ঐতিহাসিকভাবে কাশ্মিরের একটি পরিচয় ছিল ‘প্যারাডাইজ অব আর্থ’। কারো ভাষায় ‘ভূস্বর্গ’। কারণ, এর রয়েছে অনন্য সাধারণ এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। দুর্ভাগ্য, বেশ কয়েক দশক ধরে সেখানে চলছে কাশ্মিরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের লড়াই। আরো স্পষ্ট কথায় স্বাধীনতার লড়াই। উল্টোদিকে চলছে স্বাধীনতাকামী কাশ্মিরিদের ওপর ভারতীয় বিভিন্ন বাহিনীর অব্যাহত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস আর সীমাহীন রক্তপাত। চলছে এক ধরনের গণহত্যা। গোটা কাশ্মিরে মাঝে মধ্যেই উদঘাটিত হচ্ছে নানা গোপন গণকবর। এতে শায়িত আছে হাজার স্বাধীনতাকামী কাশ্মিরিদের রক্তাক্ত লাশ। ফলে কাশ্মির এখন কার্যত একটি রক্তস্নাত প্যারাডাইজ।
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ভারতের কেন্দ্রীয় সশস্ত্র বাহিনীর সবচেয়ে বড় বাহিনী সিআরপিএফ (সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স) কনভয়ে এক আত্মঘাতী হামলায় এই বাহিনীর ৫০ জন প্রাণ হারান। শুধু তাই নয়, এই হামলায় কয়েকটি বাস টুকরো টুকরো হয়ে উড়ে গিয়ে রাস্তাজুড়ে পড়ে থাকে ওই সৈনিকদের ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহাংশের সাথে। যে কাশ্মিরি এই আত্মঘাতী হামলা চালিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, একই সাথে তার দেহটিও এতটাই ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে যে, তাকে চিহ্নিত করার কোনো উপায় নেই।
ওই হামলায় ভারতীয় সৈনিকদের ও হামলাকারীর পরিণতি একই ধরনের হয়েছে। বিয়োগান্তক বিষয়টি হচ্ছে, যে কাশ্মিরি এই আত্মঘাতী হামলা চালিয়েছে সে কাশ্মিরের একটি পরিবারের প্রতিনিধিত্ব করত। আর এ হামলায় যেসব ভারতীয় সৈনিক প্রাণ হারিয়েছেন তারাও ছিলেন ভারতেরই কোনো না কোনো পরিবারের প্রতিনিধি। এরা সবাই মানুষ। এ ঘটনায় কাশ্মির যে আবারো রক্তস্নাত হলো মানুষেরই রক্তে। কাশ্মিরে গত ৭০ বছর ধরে এই ধারাবাহিক রক্তারক্তির ঘটনা ঘটে চলেছে মানুষের রক্তঝরার মধ্য দিয়েই। কিন্তু কাশ্মিরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার নিয়ে যে দ্বন্দ্ব সাত দশক ধরে চলছে, তা নিরসনে ভারতের কোনো সরকারই আন্তরিক পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসেনি। বরং কাশ্মিরকে জবরদখল করে রাখার নানা কূটকৌশলই ভারত সরকার চালিয়ে আসছে বরাবর। একদম শুরু থেকেই কাশ্মির দখলে ভারত এই কূটকৌশল গ্রহণ করেছিল, আজো সে একই কূটকৌশল নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে কাশ্মিরে ভারতের দখল কায়েম রাখার ব্যাপারে।
তাই এরা শুরুতেই কাশ্মিরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার নিশ্চিত করার জন্য কাশ্মিরে গণভোট দেয়ার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে চলেছে। সেই সাথে জিইয়ে রেখেছে কাশ্মির সমস্যাটিকে। আর কাশ্মিরকে জবরদখল করে রাখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে ভারত দেখছে পাকিস্তানকে। ফলে এ নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ পর্যন্ত চলেছে। কিন্তু সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। এবার সর্বসাম্প্রতিক ঘটনায় দেশ ভারত-পাকিস্তান যেন আবারো যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে পরস্পর মুখোমুখি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, কাশ্মির সমস্যার সমাধান যুদ্ধে নয়, প্রতিশ্রুত গণভোটে। এটাই কাশ্মির সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান। সবপক্ষকেই এ বাস্তবতা উপলব্ধি করতে হবে। বিশেষ করে উপলব্ধি করতে হবে কাশ্মিরকে জবরদখল করে রাখা ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু বিগত সাত দশক ধরে সে উপলব্ধি আসেনি কোনো ভারতীয় সরকারের মধ্যে। আর সে জন্যই কাশ্মির রক্তস্নাত হচ্ছে বারবার। এর অবসান চায় ভারত উপমহাদেশসহ বিশ্বের বিবেকবান মানুষ। নতুন কোনো রণসাজ এরা দেখতে চায় না।
