কেন অশান্ত ভারতের অরুণাচল প্রদেশ?

ভুটান ও আসামের প্রতিবেশী ভারতের রাজ্য অরুণাচল প্রদেশে ভূমিপুত্র বনাম বহিরাগতদের বিবাদে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত দুজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

রাজ্যের নামসাই ও চাংলাং জেলায় বসবাসকারী আদিবাসী, দেওরি, গোর্খা, মিশিং, মোরান এবং সোনওয়াল কাচারির জনজাতির মানুষদের ‘স্থায়ী বাসিন্দা সার্টিফিকেট’ বা পিআরসি দেয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতেই গত ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে অশান্ত হয়ে উঠেছে অরুণাচলের রাজধানী ইটানগর। শহরে কারফিউ জারি হয়েছে। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে ‘অল অরুণাচল প্রদেশ স্টুডেন্টস ইউনিয়ন’ (‌এএপিএসইউ)-‌র দপ্তরে। পরিস্থিতি আয়ত্ত্বের বাইরে যেতে দেখে সেনা নামানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। শহরে রুট মার্চ করেছে ভারতীয় সেনা। লাগাতার অশান্তির জেরে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রাখা হয়েছে, দোকানপাট খোলেনি। ‘‌ক্যাশলেস’‌ হয়ে পড়েছে এটিএম।

দিল্লি থেকে পরিস্থিতির উপর নজর রাখছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কিছুদিন পর গোটা দেশে সাধারণ নির্বাচনের সঙ্গেই বিধানসভা নির্বাচন হতে চলেছে অরুণাচল প্রদেশে। এমনিতে শান্তির মরুদ্যান হিসেবে পরিচিত এই রাজ্যটি গণবিক্ষোভ ও রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য প্রসিদ্ধ।

অশান্তি মাত্রা ছাড়াতে দেখে পিছু হটেছে রাজ্য সরকার। বাতিল করা হয়েছে পিআরসি-‌র সিদ্ধান্ত। সরকার পুলিশের গুলিতে নিহতদের পরিবারকে ২০ লাখ টাকা করে আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি পরিবারের একজনকে চাকরির দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আহতদের প্রত্যেককে ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার ঘোষণাও করা হয়েছে। সেইসঙ্গে রাজ্যের মুখ্য সচিব সত্য পাল এক বিবৃতি জারি করে জানিয়েছেন, ‘‘‌বর্তমান পরিস্থিতির কারণে পিআরসি-‌তে মঞ্জুরি দেয়ার সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হলো। আপাতত কোনো পদক্ষেপ নেবে না সরকার।’‌’

সমস্যা কোথায়?
দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে সাংবাদিকতার সূত্রে উত্তর-‌পূর্বের কয়েকটি রাজ্যের সঙ্গে নাড়ির টান গড়ে উঠেছে কলকাতার সাংবাদিক শুভেন্দু রায়চৌধুরির। অরুণাচলের ঘটনা প্রসঙ্গে তার ব্যাখ্যা, ‘‌‘‌অসম রাজ্য ভেঙে একাধিক রাজ্য তৈরির সময় থেকেই এই সমস্যা জন্ম নিয়েছে। বহু মানুষ দীর্ঘদিন ধরে সমস্যায় জর্জরিত হয়ে রয়েছেন। ভারতীয় হওয়া সত্ত্বেও কোনও রাজ্য যদি নাগরিকের দায়িত্ব না নেয় তাহলে এতগুলো মানুষ যাবে কোথায়?‌ শিশুদের বিদ্যালয়ে ভর্তি বা হাসপাতালে চিকিৎসা থেকে শুরু করে যাবতীয় সরকারি সুবিধা পেতে নানা অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় তথাকথিত বহিরাগতদের। তবে, মনে রাখতে হবে, এদের বেশিরভাগই ভারতীয়।’‌’‌ তার মতে, উভয় পক্ষকেই কাছে টেনে নিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, কেউই যেন বঞ্চিত না হয়।

