নওগাঁ জেলার পোরশা থেকে আব্দুল হালিম জানান, তিনি মোট ৭১টি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার জন্য আবেদন করেছিলেন। এর মধ্যে ২৫টি কলেজ ও ৪৬টি স্কুল রয়েছে। প্রতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবেদনের জন্য বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষকে (এনটিআরসিএ) পাঠাতে হয়েছে ১৮০ টাকা করে। প্রতি আবেদন পাঠাতে দুইবার মেসেজ করতে খরচ হয়েছে ৫ টাকা করে। এ ছাড়া দোকান থেকে প্রতি আবেদনের পেছনে খরচ হয়েছে ৩০ থেকে ৫০ টাকা করে। এভাবে ৭১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবেদনের পেছনে তার মোট খরচ হয়েছে ১৭ হাজার ৫০০ টাকা।
আব্দুল হালিম বলেন, তিনি যে ৭১টি প্রতিষ্ঠানে আবেদন করেছেন তার মধ্যে ২৫টির অধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেগুলোতে মহিলা শিক্ষক চাওয়া হয়েছিল। পুরুষদের আবেদন করার যোগ্যতা ছিল না। ফলে আমাদের ওই আবেদনগুলো বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু আবেদন করার সময় ওই প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে মহিলা কোটায় শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হবে তা উল্লেখ করা হয়নি। যদি উল্লেখ করা থাকত তাহলে আমরা সেখানে আবেদন করতাম না এবং অনর্থক অর্থ খরচও হতো না।
আব্দুল হালিম জানান, এনটিআরসিএ যদি একটি আবেদনের মাধ্যমে একাধিক প্রতিষ্ঠান পছন্দ করার সুযোগ দিত তাহলেও তাদের এভাবে শত শত প্রতিষ্ঠানে আবেদন করতে হতো না। এতে তারা হয়রানি এবং অর্থ খরচ দুটো থেকেই বেঁচে যেতেন।
মহিলা শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হবে এ তথ্য উল্লেখ না থাকায় আব্দুল হালিম যেসব প্রতিষ্ঠানে আবেদন করেছিলেন তার মধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠানের নাম তিনি উল্লেখ করেন। এগুলো হলো, নওগার বিষ্ণপুর দাখিল মাদরাসা, কলাইবাড়ি দুয়ারপালা দাখিল মাদরাসা, শরিআলা দাখিল মাদরাসা।
আব্দুল হালিমের অভিযোগ, যেসব প্রতিষ্ঠানে মহিলা শিক্ষক চাওয়া হয়েছে সেখানে মহিলা প্রার্থী পাওয়া না গেলে শূন্য রাখা হয়েছে। তার মানে ওই সব প্রতিষ্ঠানে আমাদের আবেদনের কোনো সুযোগই ছিল না। কিন্তু এ বিষয়টি আমাদের জানানো হয়নি।
কুড়িগ্রাম জেলার ভুরুঙ্গামারী উপজেলা থেকে সাইফুর রহমান জানান, তিনি মোট ৫০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবেদন করেছিলেন। এ জন্য তার ১০ হাজার টাকার ওপরে খরচ হয়েছে। আব্দুল হালিমের মতো তারও ১০টি আবেদন বাতিল হয়েছে মহিলা কোটায় শিক্ষক চাওয়া হয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানে আবেদন করার জন্য। সাইফুর রহমানও অভিযোগ করে বলেন, আবেদন করার সময় ওই সব প্রতিষ্ঠানে মহিলা কোটার বিষয় উল্লেখ ছিল না।
সাইফুর রহমান অভিযোগ করেন, আবার অনেক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হলেও দেখা গেছে সেখানে শূন্য পদ নেই। প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ভুল তথ্য দেয়া হয়েছে। এসব কারণেও অনেকে এনটিআরসিএ সুপারিশকৃত হয়েও নিয়োগ পাচ্ছেন না।
বরিশাল থেকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক প্রার্থী জানান তিনি মোট ৩৫টি আবেদন করেছেন এবং এ জন্য তার ৮ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।।
ওপরে যে দু’জন শিক্ষক প্রার্থীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে তারা এনটিআরসিএ নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ অর্থাৎ নিবন্ধন সনদধারী।
এনটিআরসিএ কর্তৃক প্রথম থেকে ১৪তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সব নিবন্ধনধারীদের মধ্য থেকে গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় মেধা তালিকা প্রকাশ করে এনটিআরসিএ। তার আগে ১৮ ডিসেম্বর এনটিআরসিএ সারা দেশের সব বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা থেকে ৩৯ হাজার ৫৩৫টি শূন্য পদে শিক্ষক নিয়োগের জন্য আবেদন আহ্বান করে নিবন্ধনধারীদের মধ্য থেকে। এরপর আবেদনকারীদের মধ্য থেকে এনটিআরসিএ ৩৯ হাজারের অধিক পদে প্রার্থী বাছাই করে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। আব্দুল হালিম ও সাইফুর রহমানের মতো আরো অনেক আবেদন প্রার্থী এনটিআরসিএ কর্তৃক নিয়োগের জন্য সুপারিশকৃত হন জাতীয় মেধাতালিকা থেকে। কিন্তু ২০১৮ সালের জনবলকাঠামো নীতিমালার জটিলতার কারণে তারা নিয়োগ পাচ্ছেন না।