কিন্তু আমরা দেখছি, সময়ের সাথে সমস্যাটি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। জম্মু-কাশ্মিরের স্বাধীনতাকামীরা অনেকটা ধৈর্যহারা হয়ে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনে নেমেছে। আর সেই সূত্রে সেখানে থেকে থেকে ঝরছে রক্ত আর রক্ত। গত তিন দশকে ভারতীয় সৈন্যরা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালিয়ে হাজার হাজার কাশ্মিরিকে হত্যা করেছে। আহত করেছে সমধিক। নিখোঁজ করা হয়েছে হাজার হাজার কাশ্মিরি যুবককে। গোপন কবরে মাটিচাপা দেয়া হয়েছে হাজার হাজার কাশ্মিরিকে। নানা কূটকৌশলে পরিবর্তনের চেষ্টা চলেছে জম্মু-কাশ্মিরে জনসংখ্যাচিত্র বা ডেমোগ্রাফি পাল্টে দিতে। কিন্তু কাশ্মিরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার নিশ্চিত করার ব্যাপারে দেয়া গণভোটের প্রতিশ্রুতি ভারতীয় প্রতিটা সরকার একেবারেই মুখে আনছে না। ভুলে যেতে চায় জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাস হওয়া গণভোটের ম্যান্ডেটের প্রস্তাবও। তবে কাশ্মিরিরা বলছে, কাশ্মির কাশ্মিরিদের- ভারতের নয়, পাকিস্তানেরও নয়। উল্টো ভারতের মুখে দখলদারিত্বের উচ্চারণ : কাশ্মির ভারতের। দ্বন্দ্বটা এখানেই।
কাশ্মিরে বিদ্যমান দ্বন্দ্বের সম্যক উপলব্ধির জন্য আমাদের এর পেছনের ইতিহাসের দিকে কিছুটা ফিরে তাকাতে হবে। ইতিহাস বলে- জম্মু ও কাশ্মির ১৮৪৬ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ছিল ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একটি প্রিন্সলি স্টেট, যা শাসন করত রাজপুত ডুগরা রাজারা। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে নামেমাত্র সার্বভৌম স্টেটগুলোকে বলা হতো প্রিন্সলি স্টেট বা ন্যাটিভ স্টেট। ১৮৪৬ সালে প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধের পর জম্মু ও কাশ্মির স্টেট গঠন করা হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এর সাথে কাশ্মির উপত্যকাকে সংযুক্ত করে গোলাব সিংয়ের কাছে হস্তান্তর করেন ৭৫ লাখ রুপির ইনডেমনিটি পরিশোধের বিনিময়ে। ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান স্বাধীন হয়। তখন এই রাজ্যে মুসলমানেরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু এই স্টেট ছিল অমুসলিম মহারাজা হরি সিংয়ের শাসনাধীনে।
তখন প্রশ্ন দেখা দেয় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই জম্মু ও কাশ্মির কার পক্ষে যোগ দেবেÑ পাকিস্তানের পক্ষে, না ভারতের, না এই দুই দেশের কোনোটির সাথে সংযুক্ত না হয়ে নিরপেক্ষ স্বাধীন কাশ্মির রাষ্ট্র গঠন করবে? এ নিয়ে নানা বিশৃঙ্খলা চলার মধ্য দিয়েই মহারাজা হরি সিং সামরিক সহায়তার বিনিময়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই রাজ্যকে ভারতীয় ডোমিনিয়নে যোগ দেয়ার চুক্তি স্বাক্ষর করে ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর। এ নিয়ে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই রাজ্যের পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর নিয়ন্ত্রণ চলে যায় পাকিস্তানের হাতে, যা আজ আজাদ কাশ্মির ও গিলগিটস্তান নামে পরিচিত। একাংশ চলে যায় ভারতের নিয়ন্ত্রণে, যা ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মির নামে পরিচিত। উল্লেখ্য, কাশ্মিরের ২০ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে চীনের হাতে, যা আকসাই চীন নামেও পরিচিত।
