আরাকান আর্মি-তাতমাদাও সঙ্ঘাতের তাৎপর্য

মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে সেনাবাহিনীর (তাতমাদাও) সাথে আরাকান আর্মির (এএ) সঙ্ঘাত ক্রমেই বাড়ছে। এই সঙ্ঘাতে আরাকানরা রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা ইস্যুসহ সার্বিক সঙ্কট সমাধানে সৃষ্ট জটিলতায় নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে মনে হচ্ছে যে, এই সঙ্কটের সাথে শুধু মিয়ানমারের অভ্যন্তরের রাজনৈতিক বা বিচ্ছিন্নতাকামীদের সাথে সমঝোতার বিষয়টিই যুক্ত নয়, সেই সাথে আঞ্চলিক কৌশলগত প্রাধান্য বিস্তারের বিষয়ও যুক্ত রয়েছে। এর সাথে চীন, ভারত, বাংলাদেশ- এমনকি পশ্চিমা দেশগুলোর স্বার্থের সম্পৃক্ততাও রয়েছে। আরাকান আর্মির সাথে সে দেশের সেনাবাহিনীর সঙ্ঘাত পুরো অঞ্চলের পরিস্থিতিকে ভিন্ন দিকেও প্রবাহিত করতে পারে।

পাঁচটি শহর দখলের পরিকল্পনা! 
২০২০ সাল নাগাদ উত্তরাঞ্চলের পাঁচটি শহর দখলের পরিকল্পনা করার জন্য আরাকান আর্মিকে অভিযুক্ত করেছেন রাখাইন রাজ্য পার্লামেন্টে সামরিক প্রতিনিধি মেজর থেত ও মং। সম্প্রতি ওই রাজ্যে এএ’র সামরিক অভিযান পর্যালোচনা করে তিনি ওই সিদ্ধান্তে পৌঁছেন বলে জানান আঞ্চলিক সংসদকে। মেজর মং রাখাইন পার্লামেন্টে পেশ করা এক প্রস্তাবে আরাকানবাসীর প্রতি সামরিক অভিযানে সমর্থন দেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘সেনাবাহিনী সব সময় আরাকান রাজ্যের জাতি ও ধর্মকে সুরক্ষিত রেখেছে। মুসলিম হামলা থেকে আরাকানবাসীকে সুরক্ষা দিচ্ছে।’

মেজর মং রাখাইন পার্লামেন্টে বলেন, ২০২০ সালের মধ্যে পালেতওয়া, কিয়াকতাউ ও মারাক-উতে অভ্যুত্থান ঘটানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। একে বলা হচ্ছে ‘আরাকান ড্রিম ২০২০’। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, এই সামরিক প্রতিনিধি বুথিডং ও মংডু টাউনশিপের প্রসঙ্গ টেনে এএ এবং আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিকে (আরসা) সমন্বিতভাবে মাইয়ু অঞ্চলে অভিযান পরিচালনার জন্য অভিযুক্ত করেছেন। সেনাবাহিনীর এ ধরনের অভিযোগ এর আগে বারবার প্রত্যাখ্যান করে এসেছেন আরাকান আর্মির নেতারা।

আরাকান আর্মির মুখপাত্র উ খিন থুখা সেনা এমপির প্রস্তাবকে ‘হাস্যকর’ হিসেবে অভিহিত করে বলেন, “আরাকানবাসী সেনাবাহিনীর পাশে, নাকি এএ’র পাশে থাকবে তা যাচাইয়ের জন্য গণভোটের আয়োজন করা হোক। তা না করে, পার্লামেন্টে বসে আরাকানের জনগণের মন ভেজানোর চেষ্টা করে কোনো লাভ হবে না।”

কয়েক দিন আগে তিনটি জায়গায় এএ’র হাতে সেনা সদস্য নিহত হওয়ার পর মেজর মংয়ের ওই বিবৃতি প্রকাশ পেল। জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র মারাউক-উ’র কাছে ওইসব সংঘর্ষ ঘটে। সেনা নিযুক্ত এমপির প্রস্তাবটি আরাকান ন্যাশনাল পার্টি (এএনপি) প্রভাবিত পার্লামেন্টে নাকচ হয়ে যায়। পার্লামেন্টে এএনপির এমপি উ পোয়ে সান বলেন, শান্তিসংশ্লিষ্ট প্রস্তাবগুলো আঞ্চলিক পর্যায়ে টেনে আনা উচিত নয়। এটা কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে সামাল দেয়া হচ্ছে। তাই প্রস্তাবটি বাতিল করতে হবে।

