পাইলট আটক হওয়ায় বিপদ, এখন কী করবে ভারত?

পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর হাতে ভারতের একজন পাইলট আটক হওয়ার বিষয়কে ঘিরে পারমাণবিক শক্তির অধিকারী দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ভারতের দুটি সামরিক বিমান ভূপাতিত করার দাবি করা হয়। যুদ্ধবিমানের পাইলট আভিনন্দন ভার্থামানের আটক হওয়াকে ভারতের জন্য বড় ধরনের বিপত্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে।

বুধবার পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে ডেকে আটক হওয়া পাইলট আভিনন্দন ভার্থামানকে ফিরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

ভারতের সামাজিক মাধ্যমে বহু মানুষ তাদের প্রার্থনার কথা লিখে জানাচ্ছেন যাতে ওই পাইলট সুস্থ অবস্থায় দেশে ফিরে আসতে পারেন।

পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে ডেকে পাইলট অভিনন্দন ভর্থমানকে ফিরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

পার্সন অব ওয়ার বা যুদ্ধবন্দী কে বা কারা?
জেনেভা কনভেনশন অনুসারে, যখন কোন দেশের যোদ্ধারা বা সৈনিকেরা শত্রু পক্ষের সীমানার ভেতরে বন্দী হন তখন তাদের বলা হয় যুদ্ধবন্দী।

১৯২৯ সালের জেনেভা কনভেনশন ১৯৪৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পরিমার্জিত করা হয় এবং সেখানে যুদ্ধবন্দীদের অধিকার, মর্যাদা, তাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসনসহ, বিভিন্ন বিষয়ে গাইডলাইন সংযুক্ত করা হয় যা জাতিসঙ্ঘ সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে মানবাধিকার রক্ষার্থে অবশ্যই পালন করতে হবে।

তৃতীয় জেনেভা কনভেনশনে যুদ্ধবন্দীদের সাথে আচরণ এবং তাদের রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কিত বিধান রয়েছে।

সংঘর্ষের পরিস্থিতিতে কোনো পক্ষের কোনো বাহিনীর সদস্য যদি অন্য পক্ষের এলাকায় সেখানকার বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে, তবে তাকে যুদ্ধবন্দীর মর্যাদা দিতে হবে।

জেনেভা কনভেনশন অনুসারে, একজন যুদ্ধবন্দী মানবিক অধিকার পাওয়ার অধিকারী।

তৃতীয় জেনেভা কনভেনশনের ১৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, যুদ্ধবন্দীদের কোনো অবস্থাতেই স্বেচ্ছাচারীভাবে হত্যা করা যাবে না, তাহলে সেটা হবে এই কনভেনশনের গুরুতর লঙ্ঘন।৷ যুদ্ধবন্দীরা দুষ্কর্ম, ভীতি প্রদর্শন এবং জন-কৌতূহলের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকারী।

১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে তাদের প্রতি সম্মানজনক আচরণের বিষয়টি উল্লেখ করে বলা হয়েছে , যুদ্ধবন্দীদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক যেকোনো কাজ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, তারা তাদের ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদা অনুযায়ী যথাযথ সম্মান লাভের অধিকারী৷ তাদের সঙ্গে এমন কোনো আচরণ করা যাবে না যা মানবতার পরিপন্থী।

তবে তৃতীয় জেনেভা কনভেনশন এর আর্টিকেল ৪৯-এ বলা আছে- যুদ্ধবন্দীর শারীরিক সক্ষমতা, বয়স লিঙ্গ ইত্যাদি বিবেচনায় তার শ্রমকে আটককারী কর্তৃপক্ষ কাজে লাগাতে পারবে।

নন-কমিশন অফিসাররা যুদ্ধবন্দী হলে সুপারভাইসরি কাজ করতে পারবে।

তাদের মর্যাদা সম্পর্কে আর্টিকেল ৪৫ এ বলা হয়েছে- যুদ্ধবন্দীরা অন্যান্য কর্মকর্তা কিংবা বন্দীদের তুলনায় তাদের র‍্যাংক এবং বয়স বিবেচনায় সম্মান পাবেন।

যুদ্ধবন্দীকে ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়ে কী বলা আছে?
জেনেভা কনভেনশনের আর্টিকেল ১১৮ তে বলা আছে – যুদ্ধবিরতি হওয়ার পর কোনো রকম দেরি না করেই যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি এবং স্বদেশে প্রত্যাবাসন বা ফেরত পাঠাতে হবে।

কিন্তু এভাবে ফেরত পাঠানোর মতো পরিবেশ যদি না থাকে বা দুই পক্ষ কোন যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছাতে না পারে, তাহলে যুদ্ধরত প্রতিটি পক্ষ কোনরকম দেরি না করে ওপরের নীতির আলোকে যুদ্ধবন্দীদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে নিজস্ব একটি পরিকল্পনা তৈরি করে তা বাস্তবায়ন করবে।

যে পদ্ধতি গ্রহণ করা হবে, তা যুদ্ধবন্দীকে জানাতে হবে।

যে দেশ যুদ্ধবন্দীকে ফেরত পাঠাচ্ছে এবং তিনি যে দেশের নাগরিক, উভয় দেশ সমান হারে যুদ্ধবন্দীদের ফেরত পাঠানোর সব খরচ বহন করবে।

সেসব ক্ষেত্রে দুইটি নীতি অনুসরণ করা হবে :

১. যুদ্ধরত দুটি দেশ যদি একই সীমান্ত ব্যবহার করে, তাহলে তাকে আটক করার পর থেকেই যাবতীয় খরচের সমান অংশ দেবে ওই বন্দীর দেশ।

