আতঙ্ক কাটছে না চুড়িহাট্টায়

চুড়িহাট্টা মোড় এখন অনেকটা শান্ত ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। রাস্তায় নেই ধ্বংসস্তূপ। নেই যানজটের জটলা। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু মানুষ জড়ো হয়ে থাকা ছাড়া সেখানে নেই নিত্যদিনের কোলাহলও। মাত্র তিন দিন আগে ওই মোড়ে ঘটে যাওয়া বিভৎসতার পর গতকাল শনিবার এমন দৃশ্যই দেখা গেছে।

অগ্নিঝড়টা থেমে গেছে, কিন্তু রয়ে গেছে তার ধ্বংসাবশেষ। আগুনে পুড়ে পাল্টে গেছে চিরচেনা ভবনগুলোর চিত্র। রাস্তার দুই পাশে বিভীষিকার ক্ষত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কয়েকটি ভবন। চুড়িহাট্টা এখন অনেকটাই ভুতুড়ে এলাকা। সে দিনের আগুনের বিভীষিকা যেন পিছু ছাড়ছে না বাসিন্দাদের।

অগ্নিকাণ্ডের সময় যারা জীবন বাঁচাতে পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেছেন অন্যত্র, তাদের কেউ কেউ ফিরলেও আতঙ্ক এখনো তাড়িয়ে বেড়ায় তাদের। একটা অজানা আতঙ্ক, ভয় কাজ করছে তাদের মনে। ভয়ে কেউ কেউ ঘুমাতে পারছে না। শিশুরা আতঙ্কে বাবা-মায়ের পিছ ছাড়ছে না।

এদিকে আগুনে পোড়া ধ্বংসস্তূপ দেখতে চকবাজারে ভিড় করছেন উৎসুক জনতা। ধ্বংসস্তূপের সর্বশেষ চিত্র দেখতে দূর-দূরান্ত থেকেও ঘটনাস্থলে ভিড় জমাচ্ছেন লোকজন। কেউ আবার খুঁজছেন প্রিয়জনের অস্তিত্ব। ফলে মানুষের চাপ নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। ব্যাহত হচ্ছে ফায়ার সার্ভিসের কার্যক্রম।

এছাড়া গতকাল আরো দুইজনের লাশ শনাক্ত করে নিয়ে গেছে স্বজনেরা। এ নিয়ে ৪৮টি লাশ শনাক্ত করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছে ঢাকা জেলা প্রশাসন। গতকালও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) দু’টি টিম ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করেছে। রাতে এ খবর লেখা পর্যন্ত ১৯টি লাশের বিপরীতে ৩২ স্বজনের ডিএনএ নমুনা নিয়েছে সিআইডি।

চুড়িহাট্টার নন্দকুমার দত্ত লেনের পাশে হায়দার বখশ লেনের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন জানান, চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদের পাশেই তার বাসা। আগুন লাগার পর ভবনের আর সব বাসিন্দাদের সঙ্গে প্রাণ বাঁচাতে তিনিও সপরিবারে ছুটে ছিলেন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। দৌড়াতে গিয়ে আহত হন তার স্ত্রী মুনিরা বেগম। তিনি বলেন, চোখে এখনো ভাসছে ভয়াল সেই রাতের দৃশ্য। আমরা এখনো ঘুমাতে পারি না। চোখ বন্ধ করলেই মানুষের চিৎকার, আগুনের লেলিহান শিখা আর হুড়োহুড়ির দৃশ্য ভেসে ওঠে।

ভয়াল আগুনের গ্রাস থেকে রক্ষা পাওয়া সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ওই দিনের দৃশ্য মনে পড়লেই গা শিউরে ওঠে। আমি মোটরসাইকেলে ছেলে শাফিনকে পিছনে নিয়ে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলাম। যখন মোটরসাইকেল নিয়ে ওয়াহেদ ম্যানসনের পশ্চিম পাশের রাস্তায় জ্যামে বসে আছি। তখনি হঠাৎ ওই ম্যানসনের সামনের সাইড অর্থাৎ উত্তর পাশ থেকে একটি বিকট শব্দে আগুনের ঘোলা উপরে উঠছিল। মুহূর্তে চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। আমি ছেলেকে নিয়ে দ্রুত পশ্চিম পাশের রাস্তা দিয়ে দৌড়াতে থাকি। আর শুনতে থাকি একটার পর একটা বিকট শব্দ। কিছু দূর গিয়ে পেছনে ফিরে দেখি শুধু অন্ধকার আর আগুন। তিনি জানান, এ ঘটনায় তার ছেলে আহত হয়েছে। ঘটনার পর থেকেই ছেলেটি আতঙ্কের মধ্যে থাকে, ভয় পায়।

মঈন উদ্দিন নামে এক বাসিন্দা জানান, আগুন লাগার পর থেকে পরিবারের সবাইকে নিয়ে বাড়ির পেছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন ওই রাতে। তার বাড়ির অর্ধেক ভাড়াটিয়া ফিরে এলেও অন্যরা আতঙ্কে ফিরছেন না বলে জানান তিনি। তাদেরকে সাহস দিচ্ছি যে কিছু আর হবে না, কিন্তু তারা ভরসা পাচ্ছে না বলে জানান তিনি।

