ঢাকা সিটিতে ভোটারহীন ভোট

নীরবে শেষ হলো ভোটারশূন্য, আগ্রহহীন ও নিরুত্তাপ এক নির্বাচনে ভোটগ্রহণ। নগরীর অনেক ভোটারই জানেন না সিটিতে নির্বাচন। অনেক ভোটকেন্দ্রের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় জানতে চান কি হচ্ছে এখানে? ভোট বলা হলে, আবার প্রশ্ন, কিসের ভোট? যারা ভোট দিতে গিয়েছেন তাদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে নাম্বার খুঁজে পেতে। এবার ভোটারদের নাম্বার খুঁজে পেতে নির্বাচন কমিশন থেকে এসএমএসের কোনো পদ্ধতি রাখা হয়নি। সরেজমিন কেন্দ্রগুলো ঘুরে ভোটারদের তেমন একটা উপস্থিতি দেখা না গেলেও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সচিব বলেছেন আনুমানিক ৫০ শতাংশ ভোট পড়েছে। প্রধান বিরোধী দল অংশ না নেয়ায় এটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নয় বলে মন্তব্য করেছেন জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। আর বিশ্লেষকেরা বলছেন, অতীতে নির্বাচন দেখে মানুষের ভোট দেয়ার আগ্রহ হারিয়ে গেছে। তাই তারা ভোট দিতে যাননি। উৎসাহ-উদ্দীপনা রাজনৈতিক দল ও ভোটার কারো মধ্যে ছিল না।
অসমাপ্ত এক বছর মেয়াদের জন্য ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র পদে নির্বাচন গতকাল বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় নির্বাচনের সার্বিক চিত্র দেখে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এই নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহ দেখায়নি। তাদের অংশগ্রহণ না থাকায় ভোটারদের কাছে এই নির্বাচন গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে। রাজধানীর বিভিন্ন কেন্দ্র পরিদর্শন করে দেখা গেছে, এই উপনির্বাচনে ভোটারদের তেমন উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল না। তার মধ্যে সকাল থেকেই বিভিন্ন এলাকায় ছিল বৃষ্টি। সব মিলে ভোটারদের আগ্রহ ছিল খুব কম।
খোদ ইসির জ্যেষ্ঠ কমিশনার মাহবুব তালুকদার মগবাজার ইস্পাহানি স্কুল ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনের সময় সরকারদলীয় মেয়র পদের পোলিং এজেন্ট ছাড়া আর কোনো প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট সেখানে দেখেননি বলে জানান। তার তথ্যানুযায়ী, সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত একই ইমারতে অবস্থিত পাঁচটি ভোটকেন্দ্রের ১৫টি বুথে মাত্র ৩৮৫ জন ভোট দিয়েছেন। অথচ পাঁচ কেন্দ্রে ভোটার সংখ্যা ৯ হাজার ৪১৩ জন।
শাহীনবাগ সিভিল অ্যাভিয়েশন স্কুল কেন্দ্রের ভোটার মাহবুুবুর রহমান বুথে গিয়েও ভোট দিতে পারেননি বলে জানান। তিনি বলেন, বেলা ১টায় তিনি ভোট দিতে যান। বুথে ঢুকে দেখেন শুধু পোলিং অফিসার বসে আছেন। তিনি ভোটার স্লিপ দিয়ে ব্যালট পেপার চাইলে কর্মকর্তা বলেন, লোকজন নেই। দেরি হবে। তারা কোথায় গেছে জানতে চাওয়া হলে ওই পোলিং কর্মকর্তা বলেন, লাঞ্চে গেছে। পরে মাহবুবুর রহমান জানান, তিনি পোলিং কর্মকর্তাকে তার ভোটার স্লিপ দিয়ে বলেন, স্লিপ রাখেন, আপনারাই ভোটটা দিয়ে দিয়েন।
মনিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন ভোটারের সাথে কথা বলে বেলা সাড়ে ১১টায় জানা যায়, ওই কেন্দ্রের দ্বিতীয়তলায় পুরুষ বুথে সাড়ে তিন ঘণ্টায় মাত্র ১০টি ভোট পড়েছে। পুরো কেন্দ্রের ভেতরে ভোটারদের হাতেগোনা দু-একজনের উপস্থিতি লক্ষণীয় ছিল। নির্বাচনে মেয়র পদে দু’টি রাজনৈতিক দলেরসহ মোট পাঁচজন প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু ওই বুথে মাত্র দু’জন পোলিং এজেন্টকে দেখা গেছে। পোলিং অফিসার জানান, কেউ এজেন্ট দেয়নি। তাই নেই। ভোটাররা আসছে না। তিনি ভোটারকে বলেন, আপনি বাসায় গিয়ে অন্য ভোটারদের পাঠিয়ে দেন।
উপনির্বাচনে মেয়র পদে পাঁচ প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন, আওয়ামী লীগের আতিকুল ইসলাম, লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে জাতীয় পার্টির মোহাম্মদ শাফিন আহমেদ, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল (পিডিপি) থেকে শাহিন খান, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) আনিসুর রহমান দেওয়ান ও স্বতন্ত্র প্রার্থী নর্থসাউথ প্রপার্টিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো: আব্দুর রহিম।
জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোহাম্মদ শাফিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ভোটে মানুষের আগ্রহ কম। কারণ এর আগে যে নির্বাচন হয়েছে সেগুলো অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। অতীতের সেই নির্বাচনের পরিস্থিতিতে ভোটাররা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন বলেই তারা ভোটকেন্দ্রে আসতে চাচ্ছেন না। আর এ কারণেই ভোটকেন্দ্রে উপস্থিতি কম।
নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ফেমার চেয়ারপারসন মুনিয়া খানের মতে, মাত্র এক বছর, এত কম সময়ের জন্য এই নির্বাচন। তাই অনেকে নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহ দেখাননি। কারণ এত অল্প সময়ে কি বা কাজ করতে পারবেন তারা। পরের পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচনে অংশ নিলে তখন গত এক বছরে কি কাজ করেছেন সেটাকে আমলে নেবে ভোটাররা। তাই এই নির্বাচন নিয়ে উৎসাহ কম। তিনি বলেন, প্রতিকূল আবহাওয়া ছাড়াও মানুষ ভোটের প্রতি আগ্রহ হারিয়েছে।
স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. বদিউল আলম মজুমদারের মতে, এটা কোনো নির্বাচন নয়। একটা আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। আমি যেসব কেন্দ্র ঘুরেছি তাতে কোথাও লোকজন নেই। তিনি বলেন, ভোটের প্রতি মানুষের একটা অনীহা এসে গেছে। কারো কোনো আগ্রহ নেই। কারণ তারা ভোটার হয়েও নিজের ভোট দিতে পারেন না। আবার কেউ কেউ কেন্দ্রেও যেতে পারেন না। তিনি বলেন, দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নেয়নি। যার কারণেও ভোটাররা এই নির্বাচনে ভোট দেয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।
বিপুল ভোটে আতিকুলের জয় : ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) উপনির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয় পেতে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগসমর্থিত প্রার্থী আতিকুল ইসলাম। ১২৯৫ ভোট কেন্দ্রের মধ্যে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ১১১৩টির ঘোষিত ফলাফলে তিনি পেয়েছেন ৬ লাখ ৯৪ হাজার ৫৮৬ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে শাফিন আহমেদ পেয়েছেন ৩২ হাজার ৭৬৩ ভোট।
গতকাল বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে স্থাপিত নির্বাচন কমিশনের ‘ফল সংগ্রহ ও পরিবেশন কেন্দ্র’ থেকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) নির্বাচন কর্মকর্তা আবুল কাসেম এ ফল ঘোষণা করছেন।
ডিএনসিসির মেয়র পদে মোট পাঁচজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। অপর প্রার্থীদের মধ্যে ন্যাশনাল পিপলস পার্টির আনিসুর রহমান দেওয়ান পেয়েছেন ৫১০৬ ভোট, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক পার্টির শাহিন খান ৫০০৪, স্বতন্ত্র প্রার্থী রহিম ৭২০৪ ভোট পেয়েছেন। যেখানে ভোটের হার ২৮.৯৪ শতাংশ।
এর আগে সকাল ৮টা থেকে ভোটগ্রহণ শুরু হয়ে একটানা চলে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। বৈরী আবহাওয়া মাথায় নিয়ে বেশ শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। যদিও ভোটারদের উপস্থিতি কম ছিল। দুই সিটির কাউন্সিলর পদের ভোট মিলিয়ে ভোটের হার ৫০ শতাংশ হতে পারে বলে মন্তব্য করছেন নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ।
ডিএনসিসির ১৮টি সাধারণ ওয়ার্ডে ১১৬ জন ও সংরক্ষিত ওয়ার্ডে ৪৫ জন প্রার্থী রয়েছেন। ডিএসসিসির ১৮টি সাধারণ ওয়ার্ডে প্রার্থী ১২৫ জন ও সংরক্ষিত ওয়ার্ডে ৪৫ জন প্রার্থী।
ঢাকা উত্তরের ২১ নম্বর ওয়ার্ডের উপ-নির্বাচনে ৭ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। আর নয় নম্বর সাধারণ আসনে একজন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ডিএনসিসি নির্বাচনে মেয়র পদে মোট ৫৪টি ওয়ার্ডের ভোটার সংখ্যা ৩০ লাখ ৩৫ হাজার ৫৫৯ জন।
আর নতুন সৃষ্টি হওয়া ৩৭ নম্বর থেকে ৫৪ নম্বর পর্যন্ত ১৮টি ওয়ার্ডে ও ৬টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নির্বাচনে ৫ লাখ ৯০ হাজার ৭০৫ জন ভোটার তাদের মেয়র ও কাউন্সিলর নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পেয়েছেন।
ঢাকা দক্ষিণের ৫৮ থেকে ৭৫ নম্বর পর্যন্ত মোট ১৮টি সাধারণ ওয়ার্ডের ও ৬টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নির্বাচনে ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৭৩৫ জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পেয়েছেন।
৪১ নম্বর ওয়ার্ডে বিজীয় সফিকুল : ৪১ নম্বর ওয়ার্ডে (সাঁতারকুল) সফিকুল ইসলাম ২২২ ভোটে জয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আব্দুল্লাহ খান।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top