ছিল। যেটা ক্রিটিকাল ছিল, এলইডি বলে, এলইডিতে ৯৯ পারসেন্ট, যেটার জন্য উনার এ প্রবলেমটা হয়েছে, আমরা শুধু সেটাকে সারাই করেছি। তবে সেটা পর্যাপ্ত নয়। যেহেতু তিনটা নালী সারানো দরকার। এ মুহূর্তে সেগুলো সারানো যাবে না। সারাতে গেলে আরো বিপদ ঘটবে।”
সেতুমন্ত্রীর অবস্থা এখন কেমন- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে এই চিকিৎসক বলেন, “উনার পরিস্থিতি অনেক উন্নতির দিকে গিয়েছিল। কিন্তু পরে আবার খারাপের দিকে গেছে। এ পর্যায়ে ওঠানামার মধ্যে আছে।… ২৪ থেকে ৭২ ঘণ্টা না গেলে বলা যাবে না যে পরিস্থিতি স্থিতিশীল।”
সৈয়দ আলী আহসান জানান, বাকি যে দুটি রক্তনালীতে ব্লক আছে, তার একটি ৮০ শতাংশ বন্ধ। আগে কোনো এক সময় হার্ট অ্যাটাকে অন্য নালীটি ১০০ শতাংশ বন্ধ হয়ে যায়।
এই অবস্থায় সিঙ্গাপুরে নেওয়া যাবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “পরিস্থিতি এ মুহূর্তে বোঝা যাচ্ছে না।… আমি বলব, এখনই পাঠানো যাবে না।”
৬৭ বছর বয়সী ওবায়দুল কাদের ২০১৬ সালের ২৩ অক্টোবরে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তার আগে ছয় বছর তিনি দলের সভাপতি মণ্ডলীতে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর আড়াই বছর কারাগারে ছিলেন কাদের। সেখান থেকেই তিনি ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। পর পর দুই মেয়াদে তিনি ওই দায়িত্বে ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকোলে কোম্পানীগঞ্জ থানা মুজিব বাহিনীর (বিএলএফ) অধিনায়ক কাদের প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে। মোট চারবার তিনি নোয়াখালী-৫ আসনের ভোটারদের প্রতিনিধি হিসেবে সংসদে এসেছেন।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন পর সরকার গঠন করলে ওবায়দুল কাদেরকে যুব, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন।
পরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরে গেলে ২০০২ সালের সম্মেলনে দলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান ওবায়দুল কাদের।
২০০৭ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ন সরকারের সময়ে জরুরি অবস্থার মধ্যে দেশের বহু রাজনীতিবিদের মত ওবায়দুল কাদেরও গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যান। প্রায় ১৮ মাস কারাগারে কাটানোর পর ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনের দুই মাস আগে তিনি জামিনে মুক্তি পান।
ওই নির্বাচনে জয়ী হয়ে আবার ক্ষমতায় ফেরে আওয়ামী লীগ। প্রথমে তাকে তথ্য মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। সরকারের মেয়াদের মাঝামাঝি সময়ে তাকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী করেন প্রধানমন্ত্রী।
তখন থেকেই ওই মন্ত্রণালয়ের দেখভাল করছেন ওবায়দুল কাদের। বর্তমানে এ মন্ত্রণালয়ের নাম সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়।