দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে যুদ্ধ লাগে লাগে অবস্থা চলছে দুই সপ্তাহ ধরে। তার মধ্যে একটি মাত্র সিদ্ধান্ত। তাতেই নাটকীয় মোড় নিয়েছে কাশ্মির ইস্যু। উত্তেজনা পেরিয়ে দুই দেশের মধ্যে যেন বইতে শুরু করেছে শান্তির সুবাতাস। আর এতে হিরো হয়ে গেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান, ভিলেনের তকমা পেয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
কাশ্মিরের পুলওয়ামায় আত্মঘাতী হামলায় গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ভারতের আধা সামরিক বাহিনী সিআরপিএফের ৪৪ জন সদস্য নিহত হয়। এ ঘটনায় ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করতে থাকে। পাকিস্তান এ অভিযোগ অস্বীকার করে জানায়, প্রমাণ থাকলে দিন, আমরা ব্যবস্থা নেব। ভারত এ ঘটনায় আন্তর্জাতিকভাবেও পাকিস্তানকে এক ঘরে করার চেষ্টা করে। কিন্তু তাতে বিফল হলে তারা নিজেরাই অর্থনৈতিকভাবে পাকিস্তানকে দুর্বল করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এ সময় শান্তির বার্তা জানিয়ে বলেন, যুদ্ধ কোনো সমাধান হতে পারে না। আসুন আমরা শান্তির জন্য কাজ করি। তবে তিনি এ কথাও স্মরণ করিয়ে দেন যে, ভারতের পক্ষ থেকে কোনো হামলা হলে তারা তার উপযুক্ত জবাব দেবেন।
এদিকে ভারতজুড়ে প্রবল চাপ সৃষ্টি হয় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে কাশ্মিরিদের ওপর হামলা চালানো হয়। এক পর্যায়ে গত মঙ্গলবার রাতে লাইন অব কন্ট্রোল (এলওসি) লঙ্ঘন করে পাকিস্তানে ঢুকে পড়ে ভারতের বিমানবাহিনীর কয়েকটি যুদ্ধবিমান। ভারতের পক্ষ থেকে কোনো সংবাদ আসার আগেই পাকিস্তানের আইএসপিআরের ডিজি আসিফ গফুর জানান, ভারতের কয়েকটি বিমান পাকিস্তানে ঢুকে পড়লে তাদের ধাওয়া দেয়া হয়। ফলে শীঘ্রই তারা দেশে ফিরে যায়।
কিন্তু ভারতের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, তারা পাকিস্তানের সশস্ত্র গোষ্ঠীর বেশ কয়েকটি ঘাঁটি ধ্বংস করে দিয়েছেন, তাতে নিহত হয়েছে তিন শতাধিক মানুষ। পাকিস্তান এ দাবি অস্বীকার করে। শুধু তাই নয়, তার এর প্রমাণ হিসেবে হামলার শিকার ওইসব স্থানে বিদেশি সাংবাদিকদের নিয়ে যায়। পরে রয়টার্সসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে ভারতের বক্তব্যের অসারতা উল্লেখ করে প্রতিবেদন ছাপানো হয়।
কিন্তু পাকিস্তান জানায়, যেহেতু ভারত পাকিস্তানের মাটিতে হামলা চালিয়েছে, আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে, তাই এর সমুচিত জবাব দেয়া হবে যথাসময়েই। এরই ধারাবাহিকতায় পরদিন বুধবার পাকিস্তান ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে সেনাঘাঁটিতে বোমাবর্ষণ করে দেশে ফিরে যায়।
পাকিস্তানের এ পদক্ষেপের পাল্টা জবাব দিতে গিয়ে আবারো প্রতিবেশী দেশটির আকাশসীমায় প্রবেশ করে ভারত। পাকিস্তানের সশস্ত্রবাহিনী এ সময় গুলি করে তাদের দুটি বিমান ভূপাতিত করে এবং এর একজন পাইলটকে গ্রেফতার করে। ভারত প্রথমে পাকিস্তানের এ দাবি অস্বীকার করলেও ওই পাইলট অভিনন্দন বর্তমানের ভিডিও প্রকাশ করলে ভারত পাকিস্তানের সে দাবির সত্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং অভিনন্দনের মুক্তি দাবি করে।
ভারত ধারণা করেছিল, পাকিস্তান অভিনন্দনকে আটকে রাখবে। আর নয়াদিল্লি এ বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অভিযোগ জানাবে। সেই সাথে তারা তিন বাহিনীর জরুরি বৈঠকও আহ্বান করে। কিন্তু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান প্রায় অপ্রত্যাশিতভাবেই অভিনন্দনকে মুক্তি দেয়ার ঘোষণা দেন। ফলে ভারতের পরিকল্পনা আবারো নস্যাৎ হয়ে যায়।
গত বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের পার্লামেন্টের যৌথ অধিবেশনে ইমরান খান বলেন, পাকিস্তান কোন ধরনের অস্থিরতা চায় না শান্তি চায়। তারই প্রেক্ষিতে শান্তির বার্তা দিতে ও ভারতের সঙ্গে আলোচনায় বসতে পাকিস্তানে আটক ভারতীয় পাইলট উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমানকে ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা দেন ইমরান খান।
এখন অবশ্য ভারতের বিশেষ করে মোদি সরকারের সুর পাল্টে গেছে। তারা বলছে তাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার কারণেই অভিনন্দনকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছে।
কিন্তু ভারতের মানুষের কাছে এ কয়দিনে মোদি সরকারের রূপ খুলে গেছে। পাকিস্তানে হামলার মাধ্যমে তাদের আসন বাড়ানোর পরিকল্পনা, পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অহেতুক হামলা, ভুল তথ্য প্রদান ইত্যাদির কারণে মোদির জনপ্রিয়তার পারদ আরো খানিকটা কমেছে। অন্যদিকে ভারতের মধ্যই বিস্ময়করভাবে বেড়ে গেছে পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও বিশ্বকাপজয়ী সাবেক ক্যাপ্টেন ইমরান খানের জনপ্রিয়তা। আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকেও ইমরান খানকে এ সিদ্ধান্তের জন্য স্বাগত ও অভিনন্দন জানানো হচ্ছে।
ভারতের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা পর্যন্ত ইমরানের পক্ষে সাফাই গাইছেন। তারা বলছেন, ইমরান খান কূটনীতি, রাজনীতি সব দিক দিয়েই মোদির চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছেন। কারণ ভারতের বারবার হামলার হুমকির মুখেও অব্যাহতভাবে শান্তির বার্তা দিয়ে গেছেন ইমরান।
ইমরানের পদক্ষেপের ভুয়সী প্রশংসা করেছেন, ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং, ভারতের সাবেক ক্রিকেট তারকা ও রাজনীতিবিদ নভোজিৎ সিং সিধু, ভারতের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ও সাবেক কর্নেল আজাজ শুক্লা, ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মিরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতিসহ আরো অনেকেই। তাদের ভাষায়, ইমরান খানের এ পদক্ষেপে সামরিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, নৈতিকতা ও রাষ্ট্রপরিচালনা সব দিক দিয়েই জয়ী হল পাকিস্তান।