‘আয়রে ভোটার কেন্দ্রে আয়, ভোটের বাক্স ফাঁকা যায়’

ভোটার ভোটার ডাক পাড়ি/ভোটার গেল কার বাড়ি/ আয়রে ভোটার কেন্দ্রে আয়/ভোটের বাক্স ফাঁকা যায়। নগরীতে ভোট নিয়ে এমনি একটি ছড়া লিখেছেন কিবরিয়া সিকদার নামে একজন গণমাধ্যমকর্মী। রাজধানীতে ভোটারবিহীন নির্বাচন নিয়ে এ রকম নানা হাসি-ঠাট্টা গতকাল ছিল মুখে মুখে। ব্যঙ্গাত্মক প্রতিক্রিয়া উঠে এসেছে সামাজিক গণমাধ্যমেও।

দুপুর ১২টায় হাতিরঝিল এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখা যায় একদল তরুণ ব্যাট-বল হাতে রাস্তায় নেমে পড়েছে। ক্রিকেট খেলছেন তারা। সেখানে আসাদ নামে এক তরুণকে নির্বাচন নিয়ে জানতে চাইলেই বলেন, ‘ভাই, ভোট-টোট জানি না, আজ সব ফাঁকা, রাস্তাই মাঠ। আসেন খেলি।’

খিলগাঁও চৌধুরীপাড়ায় বাসার নিচে বসে অন্য দিনের মতো চা খাচ্ছিলেন ৬৫ বছরের আনোয়ার হোসেন। ইলেকশন নিয়ে কী ভাবছেন চাচা? ‘ইলেকশন, এটা আর ভাবমু কী। এটা তো ভাবার কিছু নাই। প্রচার-প্রচারণা করলেও ইলেকশন হবে, না করলেও হবে। এটা তো নামমাত্র। জনগণের কাছে আসবারতো দরকার নাই। এমনিতেই পাস।’ ‘বিরোধী দল নাই। ভোট দিতে যাইয়া কী করমু’ যোগ করেন আনোয়ার। সেখানেই উপস্থিত এক ব্যবসায়ী সালাম। তিনি হাসি দিয়ে বলেন, ‘বৃষ্টির মতো সব কিছু ঠাণ্ডা। কিসের ভোট’। মধ্য বাড্ডায় এক চায়ের দোকানে গিয়ে দেখা গেল লোকজন ভোট নিয়ে কথা বলছেন, আর হাসছেন। একজন বললেন, ‘নির্বাচন নিয়া জনগণের এখন আর কোনো আগ্রহ নাই। আগের রাতেই সব পাস।’

উত্তর সিটির মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলাম গতকাল বৃহস্পতিবার ভোট গ্রহণের শুরুর দিকে গরম খিচুড়ি খেয়ে ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন। বৃষ্টির দিনে গরম খিচুড়ি সত্যিই মজার; কিন্তু মেয়র প্রার্থীর এমন আহ্বানে খুব একটা সাড়া মেলেনি। নগরবাসী হয়তো বাসায় খিচুড়ি ঠিকই খেয়েছেন; কিন্তু বের হওয়ার আগ্রহ দেখাননি।

ফেসবুকে এ নির্বাচন নিয়ে রীতিমতো হাসির রোল উঠেছে। আনোয়ার হোসেন সাগর নামে বিশ্ববিদ্যালয়পড়–য়া একজন লিখেছেন, ‘উত্তর প্যারিস ও দক্ষিণ লস অ্যাঞ্জেলসে একযোগে ভোট অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ভোটারদের আগ্রহ আগের মতো নেই বললেই চলে। তবে কেউ কেউ খিচুড়ি রান্না করছেন। ভোটার অংশগ্রহণ বাড়াতে বিশ্লেষকেরা আগামীতে অনলাইন ভোটের উদ্যোগ গ্রহণের পরামর্শ দিচ্ছেন।

নুরুজ্জামান সরদার নামে একজন রাজনৈতিক কর্মী লিখেছেন- ‘ধুর শালার বৃষ্টি, আজকের উৎসবমুখর ভোটটাই পণ্ড করে দিলো। পাবলিকের মাইর দুনিয়ার বাইর।’ ভোটার টানতে সরকারিভাবে ‘প্রণোদনা’ দেয়ার দাবি জানিয়েছেন বশির আহমেদ নামে একজন ব্যাংকার।

রাজনৈতিক ও মানবাধিকার কর্মী আবু তৈয়ব তার পোস্টে লিখেছেন- ‘ভোট বর্জন দিবস, ২৮ ফেব্রুয়ারি।’ আমাদের সময় ডট কমের সাংবাদিক টিটু শাহানুজ্জামান লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের আরো একটি নির্বাচনের সাক্ষী হলাম আজ। সত্যিই ভাল্লাগে দেখতে।’ আরেকজন লিখেছেন- ‘নিন্দুকেরা যা-ই বলুক, আমি নিশ্চিত দিন শেষে কমপক্ষে ৮১-৮৬ ভাগ ভোট পড়বে ডিএনসিসি নির্বাচনে। আমাদের হুদাই আছে না?’