স্থানীয় মুদি দোকানি লিটন জানান, হঠাৎ বিস্ফোরণের বিকট শব্দ। একটু পরে জোরে জোরে আওয়াজ আর বিস্ফোরণ। চারপাশে আগুন আর আগুন। আমার দোকান তখন খোলা ছিল। ওই অবস্থায় রেখেই দৌড় দিয়ে চলে যাই। তিনি বলেন, এমন ঘটনা আমি আর কখনো দেখিনি। রাতে দুই চোখের পাতা এক করলে আগুনের দৃশ্য ভেসে ওঠে। ভয় হয় তখন। যদি আবার ঘুমের মধ্যে এমন ভয়াবহ ঘটনা ঘটে।

আরো দু’জনের লাশ শনাক্ত : চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডে নিহত আরো দুই জনের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে। এক জনের নাম আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। তার লাশ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে ছিল। স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করতে লাশটি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মর্গে আনা হয়েছিল।

মঞ্জুর ছোট ভাই মাইনুল হোসেন বলেন, আমরা সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে গিয়েছিলাম। সেখানে পাঁচটি লাশ রয়েছে। চেহারা দেখে শনাক্ত করার উপায় ছিল না। মঞ্জুর পরনের ট্রাউজার ও শার্ট দেখে আমরা তাকে শনাক্ত করেছি। এ ছাড়া মোহাম্মদ জাফর আহমদ নামে একজনের লাশ শনাক্ত করে তার ছেলে রাজু ও ভাই নাসির উদ্দিন। গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতাল মর্গ থেকে স্বজনদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়। লাশটি মিডফোর্ট হাসপাতাল মর্গে ছিল। নিহতের বাড়ি নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীর মির্জানগরে। সেখানে লাশ দাফন করা হবে। এর মধ্য দিয়ে ৪৮ জনের লাশ হস্তান্তর সম্পন্ন হলো। প্রত্যেক নিহতের পরিবারকে তাৎক্ষণিকভাবে ২০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দেয় ঢাকা জেলা প্রশাসন।

যাদের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে তারা হলেন, কামাল হোসেন (৪০), অসি উদ্দিন (২৩), মোশাররফ হোসেন (৩৪), হাফেজ কাওছার আহমদ (২৬), আলী হোসেন (৬৫), ইয়াছিন (৩৩), শাহাদাৎ হোসেন (৩০), আবু বক্কর সিদ্দিক (২৭), জুম্মন (৫২), মজিবুর হাওলাদার (৫০), হেলাল উদ্দিন (৩২), আশরাফুল হক (২৭), ইমতিয়াজ ইমরোজ রাসু (২২), মো: সিদ্দিক উল্লাহ (৪৫), মাসুদ রানা (৩৫), আবু রায়হান (৩১), আরাফাত আলী (৩), মো: আলী (২২), মাহবুবুর রহমান রাজু (২৯), এনামুল হক কাজী (২৮), সিয়াম আরাফাত (১৯), ওমর ফারুক (৩০), সৈয়দ খবির উদ্দিন (৩৮), আয়েশা খাতুন (৪৫), নয়ন খান (২৫), আব্দুর রহিম (৫১), জসিম উদ্দিন (২২), জহির (৩), মিঠু (৩৮), সোনিয়া আকতার (২৮), বিল্লাল হোসেন (৪৭), ইসহাক ব্যাপারী (৩০), ইব্রাহিম (৩০), সুজন হক (৫৩), শামসুল হক (৬৮), পারভেজ (১৮), খোরশেদ আলম (২২), রাজু (১৮), সজীব (৩০), জয়নাল আবেদীন (৫৫), আনোয়ার হোসেন (২৮), নাসির উদ্দিন (২২), আনোয়ার হোসেন (৩৫), শাহাদাত উল্লাহ হীরা (৩৩), সাইফুল ইসলাম (৩৪) ও সোলাইমান (২২)।

চিকিৎসাধীন ১১ জনের অবস্থা : ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও বার্ন ইউনিটে যে ১১ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন তারা কেউ আশঙ্কামুক্ত নয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। গতকাল বিকেলে বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক ডা: সামন্ত লাল সেন এই আশঙ্কার কথা জানান।

তিনি বলেন, তাদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। বার্ন ইউনিটের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) ৯ জনকে রাখা হয়েছে। অপর দিকে হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি বিভাগে চিকিৎসাধীন রয়েছেন দু’জন।

আইসিইউতে চিকিৎসাধীনদের মধ্যে আনোয়ার হোসেনের শরীরের ২৮ শতাংশ, মাহমুদুল হাসানের ১৩ শতাংশ, রেজাউলের ৪৩ শতাংশ, সোহাগের ৬০ শতাংশ, জাকিরের ৩৫ শতাংশ, মোজাফফরের ৩০ শতাংশ, হেলালের ১৬ শতাংশ, সেলিমের ১৪ শতাংশ এবং সালাউদ্দিনের শরীরের ২০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। তাদের সবারই শ্বাসনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া ক্যাজুয়ালটি বিভাগে চিকিৎসাধীন রয়েছেন রবিউল (২৮) ও কাওছার (৩৫)। রবিউল ওয়ানস্টপ আইসিইউতে আর কাওছার অর্থোপেডিক বিভাগের অধীনে ভর্তি রয়েছেন।


Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top