ডাকসুতে প্যানেল নিয়ে ছাত্রলীগে বিরোধ : অবরুদ্ধ সভাপতি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ছাত্রলীগের প্যানেলের বিষয়ে শুক্রবার রাতে সিদ্ধান্ত নেয় আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। সেখানে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন (ভিপি), সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী (জিএস) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেনের নাম চূড়ান্ত হয়। তবে এ বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যেই প্রকাশ্যে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে ছাত্রলীগ। এর জের ধরে কেন্দ্রীয় সভাপতিকে অবরুদ্ধ করে রাখে ছাত্রলীগের ছাত্রী হল শাখার নারী নেত্রীরা। এ নিয়ে বেশ তোলপাড় শুরু হয়েছে। গতকাল শনিবার দুপুরে মধুর ক্যান্টিনে এ ঘটনা ঘটে।

গতকাল ছাত্রলীগের নারী নেত্রীরা মধুর ক্যান্টিনে গিয়ে ডাকসু নির্বাচনে তাদের নিয়ে শীর্ষ নেতৃত্বের ভাবনা জানতে চান। সেখানে গিয়ে তারা শোভন ও সাদ্দামের অনুসারীদের হাতে হেনস্তার শিকার হন। তবে বিষয়টি অস্বীকার করেছেন ছাত্রলীগ সভাপতি শোভন এবং ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন।
ছাত্রলীগের একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী নেতা জানান, মেয়েদের হলগুলোতে যারা বর্তমান সভাপতি ও সম্পাদক তাদের ডাকসুতে না রাখলেও হলের ভিপি-জিএস পদে রাখবে কি না তা জানতে দুপুর ১২টার কিছু আগে নেত্রীরা মধুর ক্যান্টিনে আসেন। এ সময় সেখানে ছাত্রলীগ সভাপতি শোভন এবং ঢাবি সম্পাদক সাদ্দাম উপস্থিত ছিলেন। নেত্রীরা তাদের সাথে ডাকসু ও হল সংসদে তাদের প্রার্থী করার দাবি জানান।

ছাত্রী হলের সভাপতি-সম্পাদকরা এলে তাদের বিভিন্নভাবে হেনস্তা করতে থাকে ছাত্রলীগের শীর্ষ চার নেতার অসুসারীরা। এ সময় সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সহসভাপতি ও ডাকসুর সম্ভব্য প্রার্থী মুজাহিদ কামাল, স্যার এফ রহমান হলের সাবেক নেতা সাগর রহমান এবং সূর্যসেন হলের সাংস্কৃতিক বিষয়ক উপসম্পাদক সিয়াম রহমানসহ একাধিক নেতা উপস্থিতি ছিলেন। তখন সাগর রহমান এক হলের নেত্রীকে ধাক্কা দিলে ওই নেত্রী সাগরের জামার কলার ধরে টানা-হেঁচড়া করেন। এ নিয়ে সেখানে উত্তেজনাকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এ সময় দুই গ্রুপের নেতাকর্মীদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে। ঘটনা চরমপর্যায়ে গেলে শোভন মধুর ক্যান্টিনের গোল ঘর থেকে লাঠি বের করে আনেন। এ সময় মেয়ে হলের নেত্রীরা এ ঘটনার বিচারের দাবিতে শোভন ও সাদ্দামকে গোল ঘরের মধ্যে অবরুদ্ধ করে রাখেন। সেখানে হল সভাপতি ও সম্পাদকদের সাথে শোভন এবং সাদ্দামের প্রায় এক ঘণ্টা আলোচনা হয়। আলোচনা চলাকালীন উভয়পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করে।

