শিক্ষক এবং কর্মকর্তা

আমাদের দেশের কারিকুলামভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থায় সাধারণত দুই ধরনের শিক্ষক রয়েছেন। একটি হলো বেসরকারি শিক্ষক সমাজ। অন্যটি রাষ্ট্রীয়ভাবে সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্ত সরকারি শিক্ষক। বেসরকারি শিক্ষক সমাজের আবার দু’টি শ্রেণী রয়েছে : এমপিওভুক্ত শিক্ষকশ্রেণী এবং নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষকশ্রেণী। সরকারি শিক্ষকশ্রেণী দু’টি ধারায় বিভক্ত। একটি সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক। এদের মধ্যে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকেরা নিয়োগপ্রাপ্ত হন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মাধ্যমে। আর উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা পর্যায়ের শিক্ষকরা নিয়োগপ্রাপ্ত হন বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (বিপিএসসি) মাধ্যমে ব্যাপক প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে। অন্যটি হল স্বায়ত্তশাসিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উচ্চশিক্ষা পর্যায়ের শিক্ষক। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা নিজ নিজ বিভাগে নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে অ্যাকাডেমিক দিক থেকে ভালো ফলাফল অর্জন করার পর নিয়োগ নির্বাচনী বোর্ডের মাধ্যমে নিয়োগ লাভ করেন। যেমনÑ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবর্গ।

এই বিভিন্ন ধরনের শিক্ষকশ্রেণীর মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে সমস্যাগ্রস্ত শিক্ষকশ্রেণী হলো বেসরকারি শিক্ষক সমাজ। অথচ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে নব্বই ভাগের বেশি অবদান থাকে বেসরকারি শিক্ষক সমাজের। এখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ না হলেও এদের হাতে গড়া শিক্ষার্থীরা একদিন পেশাজীবী হয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেতৃত্ব দান করে। কিন্তু শিক্ষা বিভাগের এই খাত কোণঠাসা, এদের বিশেষ কোনো পদোন্নতি নেই। বেতনভাতার পরিমাণ কম। শিক্ষা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদের এদের অবস্থান নেই। বেসরকারি শিক্ষা খাত বহুমুখী সমস্যায় জর্জরিত। চিন্তা-মননে এরা সঙ্কীর্ণ। এ ধরনের শিক্ষকদের একটি অংশ রয়েছে যারা শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে একেবারে অচল। শুধু রাজনৈতিক কারণে এদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নানামুখী বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, ইতিবাচক বিভিন্ন কাজে বাধা সৃষ্টি করা এদের কাজ। কিন্তু সুশৃঙ্খল কোনো কাজ এরা করতে জানে না। এ ধরনের শিক্ষকদের মনস্তাত্ত্বিক জগতে নিকৃষ্ট হিসেবে বিবেচনায় আনা যায়। কিন্তু তাদের কৃতকর্মের কোনো সমালোচনা করা যায় না।

বেসরকারি শিক্ষা ক্ষেত্রে স্বল্পসংখ্যক শিক্ষক রয়েছেন যারা মানসম্মত শিক্ষাদানে সক্ষম। ব্যাপক অংশের মধ্যম মানের শিক্ষা দানের সক্ষমতা রয়েছে। এদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উন্নত পর্যায়ে বা উন্নত মানের শিক্ষাদানে সক্ষম করে তোলা যায়। বিগত সময় থেকে এই প্রচেষ্টা চলছে, বর্তমানে অব্যাহত আছে। একেবারে কমসংখ্যক শিক্ষক রয়েছেন যাদের মান একেবারেই নিম্ন পর্যায়ের। এদের প্রকৃত অর্থে কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই। কিন্তু এরা রাজনৈতিক দলের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে থাকেন। তাই এরা সব অন্যায়ের ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন। এদের ধরা যায় না বা ছোঁয়া যায় না। এদের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা যায় না। যখন যে দল সরকার গঠন করে তখন তারা সে দলের লোকে পরিণত হয়। যারা ন্যূনতম প্রতিবাদ করে তারা বিভিন্ন সময় বিপদে পতিত হয়। সরকারি কোনো তদন্ত এলে আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকা শিক্ষকদের দিয়ে সাধারণত এদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী শিক্ষকশ্রেণী ক্ষতিগ্রস্ত হন।

