গত বছরের জুলাই মাস। ভারতের রাজস্থান রাজ্যের একটি গ্রাম। রাত্রিবেলা এক মুসলিম গরুর খামারিকে থামানো হলো পথের ওপর। তার সাথে ছিল দুটি গরু। কয়েক ঘন্টার পরই তাকে পাওয়া গেল মৃত অবস্থায়। কিন্তু প্রশ্ন : কে হত্যা করলো তাকে? কথিত ‘গো-রক্ষকরা’? নাকি পুলিশ?
ঘটনাটি নিয়ে খোঁজখবর করেছেন বিবিসির সাংবাদিক রবার্ট ক্লেটন। রাজস্থানের রামগড়, ভোর চারটা। সেখানকার হাসপাতালের ডিউটি ডাক্তার হাসান খান। তিনি একটা অস্বাভাবিক ঘটনার খবর পেলেন।
পুলিশ এক লোকের লাশ নিয়ে এসেছে। তারা বলছে, লাশটি কার তা তারা জানে না।
বিবিসির সাংবাদিক খানকে জিজ্ঞেস করলেন. আপনার কাছে যখন পুলিশ লাশটা নিয়ে এলো তখন তাদের দেখে কেমন মনে হচ্ছিল? তারা কি শান্ত ছিল?
“না, তাদের মনে হচ্ছিল উদ্বিগ্ন, অস্থির। পুলিশকে সাধারণত এরকম দেখায় না” – বললেন ডা. হাসান।
মৃত লোকটিকে অবশ্য সনাক্ত করতে খুব বেশি সময় লাগেনি। জানা গেল – তার নাম রাকবার খান, স্থানীয় এক কৃষক। তার বাবা এসে তাকে সনাক্ত করলেন।
‘এটি কোনো সাধারণ খুন নয়’
বলা হচ্ছে এটি কোনো সাধারণ খুনের ঘটনা নয়। এতে বোঝা যায়, বিশেষ করে উত্তর ভারতে সমাজের ভেতরে কি ধরণের একটা চাপা উত্তেজনা টগবগ করছে।
রাকবার খানের মৃত্যু ভারতের কর্তৃপক্ষ সম্পর্কেও অনেকগুলো প্রশ্ন জাগায়। এর মধ্যে হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপিও আছে – যারা এখন ভারতে ক্ষমতাসীন।
রাকবার খান ছিলেন একজন পরিবার অন্তপ্রাণ মানুষ। তার সাতটি ছেলেমেয়ে। তার গরুর খামার ছিল। আবার তিনি ছিলেন একজন মুসলিম। কিন্তু ভারতে এখন এটা বিপজ্জনক ব্যাপার হয়ে উঠতে পারে।
রাকবারের বাবা সুলেইমান বলছিলেন, “আমরা চিরকালই গরুর খামার করে আসছি, দুধের ব্যবসা করছি। এই আমাদের জীবিকা। এতকাল কখনো আমাদের গরু আনা-নেয়া নিয়ে কেউ কোন প্রশ্ন করেনি।”
কিন্তু সে অবস্থা এখন বদলে গেছে। মেওয়াত – যেখানে রাকবারের গ্রাম – সেই মুসলিম-প্রধান অঞ্চলটির বেশ কয়েকজন লোক গত কয়েক বছরে খুন হয়েছেন।
“লোকজন এখন ভয়ের মধ্যে আছে। আমরা গরু কিনতে গেলে তারা আমাদের মেরে ফেলবে। তারা আমাদের গাড়ি ঘেরাও করে। তাই সবাই গরু আনতে ভয় পায়” – বলছিলেন সুলেইমান।
বিবিসির সাংবাদিক জেমস ক্লেটন বলছিলেন, তার সাথে ওই গ্রামের যারই কথা হয় – তিনিই বলেন, তারা গো-রক্ষকদের ভয়ে ভীত।
কট্টরপন্থী হিন্দু যুবকদের এই গ্রুপগুলো মনে করে, ভারতে গরু জবাই নিষিদ্ধ করার আইনটি যখাযথভাবে প্রয়োগ হচ্ছে না – তাই তারা নিজেরাই গরু চোরাচালানিদের খুঁজে বের করতে নেমে পড়েছে। এরা প্রায়ই সশস্ত্র হয়ে থাকে।
গত বছর ২১ জুলাই রাতে রাকবার খান তার বন্ধু আসলামকে নিয়ে দুটি গরুসহ গ্রামের পথে যাচ্ছিলেন।
