ব্যাটল অব দ্য টাইটানস : ভারত-পাকিস্তান আকাশযুদ্ধ

উপমহাদেশের বিখ্যাত গায়ক আদনান সামি খান। ভারতের মুম্বাইয়ে তার বসবাস। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের ‘আজাদ’ কাশ্মিরে ভারতীয় বিমানবাহিনীর অ্যাকশনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে তিনি টুইটারে লিখেছেন- ‘মোদিজী, সশস্ত্রবাহিনী আপনার সাথে আছে। ভারতীয় বিমানবাহিনীর প্রতি শ্রদ্ধা। কী জোশ! বন্ধ করো টেররিজম। জয়হিন্দ।’ আদনান সামি ১৮ বছর আগে পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে আসেন এবং সম্প্রতি ভারতীয় পাসপোর্ট গ্রহণ করেছেন। এটা নিতান্তই তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু বাবার পরিচয়ে ভারতীয় বিমানবাহিনীর প্রতি তার এই সমর্থন বেশ বিস্ময়কর বটে। তিনি হলেন পাকিস্তানের জাতীয় বীর, বিমানবাহিনীর স্কোয়াড্রন লিডার ও রাষ্ট্রদূত আরশাদ সামি খান।

পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে সবচেয়ে কমবয়সী হিসেবে সর্বশ্রেষ্ঠ জঙ্গিবিমান চালকের ট্রফি জয় করেছিলেন আরশাদ। ষাটের দশকে ঢাকার তেজগাঁও বিমানঘাঁটিতে অবস্থিত ১৪ স্কোয়াড্রনে মার্কিন এফ-৮৬ জঙ্গিবিমানের পাইলট হিসেবে কর্মরত থাকার সময় এক বাঙালি রমণীর প্রেমে পড়ে যান। তাদের বিয়ে প্রায় হয়ে গিয়েছিল; কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়নি। ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর যখন ভারত পাকিস্তান আক্রমণ করে, তখন পাক বিমানবাহিনী ভারতের অভ্যন্তরে কয়েকটি বিমানঘাঁটিতে অতর্কিতে হামলার পরিকল্পনা করে। এর একটি ছিল পাঞ্জাবের পাঠানকোট বিমানঘাঁটি। সে সময় পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সাথে ভারতীয় বিমানবাহিনীর শক্তির হার ছিল এক অনুপাত পাঁচ। অর্থাৎ পাকিস্তানের একটি বিমানের বিপরীতে ভারতের ছিল পাঁচটি বিমান।

পাঠানকোট রেইডের অন্যতম সদস্য ছিলেন তদানীন্তন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আরশাদ সামি খান। ছয়টি এফ-৮৬ জঙ্গিবিমান আক্রমণে অংশ নেয় এবং দু’টি সুপারসনিক এফ-১০৪ স্টার ফাইটার ওপরে উড়ে কভার প্রদান করেছিল। একটি এফ-১০৪ বিমানের চালক ছিলেন উইং কমান্ডার এম. জি তাওয়াব, যিনি পরবর্তীকালে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হয়েছিলেন। পাঠানকোট বিমানঘাঁটিতে আক্রমণ করে সে বার পাক বিমানবাহিনী সাতটি মিগ-২১ ও পাঁচটি মিসটেয়ার জঙ্গিবিমান ছাড়াও সি-১১৯ পরিবহন বিমান ধ্বংস করে দেয়। সে সময়কার মানদণ্ডে সর্বাধুনিক সুপারসনিক জঙ্গিবিমান ছিল সোভিয়েত রাশিয়ার তৈরি মিগ-২১। পাঠানকোটে যদি ওই বিমানগুলো ধ্বংস না হতো, তাহলে হয়তো আকাশযুদ্ধে ভারতের একচেটিয়া প্রাধান্য থেকে যেত। কিন্তু যুদ্ধের শুরুতেই ওগুলো ধ্বংস হওয়ায় তারা বেশ বিপদে পড়ে যান। ওই অ্যাকশনের জন্য আরশাদ সামি বীরত্বসূচক সিতারা-ই-জুরাত পদকে ভূষিত হন।

