বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে পুরনো ঢাকার নির্জন কারাগার থেকে যেকোনো সময় কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে নির্মিত নতুন মহিলা কারাগারে স্থানান্তর করা হতে পারে। ওই কারাগারের নির্মাণকাজ প্রায় শেষপর্যায়ে রয়েছে। কারা অভ্যন্তরে মোট তিনটি ভবনের মধ্যে একতলা বিশিষ্ট (ডিভিশনপ্রাপ্ত) একটি ভবনে তাকে রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে কারাগার সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
কারাগার সূত্রে জানা গেছে, কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের পূর্ব-দক্ষিণ পাশে মহিলা বন্দীদের জন্য কারা কর্তৃপক্ষ আরো একটি কারাগার নির্মাণের কার্যক্রম আগেই শুরু করে। গতকাল পর্যন্ত ওই কারাগারটির ৯০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়। এখন চলছে ভেতরে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির লাইন সংযোগ দেয়ার কাজ। পাশাপাশি মূল ফটকে টাইলস লাগানোর পর ভেঙে যাওয়া অংশের মেরামতসহ অন্যান্য ধোয়া মোছার কাজও চলছে দ্রুত গতিতে। টাইলসসহ অন্যান্য কাজে সমস্যা দেখা দেয়ায় বিষয়টি জানানো হয়েছিল গণপূর্ত অধিদফতরকে। খবর পেয়ে গত সপ্তাহে গণপূর্ত অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল নির্মাণাধীন কারাগারের বর্তমান অবস্থা সরেজমিন দেখতে যান। এ সময় তিনি কারা সংশ্লিষ্টদের কিছু নির্দেশনা দেন।
গতকাল কারা অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা নাম না জানিয়ে এ প্রতিবেদককে বলেন, কেরানীগঞ্জ নতুন যে কারাগারটি নির্মিত হচ্ছে সেখানে শুধু মহিলা বন্দীদের রাখা হবে। ইতোমধ্যে কারা অভ্যন্তরে তিনটি ভবন তৈরি করা হয়েছে। দুটি চার তলা ভবন আর একটি একতলা ভবন। একতলা ভবনটি কারাগারের প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকে পশ্চিম ও দক্ষিণ পাশে (ডিভিশনপ্রাপ্ত) তৈরি করা হয়েছে। এই ভবনেই (ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দী) সম্ভবত খালেদা জিয়াকে রাখা হতে পারে। অন্য সেলগুলোতে মহিলা বন্দীদের রাখার পরিকল্পনা রয়েছে।
এক প্রশ্নের উত্তরে ওই কর্মকর্তা বলেন, এখনো কারাগারের ১০ ভাগ কাজ বাকি রয়েছে। ভেতরে একটি বড় মাঠও আছে। পশ্চিম কোণায় রয়েছে একটি ভিআইপি সে ও খাদ্যভাণ্ডার আছে। অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কারাগারের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হলেই এটি আগে উদ্বোধন করা হবে। এরপরই বন্দীদের রাখার প্রক্রিয়া শুরু হবে। খালেদা জিয়াকে এই কারাগারে স্থানান্তর করা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেকোনো সময় তাকে আনা হতে পারে। এমনটি আমরাও শুনছি। তবে তারিখটা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
গতকাল শনিবার রাতে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম মোস্তফা কামাল পাশার সাথে এ প্রসঙ্গে জানতে যোগাযোগ করা হলে তিনি টেলিফোন ধরেননি। পরে ঢাকা বিভাগের ডিআইজি প্রিজন্স টিপু সুলতানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারও বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
কারাগার সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পুরনো ঢাকার নির্জন কারাগারে সাজাপ্রাপ্ত বন্দী বেগম খালেদা জিয়ার দৈনন্দিন খাবার দেয়ার আগে ডাক্তাররা সেটি পরীক্ষা করে তারপরই দিচ্ছেন। এ ছাড়া, নিয়মিত কারা ডাক্তাররা তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছেন। কারাগারে যাওয়ার পর থেকেই তার সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন একজন মহিলা ডেপুটি জেলারের নেতৃত্বে ১০জন মহিলা কারারক্ষী। তারা পালা করে ডিউটি করছেন। যদিও বেগম খালেদা জিয়ার সাথে আদালতের নির্দেশনা নিয়ে তারই গৃহপরিচাকা ফাতেমা বেগম রয়েছেন। কারাগারে বাইরে প্রতিদিন পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা ডিউটি করছেন। আর খালেদা জিয়ার প্রতিদিনের পুরো কার্যক্রম সরাসরি তত্ত্ববধান করা হচ্ছে কারা অধিদফতর থেকে।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ এর বিচারক ড. মো: আখতারুজ্জামান জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় বেগম খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছর কারাদণ্ড দেন। এরপর ওইদিন বিশেষ নিরাপত্তায় তাকে পুরনো ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