আজ ভারত বলছে, কাশ্মির ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কাশ্মিরিরা বলছে, কাশ্মির কাশ্মিরিদের। কাশ্মির সমস্যার একমাত্র সমাধান এর আজাদি। ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর মতে, কাশ্মিরে বর্তমানে অবস্থান করছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাত লাখেরও বেশি সদস্য। বলা হচ্ছে, ভারতীয় সেনাবাহিনী কার্যত কাশ্মিরে বিবেচিত এক দখলদার সেনাবাহিনী হিসেবে, যাদের সাথে কাশ্মিরিদের ন্যূনতম সম্পর্ক নেই। এএফএসপিএ (আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ারস অ্যাক্ট) এবং পিএসএ (পাবলিক সেফটি অ্যাক্ট)-এর মতো ড্রাকোনিয়ান আইন ব্যবহার করা হচ্ছে কাশ্মিরিদের নির্যাতনে। এই আইনগুলোকে তুলনা করা হয় ব্রিটিশ ভারতের কুখ্যাত রাওলাট অ্যাক্টের সাথে, যে আইনটি বিলোপের দাবি ছিল গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে। আর আজ এরই মতো কুখ্যাত এএফএসপিএ এবং পিএসএ ব্যবহার হচ্ছে কাশ্মিরিদের আজাদি আন্দোলন ঠেকানোর লক্ষ্যে।
ভারতের বরাবরের দাবি ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মির ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভারতের এই দাবিকে অসার প্রমাণ করে জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যের হাইকোর্ট ২০১৬ সালের এপ্রিলে রায় দিয়েছেন- জম্মু ও কাশ্মির কখনোই ভারতের অংশ ছিল না এবং এখনো এর অংশ নয়। এই রায়ে আদালত বলেছেন, ভারতের সংবিধানেও জম্মু ও কাশ্মিরকে সীমিত সার্বভৌম ভূখণ্ডের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। বিচারপতি হাসনাইন মাসুদি ও বিচারপতি জনকরাজ কোতয়ালের ডিভিশন বেঞ্চ এই রায় দিয়েছেন। এই দুই বিচারপতির দেয়া ৬০ পৃষ্ঠার এই রায়ে বলা হয়েছে, ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদে এই রাজ্যকে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছে; যা সংশোধন, বাতিল বা রদ করা যাবে না।
আদালত বলেছেন, সংবিধানের ৩৫ক অনুচ্ছেদে বিদ্যমান আইনে কাশ্মিরকে সুরক্ষা দেয়া হয়েছে। সংবিধানে ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদকে অস্থায়ী বিধান হিসেবে উল্লেখ করা হলেও একবিংশ ধারায় এটিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ধারা সংবিধানে, ৩৭০ নম্বর ধারাকে ‘স্থায়ী, অপরিবর্তনশীল বিশেষ বিধান’ নামে স্থায়ী স্থান করে নিয়েছে। আইনসভায় এটি সংশোধন, বাতিল বা রদ করা যাবে না। ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদটি সংবিধানের মাধ্যমে ‘সংশোধন বাতিল বা রদের অযোগ্য’ বলে ঘোষণা থাকলেও ভারতীয় জনতা পার্টি তথা বিজেপি এই অনুচ্ছেদটি বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে।
অপর দিকে ১৯৪৭ সালে হরি সিংয়ের সাথে যোগসাজশ করে কাশ্মির দখল করার পর ২৭ অক্টোবর জওয়াহের লাল নেহরু ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো টেলিগ্রামে লিখেছিলেন : “I should like to make it clear that the question of aiding Kashmir in this emergency is not designed in any way to influence the state to accede to India. Our view which we have repeatedly made public is that the question of accession in any disputed territory or state must be decided in accordance with wishes of people and we adhere to this view.” (Telegram 402 Primin-2227, dated 27th October,1947 to PM of Pakistan repeating telegram addressed to PM of UK).