এরা তাদের বিরোধী পক্ষকে সরকারবিরোধী শিক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। ফলে মানসম্মত শিক্ষকশ্রেণী চাকরি হারায়। এতে করে মানসম্মত শিক্ষা বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হয়। দলীয় সরকারের নেতৃত্বে যে শিক্ষাকার্যক্রম চলে তা তৃণমূল থেকে নিজ নিজ দলীয় লোক দিয়ে ক্ষতির মুখোমুখি হয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সরকার নিজ দলীয় তৃণমূলের দলপ্রেমিক ও দেশপ্রেমিক অংশকে কাজে লাগাতে পারে। শিক্ষকদের এই বখাটে অংশকে বাদ দিলে বাকি অংশ শিক্ষকশ্রেণীকে আপাদমস্তক শিক্ষক বলা যাবে। এরা বহু বছর চাকরির পর প্রতিষ্ঠান প্রধান বা সহকারী প্রধান পদে নিয়োগের যোগ্যতা পান। এ দু’টি পদে নিয়োগ পাওয়ার পর এরা হন ম্যান অব দি চেয়ার; যা কোনো কর্মকর্তা চাকরির শুরুতে পেয়ে যান। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা নিয়োগ পান জুনিয়র শিক্ষক বা সহকারী শিক্ষক বা প্রভাষক হিসেবে। এই পদগুলো হলো শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবনে প্রবেশের প্রথম ধাপ। কিন্তু প্রতিষ্ঠান প্রধান বা সহকারী প্রধান হিসেবে যে নিয়োগ তা হলো শিক্ষক এবং কর্মকর্তা বা নির্বাহী হিসেবে। অন্য দিকে সরকারি শিক্ষকদের ক্ষেত্রে কিন্তু তা নয়। সাধারণত সরকারি কলেজ শিক্ষকেরা হলেন কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন হলো এ দেশের সবচেয়ে মেধাবী কর্মকর্তা নিয়োগ কমিশন। এই কমিশন দুই ধরনের কর্মকর্তা নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে থাকে। একটি হলো বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস ক্যাডার কর্মকর্তা; অন্যটি হলো নন-ক্যাডার কর্মকর্তা। যেভাবে নিয়োগ হোক না কেন বেশ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে এই কমিশন তরুণ কর্মকর্তা নিয়োগ করে থাকে। বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন প্রায় ২৭টি ক্যাডারে কর্মকর্তা নিয়োগ পরীক্ষা নেয়। নিয়োগের জন্য বিভিন্ন ক্যাডারে বিভিন্ন পদবি থাকে।

যেমন কাস্টম বিভাগে ক্যাডার সার্ভিস কর্মকর্তার প্রথম পদবি হলো এসিস্ট্যান্ট কমিশনার (কাস্টম) কর বিভাগের ক্যাডার সার্ভিস কর্মকর্তার প্রথম ও প্রবেশ পদবি হলো এসিস্ট্যান্ট কমিশনার (কর), পুলিশ বিভাগের এ ধরনের কর্মকর্তার প্রবেশ পদবি হলো এসিস্ট্যান্ট সুপারিনটেনডেন্ট অব পুলিশ, শিক্ষা বিভাগের ক্যাডার সার্ভিস কর্মকর্তার প্রবেশ পদবি হলো প্রভাষক, মেডিক্যাল ক্যাডারের কর্মকর্তার প্রবেশ পদবি মেডিক্যাল অফিসার। সুতরাং পদবির অক্ষর সাজ বা শব্দ গঠনে ভিন্নতা থাকলেও এরা সবাই কর্মকর্তা। এদের চাকরি হবে মাঠে ময়দানে, চেয়ার-টেবিলে, শ্রেণিকক্ষে বা চিকিৎসালয়ে। যদি কেউ প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন তাহলে তিনি হবেন শিক্ষক এবং কর্মকর্তা। শিক্ষক হিসেবে তার কাজ শ্রেণিকক্ষে থাকলেও কর্মকর্তা হিসেবে তিনি শিক্ষা বিভাগের বিভিন্ন জায়গায় চাকরি করবেন। যেমন শিক্ষা বোর্ড, টেক্সট বুক বোর্ড, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর, নায়েম প্রভৃতি স্থানে শিক্ষা প্রশাসনের পদে চাকরি করতে পারেন।