বাংলাদেশের জন্য নতুন উদ্বেগ
প্রতিবেশী দেশের আরাকান বা রাখাইন প্রদেশের পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য নতুন করে উদ্বিগ্ন হওয়ার দিকে মোড় নিচ্ছে বলেই খবর মিলছে। এ পর্যন্ত আরাকান আর্মির সাথে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সংঘর্ষে অন্তত ৩০ জন সেনা নিহত হয়েছে। এএ’র ভিডিওতে সিত্তুই-ইয়াঙ্গুন সড়কে রক্তের দাগ এবং কয়েকজন সেনার লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। আরাকানের প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এবার বৌদ্ধ রাখাইনদেরও সেখানে ব্যাপক হারে উদ্বাস্তু হতে দেখা যাচ্ছে। যুদ্ধাবস্থার কারণে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইন উপজাতির বহু লোক বসতবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী স্থানীয় বেসামরিক নাগরিকদের এএ’র বিরুদ্ধে যুদ্ধে ‘মানবঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করছে। এ কারণে আহত-নিহত হওয়ার ভয় ছাড়াও অনেকেই পালাচ্ছে ‘মানবঢাল’ হওয়া এড়াতে।

আরাকান আর্মিকে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ সহায়তা করে, এমন ইঙ্গিত মিয়ানমার সেনা কর্তৃপক্ষ দিতে চায়। বাস্তবে এমন কোনো বিশ্বাসযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না। কেউ কেউ বলতে চান যে, সীমান্তে এ রকম একটা গোষ্ঠীর তৎপরতা বাংলাদেশের স্বার্থের পক্ষে যাচ্ছে। কারণ, তারা বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের মাঝখানে একটা বাফার, অর্থাৎ একটা ‘ঢাল’ হিসেবে কাজ করে। আর বাংলাদেশ মিয়ানমারের সাথে যুদ্ধে জড়াতে চায় না।

সর্বশেষ সঙ্ঘাতের কারণে রাখাইন থেকে যেসব বৌদ্ধ বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে, তাদের সাথে নৃতাত্ত্বিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মিল রয়েছে। ফলে সেখানকার অধিবাসীদের সহানুভূতি পায় আরাকানের বৌদ্ধ উদ্বাস্তুরা। তবে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাস্তুচ্যুত করার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে যেভাবে অভিযান চালায়, সেভাবে চালায় না উপজাতীয় বৌদ্ধদের ক্ষেত্রে। বরং তাতমাদাও বা সেনাবাহিনী চায় যে, রোহিঙ্গাদের শূন্য এলাকায় বৌদ্ধ উপজাতিরা বসতি নির্মাণ করুক। এ কারণে, জীবন বাঁচাতে রাখাইনের বৌদ্ধ উপজাতিরা বাংলাদেশে প্রবেশ করলেও তারা এখানে থেকে যাওয়ার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখায় না। রাখাইনে তাদের নাগরিকত্ব নিয়েও কোনো বিতর্ক নেই, যেটি রোহিঙ্গাদের নিয়ে রয়েছে।

বিভিন্ন সূত্র উল্লেখ করে, মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের দুর্গম এলাকায় দু’টি সশস্ত্র গোষ্ঠী কাজ করছে। এর একটি হচ্ছে এ আরাকান আর্মি, অপরটি রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন বা আরএসও। দু’টিই ক্ষুদ্র গোষ্ঠী। এ দু’টি গোষ্ঠীর একটি কাজ করে রোহিঙ্গাদের জন্য। আরেকটির লক্ষ্য ‘আরাকানিদের অধিকার রক্ষা’। আরাকান আর্মি আরসাকে সমর্থন করে না। এমনকি রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার দানের বিষয়কে তারা সমর্থন করেছে, এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।

‘আরাকান আর্মি’ কারা?
মিয়ানমারের রাখাইন বিদ্রোহী গ্রুপ ‘আরাকান আর্মি’ বা এএ ২০০৯ সালের ১০ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি আরাকানের ইউনাইটেড লিগ অব আরাকানের (ইউএলএ) সশস্ত্র শাখা। বর্তমানে মেজর জেনারেল টুইন মৃৎ নাইং-এর নেতৃত্বে চলছে এটি। এএ দ্বিতীয় কমান্ডার নোয়া টোয়ান অং গি-এর বক্তব্য অনুসারে এর লক্ষ্য হলো, ‘আরাকানের জনগণকে রক্ষা এবং শান্তি, ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করা।’

আরাকান আর্মি মনে করে, আরাকানিরা বঞ্চনার শিকার এবং মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকার আরাকানের উন্নয়নে কিছুই করেনি। বেশির ভাগ আরাকানিও এটাই মনে করে। আরাকানের তরুণদের প্রায় নব্বই শতাংশই এদের সমর্থন করে বলে এএ দাবি করছে। এদের তৎপরতা মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের খুব দুর্গম কিছু এলাকায়। ফলে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে সে রকম কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে না।

বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সাথে মিয়ানমার সরকারের যে যুদ্ধবিরতি চলছে, দেশটির প্রেসিডেন্ট চাইছেন নভেম্বরের নির্বাচনের আগে সে যুদ্ধবিরতি চুক্তি চূড়ান্ত করতে। তবে আরাকান আর্মিসহ মোট তিনটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে নেই। ২০১৮ সালের ২১ ডিসেম্বর, মিয়ানমার সেনাবাহিনী চার মাসের জন্য পাঁচটি সঙ্ঘাতপূর্ণ এলাকায় জাতীয় যুদ্ধবিরতি চুক্তির (এনসিএ) বাইরের গোষ্ঠীগুলোর সাথে আলোচনা করবে বলে একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। তবে ওয়েস্টার্ন কমান্ডকে (শিন রাজ্য ও রাখাইন রাজ্যে অবস্থিত) একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা থেকে বাদ দেয়া হয়। এতে সেনাবাহিনী বা তাতমাদাও এবং আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘর্ষ বৃদ্ধি পেয়েছে।

আরাকান আর্মি কাচিন সঙ্ঘাতে তাতমাদাওয়ের বিরুদ্ধে কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্ট আর্মির (কেআইএ) লড়াইয়েরও অংশীদার। বেশির ভাগ এএ সেনা মূলত কেআইএ মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষিত। মিয়ানমার পিস মনিটরের মতে, ২০১৪ সালে আরাকান আর্মির ১৫০০-এর মতো সৈন্য ছিল। দ্য ইরাবতি ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে আরাকান আর্মির ২৫০০ সেনা এবং ১০ হাজার সমর্থক ছিল বলে উল্লেখ করেছে। ২০১৯ সালে সেনা সংখ্যা আনুমানিক সাত হাজারে বৃদ্ধি পায় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

দ্য ইরাবতির সাথে এক সাক্ষাৎকারে, আরাকান আর্মি কমান্ডার টুইন মৃৎ নাইং বলেন, ‘একটি গণতান্ত্রিক ফেডারেল ইউনিয়ন বা ওয়া স্টেটের মতো আরো স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য ব্যবস্থা অর্জনের জন্য গ্রুপটি চেষ্টা করছে।

আরাকান ও এর বাস্তবতা
আরাকান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উপকূলীয় একটি ঐতিহাসিক অঞ্চল। এর পশ্চিম সীমানায় রয়েছে বঙ্গোপসাগর, উত্তরে রয়েছে বাংলাদেশ-ভারত এবং পূর্ব দিকে মিয়ানমার, অর্থাৎ বার্মার মূল ভূখণ্ড। পর্বতমালা এই অঞ্চলটিকে মিয়ানমার থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে এবং এর সাথে শুধু সামুদ্রিক পথে সহজ যোগাযোগ রয়েছে।

উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুসারে, আরাকানের প্রথম অধিবাসী মনে করা হয় টিবেটো-বার্মান বা তিব্বতি-বর্মি জনগণকে, এখন এই অঞ্চলে তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। ভারতীয় উপমহাদেশ নিকটবর্তী হওয়ায় ইন্দো-আর্য ভাষাভাষী মানুষ প্রাচীনকাল থেকেই আরাকানে ছিলেন। বৌদ্ধধর্মের প্রভাব প্রাচীন আরাকানে বেশি ছিল। অষ্টম শতাব্দীতে আরব ব্যবসায়ীদের সাথে এ অঞ্চলে ইসলামের আগমন ঘটে। ১৫ শতাব্দীতে আরাকান বঙ্গ সালতানাতের অধীনে চলে যাওয়ায় ইসলামী প্রভাব বৃদ্ধি পায়। মরুক ইউ রাজবংশ ৩০০ বছরের জন্য স্বাধীন আরাকান রাজ্য শাসন করেছে। এ সময় বর্মি শাসকেরা বারবার আরাকান দখলের জন্য আক্রমণ চালায়, কিন্তু সেখানকার বৌদ্ধ-মুসলিম-হিন্দু নির্বিশেষে সব আরাকানি সে আক্রমণ রুখে দাঁড়ায়।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর আরাকান ব্রিটিশ ভারতের বিভাগগুলোর একটি হয়ে ওঠে এবং পার্শ্ববর্তী বাংলা প্রদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের অধিবাসীদের অনেকে এখানে এসে বসতি স্থাপন করেন। আবার আরাকানের অনেকেই চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করেছেন। ১৯৩৭ সালে আরাকান ব্রিটিশ বার্মার একটি বিভাগ হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অঞ্চলটি জাপানের দখলে ছিল। বার্মার স্বাধীনতার পর এটি প্রশাসনিক বিভাগ হিসেবে চালু থাকে এবং পরে এটি একটি প্রদেশ হয়ে ওঠে। ১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে আরাকানের উত্তর অংশটি মায়ু সীমান্ত জেলা হিসেবে রেঙ্গুন থেকে পরিচালিত হয়।

