মধ্য এশিয়ায় (কাজাখস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, আজারবাইজান, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান) বসবাসরত তুর্কি বংশোদ্ভূত একটি জাতিগোষ্ঠীর নাম উইঘুর। যারা ইসলামের সুন্নি আকিদার অনুসারী। উইঘুরদের বৃহৎ অংশটি যে উপত্যকায় বাস করে তা গণচীনের দখলে চলে যায়। এতে করে, বর্তমানে চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াং অঞ্চলেই এই মুসলিম জনগোষ্ঠীর মূল অংশের বসবাস। এলাকাটি বিপুল তেল ও খনিজসম্পদে পূর্ণ।
সমগ্র চীনজুড়ে অসংখ্য নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী রয়েছে। জিনজিয়াং প্রদেশে সরকারিভাবে স্বীকৃত ৫৬টি নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর একটি উইঘুর। আবার উইঘুররা চীনের সর্ববৃহৎ নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীও। ১৬ লাখ ৪৬ হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের জিনজিয়াং প্রদেশে ২.২ কোটি মানুষের ১.২ কোটিই মুসলমান। চীনে বসবাসরত উইঘুরদের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াং প্রদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে তারিম বেসিনে বাস করে। বাকিরা দক্ষিণ-মধ্য হুনান প্রদেশসহ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, চীনজুড়েই।
জিনজিয়াং হলো তিব্বতের মতো চীনের বিশেষ স্বায়ত্তশাসিত একটি অঞ্চল। বাহ্যিকভাবে এ অঞ্চলের আদিবাসী উইঘুররা স্বাধীন হলেও সত্যিকার অর্থে তারা পরাধীন। অর্ধশত বছরের বেশি সময় ধরে তারা চীনা সরকরর নির্যাতনের জাঁতাকলে পিষ্ট। সেখানকার মুসলমানরা নিজ দেশে, বাপ-দাদার ভিটায় পরদেশীতে পরিণত হয়েছে। তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যগুলো ধ্বংস করার জন্য চীনা সরকার পদক্ষেপ চালিয়ে যাচ্ছে। এই জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন নিত্যদিনের চলমান শাস্তিতে পরিণত হয়েছে।
১৬৪৪ সালে প্রতিষ্ঠিত কিং সাম্রাজ্য ১৯১২ সালে রিপাবলিক অব চায়না, অতঃপর ১৯৪৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর মাও সে তুংয়ের হাতে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়। ২০১০ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির গোপন এক নথি থেকে জানা যায়, এই শাসনামলে দেশটিতে অন্তত চার কোটি মানুষ ক্ষুধা ও নির্যাতনজনিত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়।
প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেলে পূর্ণ জিনজিয়াং প্রদেশের উইঘুর আদিবাসীদের চীনা সরকার ‘স্বাধীনচেতা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তাদের ধারণা এদের নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে একদিন এই খনিজ সম্পদে ভরপুর প্রদেশ হাতছাড়া হয়ে যাবে। তাই তারা উইঘুরদের নানা কৌশলে বিতাড়িত করে চীনা হানদের সেখানে প্রতিষ্ঠিত করছে। ১৯৪৯ সালে জিনজিয়াংয়ের ৯৫ শতাংশই ছিল উইঘুর মুসলিম, সেখানে আজ অর্ধেক দখল করে নিয়েছে হানরা।
গত কয়েক দশক উইঘুরদের ওপর চরম নিপীড়ন-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে কমিউনিস্ট সরকার। কেড়ে নিয়েছে তাদের মৌলিক নাগরিক অধিকার। আর্থ-সামাজিক ও ধর্মীয় দিক থেকে তারা চরম বৈষম্যের শিকার। সরকারি চাকরিতে তাদের নিয়োগ বলতে গেলে নেই। যারা চাকরি পাচ্ছে, তারা বেতনবৈষম্যের শিকার।
