শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্যে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে ৪৪ কোটি টাকা

মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে, মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগের দাবি ও প্রয়োজনীয়তার কথা বলে আসছেন শিক্ষাবিদ ও সংশ্লিষ্টরা; কিন্তু দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা ৯০ শতাংশের বেশি পরিচালিত হচ্ছে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়। বেসরকারি স্কুল-কলেজ-মাদরাসা-কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের নিয়ন্ত্রক ছিল প্রতিষ্ঠানগুলোর গভর্নিং গডি বা ম্যানেজিং কমিটি। এসব কমিটির বিরুদ্ধে টাকার বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগের অভিযোগ ছিল অহরহ।

এখন একই অভিযোগ উঠছে, বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) বিরুদ্ধে। তারা (এনটিআরসিএ) আইন সংশোধনের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের কর্তৃত্ব পেয়ে প্রথমবারেই এবার বেকার শিক্ষকদের পকেট থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন ৪৪ কোটি টাকা।

সচিবালয় সাংবাদিকদের এক কর্মশালায় প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের সাবেক মুখ্য সচিব ও বর্তমানে এসডিজি বাস্তবায়ন সেলের মুখ্য সমন্বয়ক সচিব আবুল কালাম আযাদ বলেছেন, সরকারি চাকরিতে নিয়োগের জন্য আবেদনকারীদের কাছ থেকে কোনো ধরনের ফি না নেয়ার চিন্তা করছে সরকার।

সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের সুবিবেচনাপ্রসূত চিন্তা-ভাবনার মধ্যেই সরকারের একটি প্রতিষ্ঠান এনটিআরসিএ বেকার শিক্ষকদের কাছ থেকে কিভাবে আবেদন খাতেই কোটি টাকা হাতিয়ে নিল তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আবেদন করেও নিয়োগে সুপারিশ না পাওয়া শিক্ষকেরা।

তারা অভিযোগ করেন, এনটিআরসিএ এখন নতুন করে নিয়োগবাণিজ্যে নেমেছে। বেকার শিক্ষকদের চাকরি দেয়ার নাম করে আবেদনের নামে তুলে নিল কোটি টাকা।

তারা বলেন, নিবন্ধন পরীক্ষার সময়ও একইভাবে এনটিআরসিএ পরীক্ষা গ্রহণের নামে ফি আদায় করেছিল। এখন চাকরি দেয়ার নাম করে আরেক দফায় টাকা হাতিয়ে নিল। সুপারিশ বঞ্চিতরা প্রশ্ন তুলে নয়া দিগন্তকে বলেন, এনটিআরসিএ’র এ ধরনের ফি নির্ধারণ ও অর্থ আদায়ের বৈধতা রয়েছে কি না? তাদের এ ধরনের অনৈতিক আয়ের হিসাব বা এর স্বচ্ছতা কোথায়?

সুপারিশ বঞ্চিত শিক্ষকেরা অভিযোগ করেন, এনটিআরসিএ এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর গভর্নিং বডি বা ম্যানেজিং কমিটির মতোই নিয়োগবাণিজ্যে নেমেছে। গভর্নিং কমিটিকে টাকা দিলেও চাকরির নিশ্চয়তা ছিল, এনটিআরসিএতে টাকা নিয়েও চাকরির জন্য সুপারিশটুকুও করতে পারা যায় না।

এনটিআরসিএ অন-লাইনে আবেদন করা শিক্ষকদের ১৮৬টি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৩৯ হাজার ৫৩৫টি পদে নিয়োগের সুপারিশ করলেও গতকাল পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজারের উপরে শিক্ষক নিয়োগ পাচ্ছেন না সুপারিশকৃত স্কুল বা কলেজে। গতকাল ২৩ ফেব্রুয়ারি শেষ হয়েছে প্রথম দফায় আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সুপারিশকৃতদের প্রতিষ্ঠানে যোগদানের সময়সীমা। এনটিআরসিএতে লিখিত অভিযোগ করলেও তাদের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট সমাধান দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ শিক্ষকদের।