পথে মোটরবাইকে করে স্থানীয় গো-রক্ষকদের দলটি তাদের পথ আটকায়। তারা রাকবারকে ধরে নিযে যায়, কিন্তু আসলাম পালাতে সক্ষম হন। তিনি লুকিয়ে থেকে শুনছিলেন রাকবারের চিৎকার।
রাকবারকে এমনভাবে পেটানো হয় যে বোধহয় শরীরের সবগুলো হাড়ই ভেঙে গিয়েছিল – বলছিলেন আসলাম।
বিবিসির রবার্ট ক্লেটন পরে সেই গো-রক্ষক দলের নেতা নওল কিশোর শর্মার সাথে কথা বলেন।
তার কথা, তিনি ঘটনাস্থলে ছিলেন না। বরং তার দলের ছেলেরা তাকে খবর দেয় যে তারা একজন ‘গরু চোরাচালানীকে’ ধরেছে। খবর পেয়ে তিনি পুলিশকে নিয়ে সেখানে যান। তখন রাকবার জীবিত এবং সুস্থ ছিলেন। কিন্ত পুলিশের এফআইআর বলছে ভিন্ন কথা।
তাতে বলা হচ্ছে, পুলিশ শর্মার সাথে ঘটনাস্থলে গিযে দেখতে পায় যে লোকটি গুরুতর আহত, সারা গাযে কাদা মাখা এবং তিনি শুধু তার নাম, বাবার নাম, বয়স ও গ্রামের নামটুকুই বলতে পেরেছিলেন। তার পরই তিনি সংজ্ঞা হারান।
এর পর তাকে রামগড়ে নিযে যাওয়া হয় এবং ডাক্তার রাকবারকে মৃত ঘোষণা করে। কিন্তু হাসপাতালের রেকর্ড পরীক্ষা করলে দেখা যায় – এ বিবরণও মিলছে না। কারণ, হাসপাতালের রেকর্ডে লেখা আছে ‘অজ্ঞাতনামা একটি লোকের মৃতদেহ’ আনার কথা। রাকবারকে যেখানে পাওয়া গিয়েছিল – সেখান থেকে হাসপাতালটি গাড়িতে মাত্র ১২ মিনিটের পথ।
তাহলে তাকে নিয়ে আসতে তিন ঘন্টা লাগলো কেন? রাকবার যদি মারা যাবার আগে তার নাম বলেই থাকে, তাহলে তারা হাসপাতালকে সে কথা বললো না কেন?
নওল কিশোর শর্মা বলছেন, তিনি জানেন এ অসঙ্গতির কারণ কী। কারণ তিনি বলছেন, ধরার পর রাকবারের কাপড় পাল্টানো হয়েছিল। তিনি তার দুটি ছবিও তুলেছিলেন। তার কথা, আসলে রাকবারকে পিটিয়েছে পুলিশ – থানায় আনার পর।
তাকে এমনভাবে মারধর করা হয় যে তার পাঁজরের হাড় ভেঙে ফুসফুসে ছিদ্র হয়ে যায়।
শর্মা বলছেন, রাত তিনটের দিকে তিনি কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে নিয়ে গরু দুটিকে একটি গো-আশ্রয়কেন্দ্রে দিয়ে আসতে গিয়েছিলেন।
ফিরে আসার পর পুলিশ তাকে জানায়, রাকবার মারা গেছে।
ডাক্তারকে বিবিসির সাংবাদিক প্রশ্ন করেন : তার কাছে মৃতদেহ কি অবস্থায় আনা হয়েছিল? ডাক্তার বলেন, মৃতদেহটি ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। তিনি আরো বললেন, মৃত্যুর পর দেহ ঠান্ডা হতে অন্তত দু ঘন্টা লাগে।
রামগড় যে জেলার অন্তর্গত – সেই আলোয়ারের পুলিশ প্রধান রাজেন্দ্র সিং বলছেন, রাকবারের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে কয়েক জন পুলিশ কর্মকর্তাকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। তিনি জানান, পুলিশ যথাযথ প্রক্রিয়া অনুযায়ী কাজ করেনি বলেই এ ব্যবস্থা নেয়া হয়।
নওল কিশোর শর্মার দলের তিনজনকে রাকবারের মৃত্যুর জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে। শর্মার নিজের বিরুদ্ধেও তদন্ত চলছে।
