বিমান ছিনতাইচেষ্টা : রহস্যময় নানা প্রশ্ন

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের দুবাইগামী নিজস্ব উড়োজাহাজ ময়ূরপঙ্খী (বোয়িং-৭৩৭) ছিনতাই চেষ্টার প্রায় ৬০ ঘণ্টা অতিবাহিত হলেও এখনো রহস্যাবৃতই রয়ে গেছে পুরো ঘটনা।

যদিও চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ অবতরণের পরই কমান্ডো অভিযানে কথিত ছিনতাইকারী আটক এবং পরে মারা যায়। তা সত্ত্বেও এ ঘটনার পর ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা বিমানবন্দরের নিবাপত্তা ব্যবস্থা, ছিনতাইকারী এবং তার সাথে থাকা ‘অস্ত্র’ নিয়ে যেসব বক্তব্য মিডিয়াতে দিয়েছেন তা নিয়ে জনমনে ধোয়াশা সৃষ্টি হয়েছে।

অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের মতে, বিমান ছিনতাই চেষ্টার বিষয়টি এই মুহূর্তে শুধু দেশেই নয়, ইন্টারন্যাশনাল ইভেন্ট হয়ে গেছে। এ ঘটনার সাথে দেশের ভাবমর্যাদার বিষয়ও জড়িত। তাই স্পর্শকাতর ঘটনার তদন্ত শেষ হওয়ার আগে দায়িত্বশীলদের ভেবেচিন্তে কথা বলাই উচিত।

চট্টগ্রাম ব্যুরো জানিয়েছে, ঘটনার পর চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রযুক্তি সহকারী দেবব্রত সরকার পতেঙ্গা থানায় মামলা দায়ের করেন। তিনি এজাহারে উল্লেখ করেছেন, ২৪ ফেব্রুয়ারি আমি শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দায়িত্বে ছিলাম। বিকাল ৫টা ৩০ মিনিটের সময় কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে কন্ট্রোলার মনছুর উদ্দিন ও অ্যারোড্রাম সহকারী বাবু শংকর দাশ, ওয়াকিটকির মাধ্যমে জানান, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ৫টা ১৩ মিনিটে ছেড়ে আসা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বোয়িং-৭৩৭, ফ্লাইট বিজি ১৪ উড্ডয়নের ১৫ মিনিট পর অজ্ঞাত এক দুষ্কৃতকারী বোমাসদৃশ বস্তু ও অস্ত্র দেখিয়ে বিমানটি ছিনতাইয়ের চেষ্টা করছে।

এ অবস্থায় বিমানের পাইলট ও এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারের কথোপকথন ইসিআরে স্থাপিত রিসিভারে মনিটরিং করি। ঘটনাটি সংশ্লিষ্টদের ওয়াকিটকির মাধ্যমে অবহিত করি। তখন এয়ারপোর্ট ম্যানেজারের নেতৃত্বে বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় নিয়োজিত সিভিল অ্যাভিয়েশন নিরাপত্তা কর্মী, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নসহ সবাইকে নিয়ে রানওয়ে ও এপ্রোন এলাকায় উপস্থিত হই। বিপদগ্রস্ত উড়োজাহাজটি শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের পরই বিমানের এমারজেন্সি ডোর দিয়ে যাত্রী ও কেবিন ক্রুরা দ্রুত বের হয়ে বিমানের পাখার ওপর অবস্থান করেন। তখন বাংলাদেশ বিমানের জিএসইর (গ্রাউ ন্ড সার্ভিস ইঞ্জিনিয়ার) সদস্যরা দ্রুত বিমানের সিঁড়ি লাগিয়ে তাদের নামিয়ে আনেন। এরই মধ্যে ঘটনাস্থলে বিমানবাহিনীর জহুরুল হক ঘাঁটির অধিনায়ক এয়ার ভাইস মার্শাল মফিজুর রহমানের নেতৃত্বে বিমানবাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো টিম, র্যাব-৭-এর কর্মকর্তারা এবং চট্টগ্রাম পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সিআইডির ক্রাইম সিনের সদস্যরা উপস্থিত হন। অতঃপর সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো টিম আক্রান্ত বিমানটির অভ্যন্তরে অভিযান চালিয়ে অজ্ঞাত এক দুষ্কৃতকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় বিমানের বাইরে এপ্রোনে নামিয়ে আনেন এবং পরে জানা যায়, দুষ্কৃৃতকারী মৃত্যুবরণ করেছে। বিমানে থাকা কেবিন ক্রু সাগর ও বিমানের যাত্রীদের কাছ থেকে জানা যায়, বিমানটি উড্ডয়নের ১৫ মিনিট পর এক অজ্ঞাত দুষ্কৃতকারী বিমানের মাঝখান থেকে দৌড় দিয়ে সামনে বিমানের ককপিটে ঢুকতে চেষ্টা করে।