১৯৮২ সালে, বর্মি জাতীয়তা আইন আরাকান অঞ্চলের অনেক বাসিন্দার নাগরিকত্ব ‘ছিনতাই’ করেছে। ১৯৮৯ সালে, দেশটির সামরিক জান্তা বার্মার সরকারি নাম মিয়ানমারে পরিবর্তন করে। ১৯৯০-এর দশকে জান্তা আরাকান রাজ্যকে রাখাইন স্টেট নাম দেয়, যা এখানকার রাখাইন সংখ্যাগরিষ্ঠতাই প্রতিফলিত করে। রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের অনেকে দৃঢ়ভাবে এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছে।

আরাকানের জনগণ ঐতিহাসিকভাবে ‘আরাকানি’ নামে পরিচিত। এর জনসংখ্যার মধ্যে তিব্বত-বর্মি এবং ইন্দো-আর্য রয়েছে। তিব্বতি-বর্মি আরাকানিরা এক ধরনের অপভ্রংশ বর্মি ভাষায় কথা বলে, যার সাথে বার্মার উচ্চারণ এবং শব্দভাণ্ডারের উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। ইন্দো-আর্য আরাকানিরা পূর্ব ইন্দো-আর্য ভাষাভুক্ত রোহিঙ্গা ভাষায় কথা বলে, যার সাথে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ধরনের মিল রয়েছে। মিয়ানমার সরকার তিব্বতি-বর্মি আরাকানিদের ‘রাখাইন জনগণ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আর কেমিনসহ মুসলিম সম্প্রদায়ের কিছু বিভাগকেও স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের অস্বীকার করে তাদের ‘অ-নাগরিক’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সামরিক সরকারের এই অন্যায় বিভাজন আরাকানি বৌদ্ধ ও মুসলিমদের মধ্যে বিভেদের দেয়াল তুলে দিয়েছে। আরাকান আর্মি তাদের জাতিগত স্বার্থে মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরোধী হলেও তারা রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকারের বিষয় সেভাবে স্বীকার করে না।

মিয়ানমারের সরকারি হিসাব অনুসারে, রাখাইন রাজ্যে ৩১ লাখ জনসংখ্যা। এর মধ্যে রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে কি না স্পষ্ট নয়। তবে উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুসারে, রাখাইনে রোহিঙ্গা অধিবাসীর সংখ্যা মোট ২৩ লাখ। তাদের মধ্যে ১৩ লাখ সেখানে রয়েছে, বাকি ১০ লাখ বিভিন্ন দেশে বসবাস করছে। এ হিসাব শেষ দফায় রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে সহিংসপন্থায় ঠেলে দেয়ার আগের। ধর্মবিশ্বাসের দিক থেকে রাখাইনের ৬০ ভাগ বৌদ্ধ এবং ৪০ ভাগের মতো মুসলিম।

পাশ্চাত্যের স্বার্থ
মিয়ানমার, বাংলাদেশ ও উত্তর-পূর্ব ভারতীয় অঞ্চলের প্রতি পাশ্চাত্যের বিশেষ একটি দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এই অঞ্চলের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ধর্মবিশ্বাস, নৃতত্ত্ব ও ভাষা-সংস্কৃতির সাথে মূল ভূখণ্ডের কম মিল বিদ্যমান। এই অঞ্চলে পাশ্চাত্যের মিশনারিদের কার্যক্রমও চলে আসছে অনেক আগে থেকে। এ অঞ্চলটি দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রধান দেশ ভারত ও চীনের সাথে লাগোয়া। বৈশ্বিক পরিসরে চীন বা ভারতের উত্থান ঠেকানোর ক্ষেত্রে দুই পক্ষের মধ্যে বৈরিতা বজায় রাখা এবং তাদের অগ্রগতি রোধ করার ব্যবস্থার মধ্যে পশ্চিমা শক্তির বড় ধরনের স্বার্থ রয়েছে। এ কারণে, এ অঞ্চলের প্রতি চীন ও ভারতের যেমন নিবিড় দৃষ্টি রয়েছে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এমনকি ইসরাইলেরও দৃষ্টি রয়েছে এখানকার পরিস্থিতির ওপর।