কিন্তু পুলিশ এবং শর্মার গো-রক্ষক গোষ্ঠী এ ঘটনার জন্য পরস্পরকে দোষ দিচ্ছে। কিন্তু তারা কেউই অস্বীকার করছে না যে ঘটনার রাতে তারা একসাথে কাজ করেছে।
মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর অভিযোগ অনেক সময়ই গরু চোরাচালান ঠেকানোর অভিযানে পুলিশ এবং গো-রক্ষক দলগুলো একসাথে কাজ করছে।
এর একটা প্রমাণ : নভেম্বর ২০১৫ সালে এলিসন জয়েসের তোলা একটি ছবিতে দেখা যায় রামগড়ের কাছে সন্দেহভাজন গরু চোরাচালানীদের সাথে গো-রক্ষকদের গুলিবিনিময়ের এক ঘটনার পর নওলকিশোর শর্মাকে আলিঙ্গন করছেন এক পুলিশ কর্মকর্তা ।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মীনাক্ষি গাঙ্গুলি বলছেন, তারা প্রায়ই দেখতে পান যে পুলিশ এসব মৃত্যুর ঘটনায় জড়িত।
অন্তত ১২টি ঘটনা তারা পরীক্ষা করেছেন – যাতে পুলিশ কথিত গরু চোরাচালানির মৃত্যুর সাথে জড়িত অথবা তারা ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে সহায়তা করেছে। রাকবারের ঘটনাটি এগুলোর অন্যতম।
সংস্থাটি এ সপ্তাহেই এ নিয়ে ১০৪ পৃষ্ঠার একটি রিপোর্ট বের করেছে।
অনেকে বলছেন, এটা শুধু পুলিশের ব্যর্থতারই চিত্র নয়, সরকারি দল বিজেপি কিভাবে ব্যাপারটিকে উস্কানি দিয়েছে – তারও দৃষ্টান্ত।
রামগড়ের এমপি জ্ঞানদের আহুজার ভাষায় গরু চোরাচালানি ‘সন্ত্রাসবাদের চেয়েও গুরুতর অপরাধ।’ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের একজন মন্ত্রী খুনের অভিযোগ আছে এমন এক গো-রক্ষককে মালা পরিয়ে দিচ্ছেন – এমন ছবিও বেরিয়েছে। পরে অবশ্য তিনি এ জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন।
গরু-সংক্রান্ত সহিংসতায় ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৪৬ জন নিহত এবং ২৫০ জন আহত হবার একটি হিসেব আছে, তবে এ নিয়ে কোনো সরকারি তথ্য নেই।
সন্দেহভাজন গরু চোরাচালানিদের সাথে গো-রক্ষকদের গুলিবিনিময়ের পর নওলকিশোর শর্মাকে আলিঙ্গন করছেন এক পুলিশ কর্মকর্তা
বিজেপি সবসময়ই গরু-সংক্রান্ত সহিংসতার সাথে তাদের দলের কোন সম্পর্ক থাকার কথা অস্বীকার করে।
রাকবার হত্যাকান্ডের বিচার প্রক্রিয়া এখনো শুরু হয় নি। তবে তার ভাগ্যে আসলে কি ঘটেছিল তা হযতো কখনোই জানা যাবে না।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে এমন খবর বেরিয়েছে যে পুলিশ যখন রাকবারের গরু দুটি নিয়ে গো-আশ্রয়কেন্দ্রে যাচ্ছে – তখন পুলিশেরই গাড়িতে রাকবার মৃত বা মৃতপ্রায় অবস্থায় পড়ে ছিলেন।
আরো অভিযোগ, পুলিশ রাকবারকে হাসপাতালে নেবার পরিবর্তে পথে গাড়ি থামিয়ে চা খেয়েছিল।
তারা যাই করে থাকুক, এটা ঠিক যে রাকবারকে সাথে সাথে হাসপাতালে নেয়া হয়নি।
সূত্র : বিবিসি