আবার শিক্ষা ক্যাডারের অফিসারেরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটেও চাকরি করতে পারেন কোনো প্রশাসনিক পদে। তাই বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার উত্তীর্ণ হওয়া কোনো অফিসার যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে উল্লিখিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রশাসনিক পদে নিয়োগ পেতে আগ্রহী হয়, তাহলে তা ভুল বা বেঠিক বা অনৈতিক কিছু নয়। বরং তা হবে স্বাভাবিক কিন্তু শিক্ষা প্রশাসন নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ যে বিষয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করা দরকার তা হলো প্রতিটি পদ একই ব্যক্তি কত বছর ধরে অলঙ্কৃত করেছেন আর কত বছরই বা ওই পদগুলোতে অবস্থানের নিয়ম রয়েছে। চাকরির অবস্থাগত দিক থেকে এসব শিক্ষক বা কর্মকর্তারা শিক্ষকতা বা অফিসারগিরি উভয় ধরনের কাজ করবেন। প্রত্যেক ব্যক্তি তার ইচ্ছানুসারে সঠিক কাজ করার নৈতিক অধিকার রাখেন। আর নিয়োগ বা বদলি প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের উচিত প্রত্যেককে সমদৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনায় আনা। কিন্তু স্থানান্তরকরণের ক্ষেত্রে (বদলি) কর্তৃপক্ষের এক চোখা নীতির বিষয়টি লক্ষ করা যায়। পর্যবেক্ষণ থেকে বলা যায় একই ব্যক্তি একই পদে যত বছর অবস্থান করার নিয়ম তার থেকে চার বা ছয়গুণ বেশি সময় অবস্থান করেছেন।

যথাযথ কর্তৃপক্ষ তাদের সে সুযোগ করে দিচ্ছে। আবার এমনও লক্ষ করা যায় যে, কোনো একজন কর্মকর্তা নিয়মমাফিক একই পদে অবস্থান করে পদোন্নতি পেয়ে বা নিয়ে অন্য আরেকটি প্রতিষ্ঠানে প্রশাসনিক পদ দখল করে নেন। কিছু দিন টেক্সট বুক বোর্ড, কিছু দিন মাউশি অথবা কিছু দিন নায়েমে পোস্টিং নিয়ে থাকেন। শ্রেণিকক্ষে তাদের আগ্রহ কম। প্রশাসনিক পদে তাদের আগ্রহ বেশি; অথচ তারা শিক্ষা ক্যাডার। এটা অনৈতিক; ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের উচিত এগুলোর দেখভাল করা। কোনো শিক্ষক যদি কর্মজীবনের ব্যাপক অংশ শ্রেণিকক্ষ তথা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যয় করেন তা যেমন গ্রহণযোগ্য হতে পারে না, ঠিক তেমনি কোনো শিক্ষক যদি কর্মকর্তা হিসেবে কর্মজীবনের ব্যাপক সময় উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যয় করেন তাও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তাই শিক্ষা ক্যাডারদের কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি সঠিক তবে শ্রেণিকক্ষে কাজ করে তারা যেন মানসম্মত শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রাখতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার সব সমাপ্তির পর কোনো তরুণ-তরুণী শিক্ষা ক্যাডার উল্লিখিত বিভিন্ন জায়গায় নিয়ম মাফিক চাকরি করে এবং শ্রেণিকক্ষে কাজ করে শিক্ষার উন্নয়ন ঘটাতে পারে। আবার এমপিওভুক্ত খাতের অন্তত ২০ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষকদের যাদের রয়েছে একাধিক প্রশিক্ষণ, প্রকাশনা, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষাপর্যায়ে প্রশ্ন প্রণয়ন বা উত্তরপত্র মূল্যায়ন ও নিরীক্ষণ প্রভৃতি কাজের অভিজ্ঞতা তাদেরকেও শিক্ষা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করে শিক্ষার উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। বেসরকারি শিক্ষকদের কর্মজীবনের দুই-তৃতীয়াংশ সময় অতিক্রমের পর শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে অর্থাৎ শিক্ষা বোর্ড, টেক্সটবুক বোর্ড, নায়েম, মাউশির গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করলে এবং সরকারিদের এসব জায়গায় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাখার ব্যবস্থা নিয়মমাফিক করলে শিক্ষার মান উন্নত হবে।

কেউ দীর্ঘ দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে থাকবে আর কেউ কেউ শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাজ করবে এমনটি কাম্য হতে পারে না। শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন শিক্ষক কর্মকর্তা হিসেবে এবং শিক্ষক হিসেবে কাজ করলে উন্নতির আশা করা। শুধু প্রশাসনিক পদ অলঙ্কৃত করে তা সম্ভব নয়। তাই যারা দীর্ঘ দিন উল্লিখিত বিভিন্ন স্থানে প্রশাসনিক পদ দখল করে আছে তাদের শ্রেণীকার্যক্রমে সম্পৃক্ত করতে হবে।

লেখক : প্রেসিডিয়াম সদস্য, বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতি
kazimain@gmail.com

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top