এ দিকে,  ‍সুপারিশকৃত শিক্ষকদের নিয়োগের ফয়সালা না করেই এনসিটিআরসিএ আগামী মার্চে নতুন করে সার্কুলার জারির কথা জানিয়েছেন এনটিআরসিএর চেয়ারম্যান এস এম আশফাক হুসেন।

তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রথম দফায় সুপারিশপ্রাপ্তদের নিয়োগের জন্য সময় বাড়ানো হবে না। শিক্ষকদের নিয়োগের যেসব প্রতিষ্ঠান বাধা সৃষ্টি করছে, তাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব এনটিআরসিএর নয়। এনটিআরসিএ শুধু শিক্ষক নিয়োগের দায়িত্ব পালন করছে মাত্র।

এনটিআরসিএ সূত্র এবং প্রথম দফায় আবেদনকারী অর্ধ ডজন শিক্ষকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, আবেদনে প্রতিষ্ঠান বাছাইয়ের সুযোগ ছিল। তাই একজন প্রার্থীকে একাধিক প্রতিষ্ঠানে আবেদন করতে হয়েছে। তিনি ১৪টি প্রতিষ্ঠানে আবেদন করেছেন। প্রতিটির জন্য ১৮০ টাকা করে দিতে হয়েছে তাকে। বিসিএস বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে বিষয় পছন্দের মতো ব্যবস্থা করা হলে বেকারদের অনেক টাকা সাশ্রয় হতো।

দুই বছর আগে নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি পেয়ে এবং চাকরি পাওয়ার প্রত্যাশায় অনেকেই ১৫-২০টি করে আবেদন করেছেন। এভাবে এনটিআরসিএর গণবিজ্ঞপ্তিতে ৩৯ হাজার ৫৩৫টি পদের বিপরীতে ২৫ লাখ ৭৯ হাজার ১৯৬টি আবেদন জমা পড়ে নিবন্ধিত শিক্ষকদের। প্রতি আসনের বিপরীতে ৭৮টি করে আবেদন জমা পড়ে।

জানা গেছে, প্রথমবারের মতো আবেদন থেকে এনটিআরসিএর আয় হয়েছে ৪৪ কোটি টাকা। বর্তমান সরকারের অঙ্গীকার অনুসারে সরকারি চাকরিতে আবেদনের জন্য আবেদনকারীকে কোনো ফি দিতে হবে না। কিন্তু বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য আবেদনকারী শিক্ষকেরা নিয়োগ পেলে তাদের বেতন সরকারি কোষাগার থেকেই দেয়া হবে। অর্থাৎ তারা এমপিওভুক্ত হবেন। এমপিওভুক্তি বা বেতনের সরকারি অংশ বা মান্থলি পে-অর্ডার প্রাপ্তরা প্রকারান্তরে সরকারি চাকুরে।

এর পরেও অনেক আবেদনকারী সুপারিশ না পেয়ে হতাশ হয়েছেন। আরেক আবেদনকারী অভিযোগ করেন, তিনি ২৮টি প্রতিষ্ঠানে আবেদন করে একটিতেও সুপারিশপ্রাপ্ত হননি। অনেক শিক্ষক নিবন্ধিত হয়ে বছরের পর বছর অপেক্ষায় ছিলেন। গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে আবেদন গ্রহণ করায় অনেকে নিজস্ব জমা ও ঋণ নিয়েও আবেদন করেছেন। কিন্তু সুপারিশ না পেয়ে হতাশ তারা। এ অবস্থায় নতুন করে আবেদন গ্রহণ করা হলে, সেখানে কী করে আবেদন করবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় এ সব শিক্ষক। কারণ তাদের শঙ্কা আবার আবেদন করে সুপারিশ না পেলে তো সবই গেল।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top