তার কাছে বোমা ও অস্ত্রসদৃশ বস্তু দেখা যায়। দুষ্কৃৃতকারী তার কিছু দাবি-দাওয়া প্রধানমন্ত্রীকে শুনতে হবে বলে চিৎকার করে বলতে থাকে; অন্যথায় সে বিমানটি বিস্ফোরক দিয়ে ধ্বংস করে দেবে মর্মে বিমানের কেবিন ক্রু ও যাত্রীদের হুমকি দেয়। বিমানের পাইলট, ক্যাবিন ক্রু এবং যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে দুষ্কৃৃতকারী ওই সময় পটকা জাতীয় দু’টি বস্তুর বিস্ফোরণ ঘটায়। এই পরিস্থিতিতে বিমানটি শাহ আমানত বিমানবন্দরে অবতরণ করে। পরে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো টিম পুলিশের কাছে দুষ্কৃতকারীর লাশ হস্তান্তর করলে পতেঙ্গা থানার এসআই (নি:) সুমন দে লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করেন। পরে জানা যায়, দুষ্কৃতকারীর নাম মো: পলাশ আহমেদ (২৮)। পিতা পি আর জাহান, মাতা রেনু আক্তার, নারায়ণগঞ্জ। আসামি বিমানের পাইলট, ক্যাবিন ক্রু ও যাত্রীদের অস্ত্র গোলাবারুদের হুমকি দিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টা করে। আসামি তার সহযোগী অপরাপর অজ্ঞাতা আসামিসহ অপরাধ সংঘটনের চেষ্টা করেছে মর্মে প্রতীয়মাণ হয়। যাত্রীদের নিরাপদে গন্তব্য স্থলে প্রেরণ, বিমান সুষ্ঠুভাবে চলাচল, আবহাওয়াজনিত কারণ এবং মৃত ব্যক্তির পরিচয় নিশ্চিত করতে এজাহারটি দাখিল করতে দেরি হয়েছে বলে বাদি উল্লেখ করেন। মামলা দায়েরের আগেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ঘটনার অনুসন্ধান শুরু করে। পাশাপাশি বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে গঠন করা হয় উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি। এই কমিটি আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেয়ার কথা রয়েছে। পাশাপাশি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পক্ষ থেকে আরো একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

এ দিকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজ ছিনতাই চেষ্টার ঘটনার পর বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী মো: মাহাবুব আলী, সচিব ও সিভিল অ্যাভিয়েশন অথরিটির চেয়ারম্যান ছাড়াও র্যাব এবং সেনা সদর দফতর থেকে আলাদাভাবে বক্তব্য দেয়া হয়েছে। তাদের বক্তব্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে।