প্রথম রাতে তাকে কারা ফটকের পাশের সিনিয়র জেল সুপারের কক্ষে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। পরদিন তাকে পরিত্যক্ত কারাগারের ডে কেয়ার সেন্টারের দ্বিতীয় তলায় নেয়া হয়। বর্তমানে তিনি সেখানেই রয়েছেন। ২০০ বছরের পুরনো এই জরাজীর্ণ কারাগারের একমাত্র বন্দী তিনিই।
ইতোমধ্যে তার মুক্তির দাবিতে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করে আসছে বিএনপিসহ বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো। এসব কর্মসূচির মধ্যে বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন, অবস্থান ও অনশন কর্মসূচি, গণস্বাক্ষর, স্মারকলিপি প্রদান, কালো পতাকা প্রদর্শন, লিফলেট বিতরণ, জনসভা, আলোচনা সভা এবং প্রতিবাদ মিছিলের কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি। এরমধ্যে কালো পতাকা প্রদর্শন কর্মসূচি পুলিশ বাধা দিয়ে পণ্ডু করে দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এক বছরের অধিক সময় ধরে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী রয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদ জিয়া। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী এই কারাগারের একমাত্র বন্দী। গত ২০ ফেব্রুয়ারি ওই কারাগারের পাশে চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের নারী সেলে খালেদা জিয়াকে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আসার পরে কারা কর্তৃপক্ষ স্থানান্তরের বিষয়টি অনেকটা চূড়ান্ত করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সরকারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত হওয়ার পর কারা কর্তৃপক্ষ কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি সেল ও কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগার পরিদর্শন করেন। এরপরই কারা কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে বিষয়টি খালেদা জিয়াকে জানানো হয়। এতে খালেদা জিয়া বিরক্ত হন। কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যেতে চান না সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারের নির্ধারিত ভিআইপি সেলেও যেতে চান না তিনি। কারা কর্তৃপক্ষকে নিজের এমন মনোভাবের কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
কারা কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। তার পা ফুলে গেছে। এখন হাঁটাচলা করতেও তার কষ্ট হচ্ছে। বর্তমানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া রাজধানীর নাজিম উদ্দিন রোডে পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে ডে-কেয়ার সেন্টারে রয়েছেন।
৭৩ বছর বয়সী সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর হৃদযন্ত্র, চোখ ও হাঁটুসহ নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন। মাঝখানে অসুস্থতার কারণে বেশ কয়েক দিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন। বিএনপির অভিযোগÑ খালেদা জিয়া সুস্থ্য না হলেও কারাগারে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে।
যে মামলায় খালেদা জিয়া এক বছর আগে কারাগারে গেছেন, সেই মামলায় গ্রেফতারের দেড় মাসের মাথায় জামিন পেলেও তার মুক্তি মেলেনি। এই মুক্তির পথে বাদ সেধেছে আরো ৩৬ মামলা। একটি মামলায় জামিন হলে, সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে অন্য মামলা। আর এভাবেই কেটে গেছে পুরান ঢাকার পরিত্যক্ত কারাগারে একমাত্র বন্দী হিসেবে বেগম জিয়ার একটি বছর।