পরে সাংবাদিকদের সাথে এ নিয়ে কথা বলেন ছাত্রলীগ সভাপতি শোভন। তিনি বলেন, আমরা হলের সভাপতি-সম্পাদকদের ডেকেছি। হলের যারা প্রার্থী হবেন তারা কিভাবে কাজ করবেন সে বিষয়ে পরামর্শ নেয়া হবে। যদিও মিটিংয়ের বিষয়ে অনেকেই জানেন না বলে জানান কয়েকটি হলের সভাপতি-সম্পাদক। জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ছাত্রলীগ নেত্রী বলেন, শুক্রবার রাতে আমরা যখন জানতে পারি হলে যারা সভাপতি-সম্পাদক, তাদের রাখা ডাকসুতে রাখা হচ্ছে না তখন আমরা আজ (শনিবার) মধুতে আসি। আমরা হলের মধ্যে কারা ডাকসুর প্রার্থী হবেন সে বিষয়ে আলোচনা করি। কিন্তু শোভন ও সাদ্দামের অনুসারীরা আমাদের বিভিন্নভাবে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেন। তখন তাদের সাথে আমাদের কথাকাটাকাটি হয়। এ সময় তাদের মধ্য থেকে একজন আমাদের এক নেত্রীকে ধাক্কা দিলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। পরে শোভন লাঠি বের করে সবাইকে থামিয়ে দেন।

ছাত্রী হলের নেত্রীদের বাধা দেয়ার বিষয়টি পূর্বপরিকল্পিত বলে অভিযোগ করেন নেত্রীরা।

উত্তেজনার বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগ সভাপতি শোভন সাংবাদিকদের বলেন, উত্তেজনাকর কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। লাঠি হাতে বের হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, যখন সবাই ঝামেলা করছিল তখন আমি তাদের থামিয়ে দেই।

বিভিন্ন হলের সভাপতি-সম্পাদকদের ডাকসুতে অংশগ্রহণের বিষয়ে তিনি বলেন, যারা যোগ্য এবং পরিচিত তাদের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। তাদের বিষয়টি দেখবেন মূল দলের হাইকমান্ড। তারা যে নির্দেশনা দেবেন তা নিয়ে আমরা কাজ করব। এ ছাড়া বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টও নেয়া হচ্ছে। তার ওপর ভিত্তি করেই প্যানেলে রাখা হবে। প্যানেলে টিএসসির বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাদের রাখার বিষয়ে তিনি বলেন, তাদের মধ্যে যারা যোগ্য আর ভালো তাদের নিয়েও আলোচনা হয়েছে। সেসব বিষয় দেখবেন আওয়ামী লীগের নেতারা।
ছাত্রলীগে আলাদা প্যানেল : এ দিকে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগের মধ্যে কোন্দল সৃষ্টির ফলে সংগঠনের বাদপড়া নেতাদের নিয়ে আলাদা প্যানেল দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে একটি পক্ষ। তারা পূর্ণাঙ্গ প্যানেল দিয়ে নির্বাচন করবেন বলে নিশ্চিত করেছেন। নির্বাচনে জয়ী হয়ে তারা প্রমাণ করতে চাচ্ছেন যে তারা অন্যদের চেয়ে যোগ্য। জানতে চাইলে ছাত্রলীগের ২০১৮ সালের সম্মেলন প্রত্যাশী ও জহুরুল হক হলের সাবেক নেতা আমিনুল ইসলাম বুলবুল বলেন, ছাত্রলীগের প্যানেল হচ্ছে। আমরা যারা ত্যাগী নেতা রয়েছি তারা বাদ যাচ্ছি। আমাদের যোগ্য মনে করা হচ্ছে না। আমরা যারা ত্যাগী এবং পরীক্ষিত নেতা রয়েছি আমরা ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিয়ে দেখিয়ে দেবো যে আমরা যোগ্য না অযোগ্য।