যুদ্ধের পর তাকে প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের এডিসি নিয়োগ করা হয়। পরে তিনি আরো দু’জন প্রেসিডেন্ট যথাক্রমে ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর এডিসি ছিলেন। এক সময় বিমানবাহিনী থেকে চলে এসে যোগ দেন সিভিল সার্ভিসে। তিনি রাষ্ট্রদূতসহ বিভিন্ন উচ্চ পদে কাজ করেছেন। ভাগ্যের কী পরিহাস, আরশাদ অসুস্থ হয়ে পড়লে তার ছেলে আদনান সামি তাকে মুম্বাইতে নিয়ে যান এবং সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ২০০৯ সালের ২২ জুন ইন্তেকাল করেন। পাকিস্তান সরকার তার লাশ দেশে নিয়ে যায় এবং ২১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় তাকে দাফন করা হয়। ২০১২ সালে তাকে প্রদান করা হয় মরণোত্তর সিতারা-ই-ইমতিয়াজ খেতাব। আজ তারই ছেলে ভারতীয় বিমানবাহিনী কর্তৃক পাকিস্তানের অভ্যন্তরে পরিচালিত হামলার সমর্থনে বিবৃতি প্রদান করছেন!

কাশ্মির ইস্যু নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে তা সার্বিক যুদ্ধের দিকে মোড় নেবে কি না, নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। তবে কাশ্মির নিয়ে এযাবৎ এ দু’টি দেশ দু’বার যুদ্ধে লড়েছে। একবার ১৯৪৮ সালে ও আরেকবার ১৯৬৫ সালে। কাশ্মির যে দুই ভাগে বিভক্ত, সেই সীমানারেখাকে ‘আন্তর্জাতিক সীমান্ত’ বলা হয় না, বরং তা ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ হিসেবে স্বীকৃত। ১৯৬৫ সালে প্রথমেই সার্বিক যুদ্ধ শুরু হয়নি। ভারত অধিকৃত কাশ্মিরে বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতির জন্ম হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে লাইন অব কন্ট্রোলে দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটছিল। ভারতীয় বাহিনী অকস্মাৎ আজাদ কাশ্মিরের কৌশলগত এলাকা হাজী পীর পাসসহ কয়েকটি পাকিস্তানি ঘাঁটি দখল করে নেয় সীমানা বরাবর। সামরিক শক্তিতে তুলনামূলকভাবে দুর্বল পাকিস্তান একপর্যায়ে বিকল্প হিসেবে ১৯৬৫ সালের আগস্টে ভারতীয় অধিকৃত কাশ্মিরে শুরু করে ‘অপারেশন জিব্রাল্টার’ নামে এক গোপন কমান্ডো মিশন।

এর দ্বিতীয় ধাপে ওই বছরের ১ সেপ্টেম্বর শুরু হয় সামরিক অভিযান- ‘অপারেশন গ্রান্ডস্লাম’। ভারত ওই পাল্টা ও বিদ্যুৎগতির সামরিক আক্রমণে হতবাক হয়ে পড়ে। তারা ধারণাও করতে পারেননি যে, কয়েকটি ঘাঁটি দখল করে নেয়ার প্রতিশোধ হিসেবে ‘ক্ষুদ্র’ পাকিস্তান ওভাবে হামলা করবে। দ্রুত অগ্রসরমান পাক বাহিনী যখন ভারতঅধিকৃত কাশ্মিরের অভ্যন্তরে আখনুর শহরের কাছাকাছি পৌঁছে যায় তখন পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য বিমানবাহিনীকে যুদ্ধে নামানোর জন্য তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নেয় ভারত সরকার। ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসে ভারতীয় বিমানবাহিনীর ভ্যাম্পার ও অরেগন জঙ্গিবিমান প্রতিপক্ষে অগ্রযাত্রা ঠেকিয়ে দেয়ার জন্য। পাকিস্তান বিমানবাহিনী সেগুলো মোকাবেলার জন্য পাঠায় দু’টি মার্কিন এফ-৮৬ জঙ্গিবিমান। এর একটির পাইলট ছিলেন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের রাজশাহী কলেজের সাবেক ছাত্র স্কোয়াড্রন লিডার এস এ রফিকী। পাক বিমানবাহিনীর পাইলটদের প্রশিক্ষণের মান ছিল অনেক উঁচু।