এ ছাড়া এর চার দিন পর ৩১ অক্টোবর তিনি আরেকটি টেলিগ্রাম পাঠান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খানের কাছে, যাতে তিনি উল্লেখ করেন : “Kashmir’s accession to India was accepted by us at the request of the Maharaja’s government and the most numerously representative popular organization in the state which is predominantly Muslim. Even then it was accepted on condition that as soon as law and order had been restored, the people of Kashmir would decide the question of accession. It is open to them to accede to either Dominion (India or Pakistan) then.”
কিন্তু সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো, এই দু’টি টেলিগ্রামেই নেহরু কাশ্মিরের জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী তাদের পাকিস্তান বা ভারতে অন্তর্ভুক্তির সুযোগ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বাস্তবে তা তিনি সে প্রতিশ্রুতি পালন করেননি। সে প্রতিশ্রুতি তিনি ও তার দেশ শতভাগ ভঙ্গ করেছে। বরং তা না করে তিনি আরো দু’টি প্রিন্সলি স্টেট হায়দ্রাবাদ ও জুনাগড় দখল করতে সেখানে ভারতীয় সৈন্য পাঠিয়েছিলেন। অথচ এই দু’টি রাজ্য পাকিস্তানের সাথে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সে ইতিহাস কারো অজানা নয়।
এভাবেই কাাশ্মির সমস্যাটি ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বে পরিণত হয়ে আন্তর্জাতিক বিষয়ে রূপ নেয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নানা ট্রিট্রিজ ও অ্যাগ্রিমেন্ট স্বাক্ষরিত হওয়ার বিষয়টি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তা না হলে দেশে-দেশে দ্বন্দ্ব সূত্রে দেখা দিত শুধু যুদ্ধ আর যুদ্ধ। ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বের সূত্রে এই দুই দেশের মধ্যে দু’টি উল্লেখযোগ্য চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়। একটি ১৯৬৬ সালে তাসখন্দ চুক্তি, অপরটি ১৯৭২ সালে সিমলা চুক্তি। দু’টি চুক্তিই ছিল দেশ দু’টির মধ্য হয়ে যাওয়া ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ এবং ১৯৭১ সালের যুদ্ধের তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ফলোআপ। এ ছাড়া ১৯৯৯ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি দেশ দু’টি স্বাক্ষর করে ‘লাহোর ঘোষণা’। এ ঘোষণায় স্বাক্ষর করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটরবিহারি বাজপেয়ি এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। এটি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ১৯৯৯ সালের মে-জুলাই মাসে দেশ দু’টির মধ্যে যুদ্ধ চলে। লাহোর ঘোষণার পর বাজপেয়ি চালু করেছিলেন লাহোর-দিল্লি বাস সার্ভিস। এ ক্ষেত্রে লাহোর ঘোষণাকে ভারত-পাকিস্তান বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে দেখা হয়। এমনকি নওয়াজ শরিফ তখন বলেছিলেন বাজপেয়ি পাকিস্তানে নির্বাচন করলেও বিজয়ী হবেন। বলা হয় বাজপেয়ির বাস ডিপ্লোম্যাসি ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ‘পিপল-টু-পিপল’ যোগাযোগের ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু এসব কিছুই কাশ্মির সমস্যার শান্তিপূর্ণ কোনো সমাধান দিতে পারেনি। কাশ্মিরের গণভোটের প্রতিশ্রুতি অধরাই থেকে যায় কাশ্মিরিদের জন্য। কারণ ভারত গণভোটের প্রতিশ্রুতি থেকে বরাবর সরে থেকেছে।