দাবি আদায় করেই নির্বাচনে যাবে ছাত্রদল : ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে ছাত্রদল যে সাত দফা দাবি দিয়েছিল তা আদায় করেই নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন সংগঠনটির নেতারা। শনিবার বেলা দেড়টায় বিশ্ববিদ্যালয়েল মধুর ক্যান্টিনে এসে সাংবাদিকদের বিষয়টি জানান ছাত্রদলের ঢাবি শাখার সভাপতি আল মেহেদী তালুকদার। এ সময় ঢাবি সাধারণ সম্পাদক আবুল বাসার সিদ্দিকীসহ প্রায় ৩০ জন নেতা উপস্থিত ছিলেন। মেহেদী তালুকদার বলেন, আমাদের দাবি আদায় করেই আমরা ডাকসু নির্বাচনে যাবো। আমরা আমাদের সাত দফা দাবিতে বলেছি, বিশ^বিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত যেকোনো শিক্ষার্থীই যেন নির্বাচনে যেতে পারেন, এখানে বয়স কোনো ফ্যাক্টর হতে পারে না। আমাদের দাবির অগ্রগতি হবে ধরে নিয়েই আমরা ফর্ম বিতরণ করছি। ৩০ বছরের বেশি কেউ যদি ফর্ম নিতে চান, তাহলে পারবেন। আমরা তো এ বাধা মানি না।

তিনি আরো বলেন, আমরা ঢাবি প্রশাসনকে বারবার বলেছি, তড়িঘড়ি করে নির্বাচন হলে তা ফলপ্রসূ হবে না। আমাদের দাবির মধ্যেও আছে যৌক্তিক সময় পর্যন্ত নির্বাচন পেছানোর। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি আমাদের দাবি না মানে সে ক্ষেত্রেও আমরা যাতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারি সে প্রস্তুতিও আমাদের আছে। কিন্তু আমাদের মূল টার্গেট হলো- দাবি আদায় করেই আমরা নির্বাচনে যাবো।

প্যানেল ঘোষণার বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা প্রক্রিয়া শুরু করেছি। যেকোনো সময় যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করার মতো সামর্থ্য ছাত্রদলের আছে। মনোনয়নের ক্ষেত্রে কাদের গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে জানতে চাইলে মেহেদী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের কমিটিতে ৫০০-র অধিক নেতাকর্মী আছেন। এর মধ্যে ৪৭০ জনের অধিক ৩০ বছর বয়সের ভেতরে। এ ছাড়া আমাদের অসংখ্য নিয়মিত শিক্ষার্থী রয়েছেন। কাজেই আমাদের তো কর্মীর অভাব নেই। মেহেদী বলেন, ডাকসু একটা গ্ল্যামার। ছাত্রদল আরেকটা গ্লামার। ছাত্রদলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ পরীক্ষিত। তাদের বাদ দেয়ার জন্যই বয়স ৩০ বছর করা হয়েছে। এতে পরীক্ষিত নেতারা বাদ যাচ্ছেন।

বাম জোটের প্যানেল ঘোষণা আজ : এ দিকে বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর মোর্চা প্রগতিশীল ছাত্রজোট ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ছাত্রঐক্য প্যানেল ঘোষণা করবে আজ রোববার। প্যানেল ঘোষণা করেই মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করবেন তারা। সূত্র জানায়, প্যানেলে ভিপি হিসেবে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী এবং জিএস পদে ছাত্র ফেডারেশনের ঢাবি শাখার সভাপতি উম্মে হাবিবা বেনজির ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের ঢাবি শাখার সভাপতি সালমান সিদ্দিকী আলোচনায় রয়েছেন। এ বিষয়ে লিটন নন্দী বলেন, রোববার বেলা ১টা থেকে ২টায় আনুষ্ঠানিকভাবে আমরা প্যানেল ঘোষণা করব। কেন্দ্রীয় সংসদ ও হল সংসদের পূর্ণ প্যানেল ঘোষণা হবে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্যানেল ঘোষণা আজ : এ দিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ প্যানেল ঘোষণা করবে আজ। এখন পর্যন্ত স্বতন্ত্রভাবেই নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত তাদের। পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুনকে প্রধান করে গঠিত উপদেষ্টা পরিষদ সবার পরামর্শক্রমে ডাকসু ও হল সংসদের প্যানেল নির্ধারণ করবে। এ বিষয়ে হাসান আল মামুন বলেন, আমরা প্যানেল নিয়ে কাজ করছি। রোববার বেলা ১১টায় সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্যানেল ঘোষণা করা হবে।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top