শুভেন্দু রায়চৌধুরি বলেন, ‘‘পিআরসি-‌র দাবি জানানো জনজাতিগুলো এবং আন্দোলনকারী ভূমিপুত্রদের প্রতিনিধিদের মুখোমুখি বসিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে। পারস্পরিক সহাবস্থানের সূত্র মেনে এগোতে হবে। সেক্ষেত্রে সরকারকে শুধুমাত্র মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে হবে। জোর করে সরকারি সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হলে তার ফল আরও ভয়ানক হতে পারে।”

ছ’‌টি জনজাতি গোষ্ঠীকে পিআরসি দেয়ার দাবি দীর্ঘ প্রতীক্ষিত। ১৯৯২-‌৯৩ থেকে পিআরসি দেয়ার কাজ স্থগিত রাখা হয়েছে। গতবছর পিআরসি মঞ্জুর করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিল রাজ্য সরকার। তারপর থেকেই শুরু হয়েছিল একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠীর আন্দোলন। সেইসময় সরকারের বক্তব্য ছিল, পিআরসি প্রদান করার আগে ‘জয়েন্ট হাই পাওয়ার কমিটি’র রিপোর্টের সুপারিশ খতিয়ে দেখবে সরকার। এই কমিটির চেয়ারম্যান রাজ্যের মন্ত্রী নবাম রেবিয়া।

অরুণাচলের মুখ্যমন্ত্রী পেমা খান্ডু সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘‌‘‌সংবাদমাধ্যম ও সোশাল মিডিয়ায় স্পষ্ট করে জানানো হয়েছে সরকার পিআরসি নিয়ে কোনও আলোচনায় যাবে না।’‌’

অশান্তির ধরণ কেমন?
ইটানগরে গিয়ে হেনস্থার শিকার হয়েছেন সিনেমা নির্মাতা উৎপল বরপূজারী। নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘‌ইটানগর ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে একটি ছবি প্রদর্শনের কথা ছিল। সেজন্য গিয়েছিলাম। উত্তেজিত জনতা এসে উৎসবের মঞ্চ জ্বালিয়ে দিল। শিল্পীদের মারধর করে তাদের গাড়ি‌সহ যাবতীয় সরঞ্জাম জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। তারপরেও ইটানগর জুড়ে তুমুল অশান্তি অব্যাহত। এমনকি, শপিং কমপ্লেক্সে লুটপাট চলেছে। পুলিশের গুলিতে কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে।’‌’

‌তার মতে, ‘‌‘‌সরকারি ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি ছিল। আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের আয়োজন হলে তার উপযুক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা উচিত ছিল। শিল্পীদের নিরাপত্তার বিষয়টি আরও গুরুত্ব দেওয়া জরুরি ছিল, সরকার তা করেনি।’‌’‌

রাজনীতি
তবে, এ নিয়ে রাজনীতি থামেনি। সমস্যার সমাধানের বদলে অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগে ব্যস্ত রাজনীতিকরা। অরুণাচল প্রদেশের বিজেপি সভাপতি টাপুর গাও সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘‌‘‌এই অশান্তির পেছনে রয়েছে কংগ্রেস। সরকার ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত স্থগিত রেখে আলোচনার কথা ঘোষণা করেছে। তা সত্ত্বেও রাজ্যে বিজেপি সরকারকে অস্থির করে তুলতে ষড়যন্ত্র করা হয়েছে।’‌’

‌এদিকে, রাজ্য কংগ্রেসের সভাপতি টাকাম সঞ্জয় বলেছেন, ‘‌‘‌নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে কংগ্রেসের ঘাড়ে দোষ চাপানো হচ্ছে৷ বিধানসভায় পিআরসি বিল কে এনেছে?‌ শহর জুড়ে তুমুল অশান্তি প্রমাণ করে দিয়েছে রাজ্যে আইন-‌শৃঙ্খলা বলে কিছুই নেই। সেনাবাহিনীকে ডাকতে হয়েছে। মোবাইল ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে অবিলম্বে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা উচিত।’’‌

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top