অল্প সময়ের মধ্যেই উড়ে যাওয়া, ওদের বিমানগুলো চারটি ভ্যাম্পায়ারকে গুলি করে ভূপাতিত করে। বাকিগুলো পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ওই দিনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় বিমানবাহিনী বাধ্য হয়ে ৮০টির ওপরে ভ্যাম্পার ও ৫০টি অরেগন যুদ্ধবিমান ফ্রন্টলাইন সার্ভিস থেকে সরিয়ে নেয়। বিমানবাহিনীর মাত্র একটি আঘাতেই এভাবে ভারতীয় বিমানবাহিনীর শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ শক্তি নিউট্রালাইজ করতে সক্ষম হয় পাকিস্তান। কাশ্মির এলাকায় শত্রু বাহিনীর অগ্রযাত্রা ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ায় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ শেষমেশ ৬ সেপ্টেম্বর বিপুল শক্তি নিয়ে আক্রমণ চালায় লাহোরের আন্তর্জাতিক সীমান্ত বরাবর। শুরু হয় ‘অল আউট ওয়ার’। কাশ্মিরের সীমিত যুদ্ধ এভাবে ছড়িয়ে পড়ে সব সীমান্তে।

এবারো কাশ্মির এলাকায় শুরু হয়েছে সে দুই দেশের শক্তি প্রদর্শনের লড়াই। ভারত অধিকৃত কাশ্মিরে কয়েক মাস ধরেই চলছিল স্বাধীনতাকামীদের সাথে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষ। এতে যেমন কাশ্মিরিরা নিহত হচ্ছিলেন, তেমনি ভারতীয় সেনা ও আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যরাও প্রাণ হারাচ্ছিলেন। বরাবরই কাশ্মিরিদের উসকে দেয়ার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে আসছে ভারত। তবে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামা ঘটনার আগ পর্যন্ত অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগের মধ্যেই তা ছিল সীমিত। ওই দিন কাশ্মিরি এক তরুণে আত্মঘাতী বোমা হামলায় ভারতের আধা সামরিক বাহিনীর ৪৪ জন সদস্য নিহত হওয়ায় পুরো ভারত হতভম্ব হয়ে পড়ে। কারণ, তাদের দৃষ্টিতে ওটি ছিল জয়েশ-ই-মোহাম্মদ নামের এক জঙ্গি দলের সন্ত্রাসী হামলা এবং এ দলটি ‘পাকিস্তানের মদদে পরিচালিত’ বলে অভিযোগ ভারতীয় কর্তৃপক্ষের। এভাবে মাত্র একটি ঘটনায় এত সৈন্য মারা যাওয়ায় পরিস্থিতি যে জটিল আকার ধারণ করেছে, তা বুঝতে পারে ভারত সরকার। পাকিস্তান অভিযোগ অস্বীকার করলেও ভারতে প্রচণ্ড ক্ষোভের মাত্রা বাড়তে থাকে। আত্মঘাতী হামলাটি আসলে কেন হয়েছে বা কারা করেছে, এর বিশ্লেষণ ভিন্ন বিষয়।

শুধু এটুকু বলা যায় যে, নব্বইয়ের দশক থেকে ভারত কাশ্মিরে ইসরাইলিদের পরামর্শে স্বাধীনতাকামী আন্দোলন দমনে অত্যন্ত কঠোর পদ্ধতি অনুসরণ করে আসছে। ইসরাইলি কনসালট্যান্টরা এ ব্যাপারে ভারতীয় বাহিনীকে বেশ ভালোভাবেই প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারত যদি তার নিজস্ব ধারায় সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিত, তাহলে হয়তো পরিস্থিতি এত অগ্নিগর্ভ হতো না। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত শক্তি ও দমনপ্রক্রিয়া অনুসরণ করায় কাউন্টার রি-অ্যাকশনে সেখানে জঙ্গি দলগুলো সহজেই সক্রিয় হতে পেরেছে এবং জেঁকে বসেছে। স্বাধীনতাকামীদের মধ্যেও তারা অনুপ্রবেশ করেছে, যা ভারতের নিরাপত্তার জন্য হয়ে দাঁড়িয়েছে খুব ঝুঁকিপূর্ণ। যে বালকটি এবার আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়েছে, তার এ কাজকে কখনোই সমর্থন জানানো যায় না। কারণ, নিঃসন্দেহে সেটি সন্ত্রাসী তৎপরতা। কিন্তু তাকে এক সময় ভারতীয় বাহিনী প্রকাশ্যে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছিল। তাই জেদের বশে সে যোগ দিয়েছিল জঙ্গি সংগঠনে। হাইহ্যান্ডেডনেস এভাবেই জঙ্গি তৈরিতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে থাকে।

