দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালগুলোর মধ্যে যেগুলো আইনানুযায়ী আয়-ব্যয়ের হিসেব মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়নি, সেগুলোর বিরুদ্ধে সহসাই ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, বর্তমানে সারা দেশে অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১০৩টি। এর মধ্যে ৯০টি শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করছে। ৩১ ডিসেম্বর-১৮-এর মধ্যে সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিট রিপোর্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু মাত্র ৪১টি বিশ্ববিদ্যালয় অডিট রিপোর্ট জমা দিয়েছে বলে। অন্য ইউনিভার্সিটিগুলো কোনো সময়ও চায়নি।
যারা অডিট রিপোর্ট দেয়নি তাদের সর্তক করে চিঠি দিয়ে জবাব চাওয়া হবে। এরপর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ অনুযায়ী এবার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নতুন শিক্ষামন্ত্রীকে অবহিত করা হবে বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি সূত্র এবং সংশ্লিষ্টরা জানান, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি বছরই শিক্ষার্থী বাড়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আয় ও দুর্নীতি। আইনের শর্তানুসারে অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে রূপ নিতে শুরু করেছে।
আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সলর ও রাষ্ট্রপতির নির্দেশে শিক্ষা মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিলেও তাতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কর্ণপাত করেনি। বরং অভিযোগ রয়েছে, আইন ও বিধিমালার ফাঁক-ফোকর দিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অফ ট্রাস্টির (বিওটি) সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ড থেকে কোটি কোটি টাকা সরিয়ে নিচ্ছেন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এর ৪৫ ধারায় বলা আছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত অডিট ফার্ম দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক বিষয়ে অডিট করাতে হবে। কিন্তু অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ আইনের তোয়াক্কা করছেন না। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরে কোনো অডিট রিপোর্ট মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসি) জমা না দেয়ারও অভিযোগ রয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব (অডিট) আহমদ শামীম আল রাজী বলেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় অডিট রিপোর্ট জমা দেয়নি। এটা খুবই দুঃখজনক। অডিট আরো স্বচ্ছ করতে অডিট ফার্ম ও বিশ্ববিদ্যালগুলোর সাথে আমরা বসব।
মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, নানা কৌশলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের (বিওটি) সদস্যরা কোটি কোটি টাকা সরিয়ে নিচ্ছেন। তারা তাদের অনিয়ম ও দুর্নীতি আড়াল করতে অডিট রিপোর্ট জমা দিতে গড়ি-মসি করছেন। আইনের তোয়াক্কা না করে বিওটি সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ তহবিলের অর্থ সরাচ্ছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে ভুয়া কাগজপত্র ও স্বাক্ষর জাল করে সংরক্ষিত তহবিলের (ফান্ড) বিপরীতে ব্যাংক থেকে তারা ঋণও নিচ্ছেন বলে তথ্য রয়েছে ইউজিসিতে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আট ক্যাটাগরিতে মোট ১২ জন সিন্ডিকেট সদস্য রয়েছেন। মিটিংয়ে উপস্থিত থাকার জন্য একজন সিন্ডিকেট সদস্য মিটিং প্রতি সাড়ে চার লাখ টাকা পর্যন্ত সম্মানী নিয়েছেন।
প্রমোদ ভ্রমণের জন্য অনেক সময় বিদেশেও সিন্ডিকেটের মিটিংয়ের আয়োজন করেন। বিভিন্ন বৈঠকের আয়োজন করে বিওটি সদস্যরা প্রতি বছর সম্মানীর নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। কেনাকাটায়ও চলছে অনিয়ম, দুর্নীতি। নানা কৌশলে কোটি কোটি টাকা সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। ইউজিসির তদন্ত রিপোর্টেও এসব তথ্য উঠে এসেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে গত বছর জমা দেয়া প্রতিবেদনে এসব অভিযোগ তুলে ধরেছে খোদ ইউজিসি।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ৬ ফেব্রুয়ারি-১৮ বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সলর রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বৈঠক করেন ভাইস চ্যান্সলরদের সাথে। বৈঠকের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে তিনি ১৬ দফা নির্দেশনাও দেন। এর মধ্যে আর্থিক স্বচ্ছতা ছিল অন্যতম।
চ্যান্সেলরের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উপসচিব (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) জিন্নাত রেহেনা স্বাক্ষরিত একটি নির্দেশনা জারি করা হয়। তাতে ১৪টি ক্যাটাগিরিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিট করতে বলা হয়েছিল। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উপসচিব মো: রাহেদ হোসেন স্বাক্ষরিত নির্দেশনা সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের কাছে পাঠানো হয়।
তাতে বলা হয়েছিল, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ অনুযায়ী সরকার মনোনীত অডিট ফার্ম দিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিরীক্ষা করে প্রতিবেদন ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসিতে জমা দিতে হবে। প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবে। কিন্তু অর্ধেকের বেশি বিশ্ববিদ্যালয় মন্ত্রণালয়ের ওই নির্দেশনার তোয়াক্কা করেনি।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিওটি সদস্য বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো আর্থিক সুবিধা নিতে পারবেন না। আইনের ৪৫ (২) ধারায় বলা হয়েছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত অডিট ফার্ম দিয়ে প্রতি অর্থবছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব নিরীক্ষা করাতে হবে। প্রতিবেদন পরবর্তী আর্থিক বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ইউজিসি এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে হবে। এ ধারার নির্দেশনা লঙ্ঘন করলে তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা এবং প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ বাতিলের নির্দেশনা আছে।
একই আইনের ৪৯ নম্বর ধারা অনুযায়ী পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান আছে। আইনের ১৪, ২৫ ও ২৬ ধারা অনুযায়ী অর্থ কমিটি গঠন ও পরিচালনা করতে হবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অর্থ কমিটির কোনো সভা করে না। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ করেনি। আবার যেখানে কোষাধ্যক্ষ আছেন, তারা আইনে শর্তানুসারে নিয়োগ প্রাপ্তও নন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মালিকপক্ষের পছন্দের লোক নিয়োগ দেয়া হয়েছে।