মিয়ানমারের অং সান সু চি সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার ছিল, বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর সাথে শান্তি চুক্তি করা। এটি সু চির পরলোকগত পিতা জেনারেল অং সান শুরু করে গিয়েছিলেন। কিন্তু পরে ষাটের দশকে সামরিক জান্তা ক্ষমতা নেয়ার পর এই প্রক্রিয়া আর সামনে এগোয়নি। কমপক্ষে ১৩টি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ও গেরিলা গ্রুপের সাথে সরকার ও সামরিক বাহিনীর নানা ফর্মেটে শান্তি আলোচনা চলছে। এর মধ্যে অস্ত্র বিরতিতে সম্মত আট সংগঠনের সাথে সরকারের সাময়িক চুক্তি হয়েছে।

বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর মধ্যে ‘আরাকান আর্মি’ অন্যতম হলেও সেনাবাহিনী কোনো সময় রাখাইন রাজ্যে শান্তি আলোচনা বা অস্ত্রবিরতির ব্যাপারে আগ্রহ দেখায় না। অথচ চীন ও ভারতের কানেক্টিভিটি, গভীর সমুদ্রবন্দর এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ বিবেচনায় এ রাজ্যটি সবচেয়ে সমৃদ্ধ। তবে সরকার এখানকার উন্নয়নের ব্যাপারে খুব নজর এর আগে দেয়নি।

এখন মিয়ানমারে চীন ও ভারত দু’টি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে। এর সাথে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সাথে সংযোগ স্থাপন করতে চাইছে দিল্লি; আর চীনের কুনমিং থেকে মান্দালয় হয়ে কিউকপিউ বন্দর পর্যন্ত অর্থনৈতিক করিডোর ও তেল-গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ করছে বেইজিং। ফলে রাখাইন রাজ্য চীন ও ভারত, দুই দেশের জন্যই বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আর এ দু’টি দেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সাথে বৈরী সম্পর্ক সৃষ্টি হতে পারে, এমন কোনো উদ্যোগ স্বাভাবিকভাবেই নেয়নি।

স্বার্থের টানাপড়েন
নতুন পর্যায়ে যে স্নায়ুযুদ্ধ বৈশ্বিকভাবে শুরু হয়েছে, তাতে চীন এ অঞ্চলে স্থিতাবস্থা নষ্ট হতে দেবে না। ভারতের স্বার্থও এই অঞ্চলের স্থিতাবস্থার সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা এই অঞ্চলে ‘নতুন কিছু’ চাইতে পারে। এই চাওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কারণ রয়েছে, চীন, ভারত, মিয়ানমার এমনকি বাংলাদেশেরও।

মিয়ানমার সরকারের জন্য দ্বিমুখী সঙ্কটের ব্যাপার হলো, দেশটির সরকার রাখাইন রাজ্যকে রোহিঙ্গা প্রভাবমুক্ত করার জন্য রাখাইনে বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদকে তিন দশকের বেশি সময় ধরে উসকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। এ জন্য আরাকান রাজ্যের নাম পাল্টে ‘রাখাইন’ করা হয়েছে। এই নীতি মিয়ানমারের জন্য এক দিকে পশ্চিমা দেশগুলো, অন্য দিকে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সাথে বৈরী সম্পর্ক তৈরি করেছে। অথচ আরাকানের জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধদের সমর্থন সু চি কিংবা সামরিক প্রভাবিত রাজনৈতিক দল, কোনোটারই পক্ষে নেই। আরাকানের রাজ্যসংসদও এখন জাতীয়তাবাদীদের নিয়ন্ত্রণে। রাখাইন রাজ্যের মানুষ এএ’র পক্ষে নাকি সরকারের পক্ষে, তা যাচাই করার জন্য গণভোট দেয়ার কথা বলেছে আরাকান আর্মি। এই চ্যালেঞ্জ তাৎপর্যপূর্ণ। এতে মনে হচ্ছে, রাখাইনের বৌদ্ধরাও মিয়ানমারের মূল ধারার প্রতি সমর্থন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এটি নেপিডো সরকারের জন্যই শুধু নয়, চীন বা ভারতের জন্যও উদ্বেগের। রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি রাখাইন বৌদ্ধরাও মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে এ অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগ্রাম অদূরভবিষ্যতে জোরালো রূপ নিতে পারে। এটি মিয়ানমার সরকারের পাশাপাশি চীন-ভারতের জন্যও উৎকণ্ঠার কারণ হতে পারে।
mrkmmb@gmail.com

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top