ভারতীয় বিমানবাহিনী গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ভোর ৩টার দিকে লাইন অব কন্ট্রোল অতিক্রম করে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে হামলা চালিয়েছে। অনেকেই বলছেন, ১৯৭১ সালের পর এটিই প্রথম সীমান্ত লঙ্ঘন। এর আগেও কারগিল যুদ্ধের সময় পাকবিমানবাহিনী তিনটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছিল নিজেদের সীমান্তের অভ্যন্তরে। এবারের ঘটনাটি অবশ্য ভিন্ন। কারণ, কারগিলে দুই পক্ষের যুদ্ধের মধ্যে দুই দেশের বিমানবাহিনী আকাশে লড়েছিল। আর সাম্প্রতিক ঘটনায় ভারতীয় বিমানবাহিনী রেইড করেছে লাইন অব কন্ট্রোল অতিক্রম করে, দ্বিপক্ষীয় কোনো যুদ্ধ ছাড়া। পাকিস্তানও ভারতের অভ্যন্তরে এক দিন পর হামলা করেছে কয়েকটি টার্গেটে এবং ভূপাতিত করেছে দু’টি ভারতীয় বিমান। একই দিন আরো একটি ভারতীয় হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়েছে কাশ্মিরে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত পাকিস্তান ‘সুবিধাজনক’ অবস্থায় আছে ভারতীয় একজন উইং কমান্ডারকে আটক করে। পৃথিবীর সব শক্তি, এমনকি পাকিস্তানের ‘অল ওয়েদার ফ্রেন্ড’ চীন দুই পক্ষকেই বলেছে শান্ত হতে, রাশ টেনে ধরতে- যাতে পরিস্থিতির আরো অবনতি না হয়। সবার ভয় কাশ্মির এলাকার সীমিত যুদ্ধ না আবার সার্বিক যুদ্ধে রূপ নেয়।

যদি সীমিত পরিসরেও যুদ্ধ আরো ব্যাপ্ত হয় বা অ্যাকশন আর কাউন্টার অ্যাকশন চলতে থাকে; তাহলে কোন দেশ আকাশযুদ্ধে প্রাধান্য বিস্তার করবে, তা নিয়ে অনেকেরই রয়েছে ব্যাপক আগ্রহ। যুদ্ধ অস্ত্র বা সৈন্য গণনা করে যোগ-বিয়োগের কোনো অঙ্ক নয়। এর সাথে বহু কিছুই জড়িত। যা হোক, আমরা অল্প পরিসরে দুই দেশের আকাশযুদ্ধের একটি বিশ্লেষণ দাঁড় করাতে পারি। সন্দেহ নেই, ভারতীয় বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টার ও পরিবহন বিমানের সংখ্যা পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর চেয়ে বেশি। তবে ১৯৬৫ সালে তাদের বিমানের সংখ্যা ছিল পাঁচ গুণেরও বেশি; এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে দেড় গুণে। অর্থাৎ পাকিস্তান ব্যবধান কমিয়ে এনেছে। ভারতীয় বিমানবাহিনীতে রয়েছে ২৪০টিরও অধিক রাশিয়ার তৈরি অত্যাধুনিক মাল্টিরোল ফাইটার এসইউ-৩০ এবং প্রায় ৫৫টি ফ্রান্সের তৈরি মিরাজ-২০০০। এ ছাড়া আছে ব্রিটেনের তৈরি জাগুয়ার, রাশিয়ার তৈরি মিগ-২৯, মিগ-২৭, মিগ-২১ জঙ্গিবিমান। নিজেরা ‘তেজস’ যুদ্ধবিমান তৈরি শুরু করলেও এখনো তা দিয়ে পূর্ণ একটি স্কোয়াড্রন দাঁড় করানো যায়নি।