গতকাল মঙ্গলবার বিবিসির প্রতিবেদনের এক জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ প্রথমে জানিয়েছিল কথিত হাইজ্যাকারকে আহত অবস্থায় আটক করা হয়েছে এবং তার কাছে অস্ত্র আছে। অন্য দিকে চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে সেনা অভিযানের পরপরই ঢাকায় একটি সংবাদ সম্মেলনে বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ারভাইস মার্শাল নাইম হাসান বলেন, ‘এর মধ্যেই বিমানের পাইলট, কন্ট্রোল টাওয়ারকে জানান, কথিত হাইজ্যাকার তার স্ত্রীর কোনো বিষয় নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলতে চান।’ ‘এক ফাঁকে একজন ক্রু বাদে সব ক্রুই বের হয়ে আসতে পারেন। পরে সেই ক্রুও বের হয়ে আসেন। তখন শুধু কথিত হাইজ্যাকার বিমানে ছিল।’ হাসান সাংবাদিকদের আরো বলেন, ‘কথিত ছিনতাইকারী ব্যক্তিকে আহত অবস্থায় আটক করা হয়েছে। তার কাছে একটি অস্ত্র ছিল এবং বুকে বোমা বাঁধা থাকতে পারে।’ তিনি আরো বলেন, ‘কথিত ছিনতাইকারী পাইলটের মাথায় অস্ত্র ধরে দাবি করেছিলেন, তার স্ত্রীর সাথে সমস্যা নিয়ে তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলতে চান।’

অন্য দিকে এয়ার মার্শাল নাইম হাসান আবার জানান, ‘কথিত ছিনতাইকারীকে খানিকটা মানসিক ভারসাম্যহীন বলে মনে হয়েছে। সাধারণত ছিনতাই ঘটনা যেমনটা দেখা যায় তেমনভাবে সে যাত্রী বা ক্রুদের জিম্মি করার চেষ্টা করেনি।’

গত রাতে অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও রিজেন্ট এয়ারওয়েজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আশীষ রায় চৌধুরীর কাছে ঘটনা প্র্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, ২৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজ বোয়িং ৭৩৭ এ যে ঘটনাটি ঘটেছে তা এখন দেশে নয় বিশ্বে আলোচিত ঘটনা। সাধারণ প্লেন দুর্ঘটনা বা হাইজ্যাকের ঘটনা ঘটলে সেটি ব্যাপক আলোচিত হয়। এ ঘটনার পর বলা হচ্ছে সিকিউরিটি লেপস হয়েছে। এখন এটি কোথায় হয়েছে, কিভাবে হয়েছে সেটি তদন্তের বিষয়। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যেসব স্ক্যানিং মেশিন বসানো হয়েছে সেগুলো খুবই অত্যাধুনিক।

সেখান থেকে ছোট জিনিস গেলেই আওয়াজ করে। কিন্তু পলাশ নামে যাত্রী স্ক্যানিং মেশিন পার হওয়ার পরও আওয়াজ করেনি। এখন এটির জন্য ওয়েট করা উচিত। অভ্যন্তরীণ রুটের যাত্রীদের আন্তর্জাতিক রুটে যাওয়ার আগে এন্টি হাইজ্যাকিং পয়েন্টে তল্লাশি করা হতো আগে। এখন হয় না, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এখন যে স্ক্যানিং মেশিন রয়েছে সেখানে যদি খেলনা পিস্তলও থাকত সেটিও ধরা পড়ত। তবে এসব বিষয় তদন্তের আগে বেশি নাড়াচাড়া করা ঠিক নয় জানিয়ে তিনি বলেন, এখন এই বিষয়টি ইভেন্ট হয়ে গেছে। আমাদের নিরাপত্তাব্যবস্থা আবারো বিদেশীদের প্রশ্নের মুখে পড়েছে। তিনি বলেন, গত মাসে আইকার একটি প্রতিনিধিদল এসে আমাদের বিমানবন্দরের সার্বিক নিরাপত্তাব্যবস্থা দেখে সন্তোষ প্রকাশ করে গেছে। ছিনতাইকারী দৌড়ে ককপিটে ঢুকতে চেয়েছিল, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এ রহস্য জানতে হলে বিমানের ভেতরে ঢুকতেই ককপিটের পেছনে ককপিট ডোর ক্যামেরা লাগানো আছে। সেখানেই ওই ছিনতাইকারীর বর্ণনা পাওয়া যেতে পারে। ঘটনার পর দায়িত্বশীলদের বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অথরিটি যারা রয়েছেন তারা নিজেরাও এ ঘটনায় কনফিউজড। তবে আমি মনে করি, পুরো ঘটনার বিষয়ে একজন স্পোকসম্যান থাকা উচিত। তাহলে কেউ আর বিভ্রান্ত হবে না।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top