কাশ্মিরের রাজনীতিতে শেখ আবদুল্লাহ পরিচিত ছিলেন শের-এ-কাশ্মির নামে। এই জননেতাকে ১৯৫৩ সালে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় কাশ্মিরের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে। সুদীর্ঘ ২২ বছর তিনি ছিলেন ক্ষমতার বাইরে। তিনি বরাবর ছিলেন জম্মু-কাশ্মিরে জাতিসঙ্ঘের ম্যান্ডেটের গণভোট আদায়ের দাবির অনড় সমর্থক। এজন্য তাকে কারাগারে যেতে হয়েছে। কারাগারের ভেতরে কিংবা বাইরে তিনি এই দাবি থেকে এক পা সরে আসেননি। তিনি ছিলেন কাশ্মিরের গণভোট আন্দোলনের অন্যতম প্রেরণাপুরুষ। এরপর ১৯৭৫ সালে অবশ্য তিনি ক্ষমতায় ফিরে আসেন কাশ্মিরের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে। সে আরেক সুদীর্ঘ ইতিহাস।
আমরা জানি, ১৯৪৮ সালে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ একটি প্রস্তাব পাস করে জম্মু ও কশ্মিরের মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার নিশ্চিত করার ব্যাপারে গণভোট অনুষ্ঠানের ম্যান্ডেট দেয়। বলা হয়, এই গণভোটের মাধ্যমেই কাশ্মিরের মানুষের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে। ১৯৫৫ সাল থেকে শুরু করে দুই দশক ধরে কাশ্মিরের জনগণ একটি সংগঠনের মাধ্যমে জাতিসঙ্ঘের দিকে তাকিয়েছিল জাতিসঙ্ঘের ম্যান্ডেটের এই গণভোট অনুষ্ঠানের দিকে। এক পর্যায়ে মনে হলো এই গণভোট সমাসন্ন। কারণ, জাতিসঙ্ঘের ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কিত কমিশনের তথ্য-কর্মকর্তা এমডি ক্যাপাইট ১৯৪৯ সালের ২৫ এপ্রিলে একটি চিঠি লেখেন ভারত সরকারের ডেপুটি প্রিন্সিপাল ইনফরমেশন অফিসার এমএল বড়দোয়াজের কাছে। চিঠিতে জানতে চাওয়া হয়, কাশ্মিরে গণভোট অনুষ্ঠানের জন্য রেডিও স্টেশন, কমিউনিটি রিসিভিং সেট, সাউন্ড ট্রাক, প্রচারপত্র ও পোস্টার ছাপার মতো সুবিধা এবং ১৬ মি.মি. ও ৩৫ মি.মি. ফিল্ম প্রজেক্টর ইত্যাদি আনুষঙ্গিক সুবিধা ভারতে আছে কিনা। এমডি ক্যাপাইট কয়েক বছর পর এক ব্যাখ্যায় জানান গণভোটের সময় ভারত ও পাকিস্তান কাশ্মির থেকে সশস্ত্র বাহিনী প্রত্যাহার না করার ব্যাপারে অনড় থাকার কারণে জাতিসঙ্ঘের ম্যান্ডেটের গণভোট অনুষ্ঠানের পথটি বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৫৩ সালে শেখ আবদুল্লাহ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে গণভোট আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তারই সহকর্মী মির্জা মোহাম্মদ আসলাম বেগ। এই আন্দোলন প্রক্রিয়ায় হাজার হাজার কাশ্মিরি গ্রেফতার, গুম, খুন, জেল-জুলমের শিকার হন। অনেকের পরিবার বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গেছে। ভারতীয় জওয়ানদের ধর্ষণের শিকার হয়েছে কাশ্মিরের অনেক নারী। কিন্তু কাশ্মিরের জনগণ সব ধরনের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস উপেক্ষা করেও তাদের স্বাধীনতার দাবির প্রতি কোনো আপস করেনি। তাদের মুখে এখনো সরব স্লোগান : ‘রাজ শুমারি পূরণ করো’- ‘বাস্তবায়ন করো গণভোট’। এরা আরো বলছে : যে কাশ্মিরে আমরা রক্ত ঝরিয়েছি, সে কাশ্মির আমাদের’ (জিস কাশ্মির কো খুন সে সেঁচা, ও কাশ্মির হামারা হে); ‘এ দেশ আমাদের, এর ফয়সালা আমরাই করব’(এ মুলক হামারা হে, ইসকা ফয়সালা হাম করেঙ্গা)।
কিন্তু ভারত কাশ্মিরে গণভোট দেবে না, এই সিদ্ধান্তেই যেন অনড়। ফলে দশকের পর দশক ধরে কাশ্মির রক্তস্নাত হচ্ছে মানবরক্তে। আজ সময় এসেছে জানার- এর শেষ কোথায়, ভারত কি কাশ্মিরের মানুষের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণে কখনোই ইতিবাচক সাড়া দেবে না? আয়োজন করবে না কি সেই প্রতিশ্রুত গণভোট? সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে, কাশ্মির সমস্যার সমাধানের হাতিয়ার একমাত্র কাশ্মিরিদের হাতে। যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে এর কোনো সমাধান আনা যাবে না। কারণ, স্বাধীনতার দাবির সাথে কোনো জাতিই আপস করে না, করারও নয়।