যুক্তরাষ্ট্র গত কয়েক বছর ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখলেও এ যাবৎ তারা ভারতকে কোনো জঙ্গিবিমান সরবরাহ করেনি। কেবল চিনুক হেলিকপ্টার ও কয়েকটি পরিবহন বিমান দিয়েছে। ভারতের পাইলটরা মেধা ও মননে বিশ্বের মানদণ্ডে কম যান না। তারা অত্যন্ত পেশাদার ও সুপ্রশিক্ষিত। অন্য দিকে, পাকিস্তানের রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি ৭০টির বেশি এফ-১৬ ও ফ্রান্সের তৈরি ১৫০টির মতো মিরাজ-৫ জঙ্গিবিমান। তাদের আছে চীনের তৈরি এফ-৭ ইন্টারসেপ্টর। তবে পাক বিমানবাহিনীর ‘সবচেয়ে বড় অর্জন’ হলো তাদের নিজেদের তৈরি করা জেএফ-১৭ থান্ডার। ইতোমধ্যেই তারা পাকিস্তান অ্যারোনটিক্যাল কমপ্লেক্সে এই বিমানগুলো তৈরি করছে এবং বেশ কয়েকটি স্কোয়াড্রন দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এর সর্বপ্রকার স্পেয়ারপার্টস নিজেরাই তৈরি করে। যুদ্ধাবস্থায় অন্য কোনো দেশের মুখাপেক্ষী তাদের হতে হবে না। এই মাল্টিরোল ফাইটারগুলো কয়েকটি দেশে তারা বিক্রিও করেছেন। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি যে বিমানগুলো ভারতের অভ্যন্তরে হামলা চালিয়ে ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করে, সেগুলো ছিল এই জেএফ-১৭ থান্ডার।

ভারতীয় বিমানের সংখ্যা বেশি হলেও তাদের শুধু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সব বিমান মোতায়েনের কোনো সুযোগ নেই। চীনের সাথে তাদের রয়েছে ৩৩৮০ কিলোমিটার সীমান্ত। অরুণাচল থেকে নিয়ে আকসাই চীন সীমান্ত পর্যন্ত ভারতকে বিভিন্ন বিমানঘাঁটিতে মোতায়েন রাখতে হয় এসইউ-৩০ বহরের বেশির ভাগ যুদ্ধবিমান। অন্য বিমানগুলোও এভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। ভারত চাইলেও চীন সীমান্ত থেকে বিমান সরিয়ে এনে পাকিস্তানি সীমান্তে মোতায়েন করতে পারবে না। অন্তত যুদ্ধাবস্থায় পাকিস্তানের বন্ধু চীন তা হতে দেবে না। অবশ্য বাংলাদেশের আশপাশে যে বিমানগুলো আছে তা তারা সহজেই সরিয়ে পশ্চিম সীমান্তে নিয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু পাকিস্তানের যা বিমান আছে তা আর কোনো দেশকে উদ্দেশ করে মোতায়েন রাখতে হয় না বললেই চলে। যুদ্ধাবস্থায় তার প্রায় পুরো বহরই ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে ভারতের ওপর। সে ক্ষেত্রে হয়তো সংখ্যা দাঁড়িয়ে যাবে প্রায় সমানে সমান। এ ছাড়া এসইউ-৩০ বিমান বহরের সবগুলো এখন উড্ডয়নক্ষম নয়।

আমেরিকার আর্থিক অবরোধের কারণে ভারত কয়েক বছর ধরে রাশিয়া থেকে এই বিমানগুলোর স্পেয়ারপার্টস ক্রয় করতে পারেনি। এ জন্য, অর্ধেকের কাছাকাছি হয়তো গ্রাউন্ডেড হয়ে থাকবে প্রয়োজনীয় মুহূর্তে। মিগ-২১ যুদ্ধবিমানগুলো অনেক পুরনো। ভারত তেজস বিমান দিয়ে সেগুলো ফেসআউটের পরিকল্পনা নিয়েছে। কিন্তু এতে আরো কয়েক বছর লাগবে। কারগিল যুদ্ধে এবং গত ২৭ ফেব্রুয়ারি মিগ-২১ বিমানগুলো পাক বিমানের সামনে দাঁড়াতেই পারেনি। এ ছাড়া রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে আনুষঙ্গিক আরো অনেক দিকে ভারত বেশ অসুবিধাজনক অবস্থায় পড়তে পারে। তারপরও এসইউ-৩০ মাল্টিরোল ফাইটারগুলো সৃষ্টি করতে পারে আতঙ্ক এবং এর পাইলটদের অবজ্ঞা করার কোনো কারণ নেই। অপর দিকে পাকিস্তানিদের বিমানগুলো ‘ব্যাটল রেডি’। তাদের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, তারা প্রায় ১২ বছর যাবত নিজেদের তৈরি বিমান চালিয়ে আসছেন এবং সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে সেগুলো ভালোভাবে ব্যবহার করেছেন।