২. যদি উভয় পক্ষের মধ্যে এক সীমান্ত না হয়, তাহলে আটককারী দেশটি ওই বন্দীকে নিজের খরচে তাদের নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডে নিয়ে আসবে, যেখান থেকে থেকে ওই বন্দীর দেশ যতটা সম্ভব কাছাকাছি হবে। যুদ্ধবন্দীদের ফেরত পাঠানোর বাকি খরচ দুই পক্ষ সমানভাবে বহন করতে সম্মত হবে। তবে যুদ্ধবন্দীদের ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা তৈরির কোনো কারণই গ্রহণযোগ্য হবে না।

আর্টিকেল ১১৯ – এ বলা আছে- প্রত্যাবাসন বিষয়ে আর্টিকেল ৪৬ থেকে ৪৮ পর্যন্ত যেসব শর্ত রয়েছে তার অনুরূপ হবে।

যুদ্ধবন্দীদের কারো বিরুদ্ধে ফৌজদারি কোনো অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ থাকলে তার প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তাকে বন্দী অবস্থায় থাকতে হবে। কেউ দোষী বলে প্রমাণিত হয়ে থাকলে তার ক্ষেত্রেও একই বিষয় প্রযোজ্য হবে।

বিচারকার্য শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিংবা শাস্তির মেয়াদ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দুই পক্ষ বন্দীর পক্ষে একে অপরের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখবে। দুই পক্ষের সমঝোতার ভিত্তিতে কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হবে বিচ্ছিন্ন বন্দীদের খুঁজতে এবং তাদের অবিলম্বে প্রত্যাবাসনের উদ্দেশ্যে।

আর্টিকেল ৪৯ এ বলা হয়, আহত কিংবা অসুস্থ বন্দীদের ক্ষেত্রে যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা ভ্রমণের জন্য সুস্থতা অর্জন না করছেন ততক্ষণ তাদের ট্রান্সফার করা যাবে না ।

প্রত্যাবাসনের বিষয়ে ট্রান্সফারের শর্তাবলী প্রযোজ্য হবে এবং এ সম্পর্কে বলা হয়েছে আর্টিকেল ৪৬-এ। যখন আটককারী শক্তি যুদ্ধবন্দীকে ট্রান্সফারের বিষয়ক সিদ্ধান্ত নেবেন, তখন বন্দীদের বক্তব্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবেন যাতে করে তাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আরও জটিল না হয়।

ট্রান্সফার প্রক্রিয়া সবসময় মানবিকভাবে সম্পন্ন করতে হবে এবং যে শর্তের অধীনে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে তা যেন আটককারী কর্তৃপক্ষের দেয়া শর্তের চেয়ে কম অনুকূল না হয়।

ট্রান্সফারের সময় বন্দীর জন্য পর্যাপ্ত খাবার এবং জলসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করতে হবে যাতে সুস্থতা বজায় থাকে। এছাড়া সমুদ্র কিংবা আকাশপথে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে আটককারী শক্তিকে সকর্তমূলক পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে হবে ।

উইং কমান্ডার আভিনন্দনের গ্রেপ্তারের কারণে কার্গিল যুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানের হাতে বন্দী দুই ভারতীয় পাইলটের প্রসঙ্গও উঠে আসছে।

একজন পাইলটকে আটক করার পরেই হত্যা করা হয়, কিন্তু অন্যজন ফ্লাইট লেফটেনান্ট নচিকেতাকে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হয় ভারত। তিনিও উইং কমান্ডার অভিনন্দনের মতোই একটি মিগ বিমান নিয়ে অভিযানে গিয়েছিলেন।

সেই সময়ে পাকিস্তানে ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন জি পার্থসারথি।

তিনি বিবিসিকে বলছিলেন, “গ্রেপ্তারের কিছুদিন পরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের দপ্তর থেকে আমাকে জানানো হয় যে নচিকেতাকে ছেড়ে দেয়া হবে।”

“আমাকে বলা হল জিন্না হলে যেতে, সেখানেই হস্তান্তর করা হবে নচিকেতাকে। ওই জিন্না হলে সাধারণত সংবাদ সম্মেলন হয়ে থাকে। তাই জানতে চেয়েছিলাম যে নচিকেতাকে হস্তান্তর করার সময়ে সংবাদ মাধ্যম উপস্থিত থাকবে কী না। আমাকে বলা হয়েছিল, হ্যাঁ, মিডিয়া থাকবে।”

মি. পার্থসারথি সঙ্গে সঙ্গেই সেই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে বলেছিলেন, একজন যুদ্ধবন্দীকে এভাবে মিডিয়াকে সাক্ষী রেখে হস্তান্তর করা যায় না। দিল্লিতে জানিয়ে দিয়েছিলেন বিষয়টা তিনি।

কোনও যুদ্ধবন্দীর ছবি প্রকাশ করা বা তার হাত বাঁধা অবস্থায় জনসমক্ষে হাজির করা সমরনীতির বিরুদ্ধে। কিন্তু উইং কমান্ডার আভিনন্দনের ক্ষেত্রে সেটাই করা হয়েছে বলে দাবি মি. পার্থসারথির।

সংবাদমাধ্যমের সামনে নচিকেতার হস্তান্তরের প্রস্তাবে না বলে দেয়ার পরে পাকিস্তান সরকার শেষমেশ দূতাবাসে পৌঁছিয়ে দিয়ে গিয়েছিল ওই ফ্লাইট লেফটেনান্টকে।

পরে একটি গাড়িতে করে দুই কর্মকর্তার সঙ্গে ওয়াঘা সীমান্তে পৌঁছিয়ে দেয় ভারতীয় দূতাবাস।

এখন উইং কমান্ডার আভিনন্দনকে কবে কীভাবে মুক্তি দেয় পাকিস্তান – সেদিকেই তাকিয়ে আছেন ভারতীয়রা।
সূত্র : বিবিসি

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top