সমকালের সাংবাদিক ইমতিয়াজ ইমতু লিখেছেন- ‘ওয়েস্টার্ন ডেভলপড কান্ট্রিতে ভোট কাস্টের হার কম। পলিটিক্স নিয়ে জনগণের ভাবনা কম। বাংলাদেশও সে পথে। তাই বাংলাদেশও উন্নত দেশের মহাসড়কে।’ রাজনৈতিক কর্মী মাহবুবুল হাসান পিঙ্কু তার পোস্টে লিখেছেন–‘মানুষ চেয়েছিল সংসদ নির্বাচনে তাদের মতামত ব্যক্ত করতে। সেটিই যেহেতু পারে নাই, তাই গলি-ঘুপচির নির্বাচনে তারা আর ভোট দিতে আগ্রহী নন।’ সোহেল আহসান নীপু একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত। তিনি বলেছেন- ‘অফিসে আসার পথে ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল কলেজের সামনে দেখলাম প্রার্থীর সমর্থকেরা ভোট দিতে মানুষকে ডাকছে’। সিনিয়র সাংবাদিক মোস্তফা ফিরোজ লিখেছেন- ‘এটা কি অফিস-আদালত, ব্যবসাবাণিজ্য, বন্ধ রাখার মতো একটি নির্বাচন?’

হাসির খোরাক দিয়েছেন আরেকজন সমাজকর্মী। তিনি লিখেছেন- এক ভোট কেন্দ্রের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভোট কেন্দ্রে পুলিশ, আনসার ও কর্মকর্তাদের মহা প্রস্তুতি। অধীর আগ্রহে ভোটারের জন্য তাদের অপেক্ষা। বাইরে একটা টেবিল সাজিয়ে বুথ নিয়ে বসে আছে একজন। এরিই মধ্যে একজন মহিলাকে রাস্তা দিয়ে যেতে দেখেই তাকে সবাই মিলে অনুরোধ করছেন একটা ভোট দেয়ার জন্য। মহিলা তাদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে বললেন- ‘আমি তো এখানকার ভোটার না।’ জবাবে মৃদু হেসে আহ্বানকারী জবাব দিলেন- ‘সমস্যা নাই আপনি এই সিলিপটা নিয়া ভিতরে ভোট দিয়া আসেন।’

বাংলা ট্রিবিউনের সাংবাদিক আদিত্য রিমন। তিনি দিয়েছেন মজার তথ্য। রিমন জানান, গুলশানে মানারাত স্কুল ভোটকেন্দ্রে সকাল সাড়ে ১০টায় গিয়ে দেখা গেছে- ‘ভোটার নেই। কিন্তু টেলিভিশন লাইভে দেখাতে হবে ভোটারের দীর্ঘ লাইন। স্থানীয় লোকজনকে ডেকে এনে দাঁড় করিয়ে লাইন সাজিয়ে সেই ব্যবস্থাও করা হয়। এরপর সেখানে উপস্থিত অন্য সাংবাদিকদের সামনেই চলতে থাকে সাজানো লাইনকে ভোটার বানিয়ে ভিডিও করা। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ফটো সাংবাদিক জীবন আহমেদ জানান, ‘ভোটকেন্দ্র সকাল থেকেই ফাঁকা। হঠাৎ জনাপঞ্চাশেক মানুষ একসাথে কেন্দ্রে প্রবেশ করে। প্রথমে আমরা মনে করেছি কোনো প্রার্থী কেন্দ্রে আসছেন। এর পরপরই দেখি তারা একটি লাইনে দাঁড়ালেন। এরপর একটি টেলিভিশনের সাংবাদিক তাদের সামনে দাঁড়িয়ে লাইভ দিতে থাকেন, এটি ভোটারদের লাইন- এই বলে।’

এই ফটো সাংবাদিক আরো বলেন, ‘সে সময় আমি পাশে থেকে শুনেছি রিপোর্টার বলছেন, এখানে সবাই দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করছেন ভোট দেয়ার জন্য। এ সময় সাজানো ভোটারদের অনুভূতিও রেকর্ড করা হয়। লাইনে দাঁড়ানো লোকজন সাক্ষাৎকার দিয়ে লাইন ভেঙে দ্রুত বেরিয়ে যান কেন্দ্র থেকে।’

নির্বাচন কমিশন কাভার করেন ইত্তেফাকের সাঈদুর রহমান। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন- ‘ভোট। হ্যাঁ ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল অসাধারণ ভোট। স্মরণকালের সবচেয়ে কম ভোটারের উপস্থিতি। তবু আইনানুগ ভোট। এই ভোটে নির্বাচন কমিশনের খরচ হয়েছে প্রায় ২০ কোটি টাকা! ভোটের পেছনে এভাবে কোটি কোটি টাকা খরচ করা সমীচীন বলে মনে করছি না। কোটি কোটি টাকা ভোটে খরচ না করে গরিবের পেছনে খরচ করলে উপকৃত হতো তারা। যাই হোক হয়তো সারা দিন খিচুড়ি খানায় ব্যস্ত থাকায় ভোটারের উপস্থিতি কম। দুই সিটিতে সাধারণ ছুটি ঘোষণা এবং যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা না থাকলে হয়তো জনগণ জানতোই না ঢাকায় ভোট হচ্ছে।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top