এফ-১৬ জঙ্গিবিমান পৃথিবীতে যতগুলো দেশ চালায়, তার মধ্যে পাকিস্তানের পাইলটদের অভিজ্ঞতা অনেক বেশি। আফগান যুদ্ধের সময় এই বিমান দিয়ে তারা বেশ ক’টি সোভিয়েত জঙ্গিবিমান ভূপাতিত এবং তাড়িয়ে ভূমিতে নামতে বাধ্য করেছিলেন। করাচির পিএএফ মিউজিয়ামে সেই সোভিয়েত বিমানগুলো সাজিয়ে রাখা আছে। পাকিস্তান হয়তো এসইউ-৩০এর বিরুদ্ধে ও ডিপ পেনিট্রেশনের প্রয়োজন হলে এই এফ-১৬ ব্যবহার করবে। এ ক্ষেত্রে ভারত টেকনিক্যালি থাকবে পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে। তবে ভারতের অন্যান্য বিমানের বিরুদ্ধে তারা জেএফ-১৭ থান্ডারকেই বেছে নেবে প্রতিরোধ বা প্রত্যাঘাত করার জন্য। মিরাজ-৫ যুদ্ধবিমানগুলো পারমাণবিক বোমা বহনে সক্ষম এবং গভীর অভ্যন্তরে অপারেশন পরিচালনার জন্য নির্ধারিত থাকতে পারে। অবশ্য আপগ্রেড করার পরও এগুলো বেশ পুরনো। ভারতের মিরাজ-২০০০ বিমানগুলো পাকিস্তানের বড় মাথাব্যথার কারণ হবে, তা নিশ্চিত।

এ দিকে সীমিত পরিসরে হলেও যদি আকাশযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে বিমান থেকে ছুড়তে সক্ষম বিভিন্ন উচ্চ প্রযুক্তির মিসাইল, বোমা ও ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার যন্ত্রাপাতি নিয়ে ভারতের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারে ইসরাইল। এতে পাকিস্তান পড়তে পারে বেশ বেকায়দায়। আর সে ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সহায়তায় এগিয়ে আসবে চীন, তুরস্ক ছাড়াও কয়েকটি আরব দেশ। এ ছাড়া পাক বিমানবাহিনীর রয়েছে ইসরাইলি বিমান ভূপাতিত করার রেকর্ড। এটিও মনে রাখতে হবে যে, ১৯৭১-এর পর এযাবৎ ভারত কোনো পাক বিমান ভূপাতিত করতে না পারলেও পাকিস্তান বিমানবাহিনী বেশ ক’টি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে আকাশযুদ্ধে। পাকিস্তানিরা বাহরাইন ও জিম্বাবুয়ের বিমানবাহিনী তৈরিতেও মূল ভূমিকা পালন করেছে। আকাশযুদ্ধের ইতিহাস বলে, পাকিস্তানি পাইলটরা অত্যন্ত পেশাদার। কম বিমান নিয়েও তারা বড় প্রতিপক্ষকে সব সময় সাফল্যের সাথে মোকাবেলা করেছে। তাদের অভিজ্ঞতাকে বৃহৎ শক্তিগুলোও সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে থাকে।

বাংলাদেশের সন্তান গ্রুপ ক্যাপ্টেন সাইফুল আজম ও শওকত উল ইসলাম ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে ইসরাইলি বিমান ভূপাতিত করেছেন জর্দান বিমানবাহিনীতে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করার সময়। আরেক বাঙালি এয়ার কমোডর এম এম আলম ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে মাত্র ৩০ সেকেন্ডে পাঁচটি ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করে জেট যুগের রেকর্ড গড়েছেন। এমন পাইলট এখনো পাক বিমানবাহিনীতে আছেন। ভারতের আছে স্কোয়াড্রন লিডার দেবায়ার মতো ‘ডেয়ার ডেভিল’ পাইলট, যিনি ১৯৬৫-এর যুদ্ধে দেখিয়েছিলেন অসামান্য সাহস। এখন দুই দেশ কত দূর যাবে আকাশযুদ্ধে, তা দেখার পালা। আগামী কয়েক দিনে বোঝা যাবে যুদ্ধের ব্যাপ্তি বাড়বে, না স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে? তবে ভারতের পাইলট পাকিস্তানের হাতে আটক হওয়ায় আমরা কি ভারতের ভিন্ন কোনো অ্যাকশনের অপেক্ষা করতে পারি?

লেখক : বাংলাদেশ ডিফেন্স জার্নালের সম্পাদক

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top