উইঘুরদের বেঁচে থাকার একমাত্র হাতিয়ার ধর্মকে আঁকড়িয়ে থাকা। এবার চীনের কমিউনিজমকেন্দ্রিক সরকার তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতায় নগ্ন হস্তক্ষেপের পদক্ষেপ নিল। সেখানে ১৮ বছরের কম বয়সী পুরুষদের মসজিদে যাওয়া নিষিদ্ধ। ৫০ বছরের কম বয়সী কেউ প্রকাশ্যে নামাজ আদায় করতে পারে না। রোজা রাখা নিষিদ্ধ, কেউ রোজা রাখলে রোজা ভাঙতে বাধ্য করা হয়। রোজার সময় দিনের বেলায় উইঘুরদের দেখলেই কিছু খেতে বাধ্য করে। সীমিত কিছু ক্ষেত্র ছাড়া সব ক্ষেত্রেই কুরআন শরিফ তিলাওয়াত নিষিদ্ধ এবং তা শেখানোর সুযোগ একেবারেই সঙ্কুচিত। নারীদের হিজাব পরা নিষিদ্ধ এবং হিজাব পরা কোনো নারীকে গাড়িতে তুললে চালককে মোটা অঙ্কের জরিমানা করা হয়। এ ধরনের নারীদের চিকিৎসাসেবা দেয়া নিষিদ্ধ। টুপি ও দাড়ি রাখা নিষিদ্ধ, এমনকি ইসলামী কোনো ঐতিহ্যের পোশাক পরিধানকারীর জন্য সরকারি চাকরি নিষিদ্ধ।
উইঘুর মুসলমানরা টুপি পরলে কিংবা দাড়ি রাখলে তাদের ‘ধর্মীয় উগ্রপন্থী’ হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু কেউ ফ্যাশন করে দাড়ি রাখলে তার চলাচলে কিংবা বাকস্বাধীনতায় কোনো সমস্যা হয় না।
জিনজিয়াং প্রদেশকে দুই হাজারের অধিক মসজিদ করেছে সমৃদ্ধ। কিন্তু সরকার এসব মসজিদ ভেঙে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তুলছে। প্রদেশের কেন্দ্রীয় মসজিদের ওপর বসিয়েছে কড়া নজরদারি। এতে করে অনেকেই মসজিদে যেতে ভয় পাচ্ছে।
২০১৮ সালের আগস্টে জেনেভায় চীনের ওপর মানবাধিকারবিষয়ক দু’দিনের এক বিশেষ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। সেখান থেকে বিশ্ব জানতে পারে, চীনা সরকার ১০ লাখের অধিক উইঘুর মুসলিমকে বন্দী করে রেখেছে। আন্তর্জাতিক মহল বলছে, তারা পুরো জিনজিয়াং অঞ্চলকে উইঘুর মুসলিমদের জন্য এক বৃহৎ কারাগার বানিয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, ইন্দোনেশিয়া, কাজাখস্তান এবং তুরস্কসহ ২৬টি দেশে আত্মীয়স্বজন আছে যাদের, তাদের বেশি নজরদারিতে রাখছে।
২০১৮ সালের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত চীন এসব ভয়াবহ কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের কথা অস্বীকার করে আসছিল। পরিশেষে আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোর নানা তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপনের পর অক্টোবরের শেষ দিকে এসবের কথা তারা স্বীকার করে। তবে তারা বলে, ‘ছোটখাটো’ অপরাধের জন্য উইঘুরদের আটক করে বৃত্তিমূলক শিক্ষা দেয়া হচ্ছে এবং শিবিরগুলো হচ্ছে ‘ভোকেশনাল এডুকেশন সেন্টার’।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ জাতিসঙ্ঘ অবগত হয়েছে, চীনের এসব কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে ১০ লাখেরও বেশি উইঘুর মুসলমানকে নিপীড়ন-নির্যাতনের মাধ্যমে চীনা ম্যান্ডারিন ভাষা শিখিয়ে মগজধোলাই এবং জোর করে প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের প্রতি আনুগত্য প্রকাশে বাধ্য করা হচ্ছে। আরো বলা হচ্ছে, তাদের নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাসের সমালোচনা কিংবা সেই ধর্ম পরিত্যাগ করতে।