আব্দুল হালিম ও সাইফুর রহমানের মতো সারা দেশ থেকে লাখ লাখ প্রার্থী রয়েছেন যাদের অনেকে এভাবে ৫০ থেকে ৭০টি পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানে আবেদন করেছেন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের জন্য। অনেকে এমনকি শতাধিক প্রতিষ্ঠানেও আবেদন করেছেন। এ জন্য অনেকের ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রার্থী জানান, তিনি মোট ৯১টি প্রতিষ্ঠানে আবেদন করেছেন।
আবেদনকারীরা অভিযোগ করেন এনটিআরসিএর ভুল নীতির কারণে এভাবে প্রার্থীদের অনেক প্রতিষ্ঠানে আবেদন করতে হয়েছে। একটি আবেদনের মাধ্যমে একাধিক প্রতিষ্ঠানের নাম ক্রমান্বয়ে বাছাই বা পছন্দের সুযোগ ছিল না। একটি আবেদনের মাধ্যমে শুধু একটি প্রতিষ্ঠান বাছাইয়ের সুযোগ রাখা হয়। আর এভাবে একজন প্রার্থীকে যত খুশি প্রতিষ্ঠানের শূন্য পদে আবেদনের সুযোগ রাখা হয়। প্রতি আবেদনের জন্য এনটিআরসিএতে ১৮০ টাকা করে দিতে হয়েছে।
ভুক্তভোগীরা জানান, নিয়ম করার দরকার ছিল শিক্ষকরা শুধু শিক্ষকতার বিষয় উল্লেখ করে আবেদন করবে। সেই পদে তার নিকটস্থ প্রতিষ্ঠানের শূন্য পদে তাকে নিয়োগ দেয়া হবে। কিন্তু তা না করে এনটিআরসিএ যে নিয়ম করেছে তা বেকারদের পকেট কাটার শামিল ছাড়া আর কিছু নয়। আগে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য প্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদে ঘুষ দিতে হতো এখন আবেদনের মাধ্যমে সে টাকা দিতে হচ্ছে সরকারি প্রতিষ্ঠান এনটিআরসিএকে। আমাদের লাভ কিছুই হয়নি। শুধু মাঝখানে হয়রানি বেড়েছে। তা ছাড়া নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৩৫ বছর বয়স নির্ধারণ করে দেয়ায় এখন অনেকে নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও আর নিয়োগের জন্য আবেদনই করতে পারছে না।
এনটিআরসিএ কর্তৃক শিক্ষক নিয়োগের জন্য গত ১৮ ডিসেম্বর ৩৯ হাজার ৫৩৫টি শূন্য পদে দরখাস্ত আহ্বান করে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ফলে সারা দেশ থেকে ৩৯ হাজার ৫৩৫টি পদের বিপরীতে প্রায় ৩১ লাখ আবেদন জমা পড়ে। তবে সব আবেদনের বিপরীতে অর্থ জমা হয়নি। মোট ২৫ লাখ ৭৯ হাজার ১৯৬টি আবেদন বাবদ অর্থ জমা পড়ে। প্রতি আবেদন থেকে ১৮০ টাকা করে নিয়ে এনটিআরসিএ আয় হয় ৪৬ কোটি টাকার ওপরে।
এ ছাড়া এনটিআরসিএ নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য ফি বাবদ একজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে আদায় করেছে ৩৫০ টাকা। ১৩তম নিবন্ধন পরীক্ষায় মোট আবেদনকারী ছিলেন ছয় লাখ দুই হাজার ৩৩ জন। এনটিআরসিএ ২০১৭ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে ২০১৬-১৭ সালের আয়-ব্যয়ের হিসাবে বলা হয়েছে পরীক্ষার ফিস বাবদ আয় হয়েছে ১৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
২০১৪ সালের নিবন্ধন পরীক্ষায় আবেদনকারী ছিল ৯ লাখ ২৩ হাজার ৫৫৪ জন। ৩৫০ টাকা পরীক্ষার ফি হিসেবে এ খাতে বেকারদের কাছ থেকে এনটিআরসিএ আয় হওয়ার কথা ৩২ কোটি টাকার ওপরে। আর ৩৯ হাজার শূন্য পদে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের জন্য বেকারদের কাছ থেকে এনটিআরসিএ আবেদন ফি বাবদ আয় করেছে ৪৬ কোটি টাকা।
এভাবে প্রতিটি পরীক্ষায় কয়েক লাখ করে প্রার্থী আবেদন করেছে এবং প্রতিবার শুধু পরীক্ষার ফি বাবদই এনটিআরসিএ চাকরিপ্রার্থী বেকার যুবকদের কাছ থেকে আয় করেছে বিপুল পরিমাণ অর্থ।
সর্বশেষ ১৪তম নিবন্ধন পরীক্ষার ফি এবং ৩৯ হাজার পদে আবেদন ফি মিলিয়ে এনটিআরসিএর আয় হিসাব করে অনেকের মাথা ঘুরে যাচ্ছে। এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করছেন নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশ্রগ্রহণকারী থেকে শুরু করে অনেক সাধারণ মানুষও।
এনটিআরসিএর ২০১৭ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে ২০১৬-১৭ সালের আয়-ব্যয়ের হিসাব তুলে ধরা হয়ছে। তাতে বলা হয়েছে ওই অর্থবছরে তাদের মোট আয় হয়েছে ৪৬ কোটি ২৯ লাখ টাকা। এতে পরীক্ষার ফিস বাবদ ১৮ কোটি টাকা আয়ের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। আরেকটি খাতের নাম উল্লেখ না করে ১৯ কোটি টাকা আয় দেখানো হয়েছে। মোট ৪৬ কোটি টাকা আয়ের বিপরীতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, ভাতা, সেবা ও সরবরাহ বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে ৯ কোটি টাকা। আর ৩০ কোটি টাকা ব্যাংকে জমা রাখা হয়েছে।
২০১৬-১৭ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এনটিআরসিএর আয় আরো অনেক বেশি হওয়ার কথা রয়েছে।