মানবসম্পদ উন্নয়নে কর্মমুখী শিক্ষা

বর্তমান বিশ্বে যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত, সে জাতি তত উন্নত। শিক্ষা বলতে আমরা বুঝি, কোনো বিষয় জানা এবং বোঝা। আসলে মানুষ জন্মের পর থেকেই চারপাশের পরিবেশ থেকে নানান কিছু শিখতে থাকে। এ জন্যই কবি বলেছেন, ‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র’। তবে যাই হোক না কেন, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেই আমরা শিক্ষা হিসেবে বুঝি। শিক্ষাই মানুষকে তার মনুষ্যত্ব অর্জনে সাহায্যে করে। তাই বলা হয় শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা মানুষকে জ্ঞান দিয়ে সম্প্রীতি বাড়ায়, কুসংস্কার দূর করে সমাজকে আলোকিত করে। আধুনা শিক্ষাকে দুটো শ্রেণীতে ভাগ করা হচ্ছে- সাধারণ শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক বা কারিগরি শিক্ষা। বর্তমানে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কর্মমুখী শিক্ষার অগ্রযাত্রার ফলেই পৃথিবী দ্রুত উন্নতির দিকে এগিয়ে চলছে। তাই কর্মমুখী শিক্ষা উন্নতি ও উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।

মানবসম্পদ হচ্ছে মানুষের শক্তি, দক্ষতা, মেধা ও জ্ঞান যা পণ্য উৎপাদন ও সেবার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়। সমাজের সব মানুষের জ্ঞান, দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়াই হচ্ছে মানবসম্পদ উন্নয়ন। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ পল জে মায়ার বলেছেন, The greatest natural resource of our country is its people. বিশিষ্ট চিন্তাবিদ কার্ল মার্ক্স মানুষকে মানবীয় মূলধারা হিসেবে বিবেচনা করেছেন। এ মানবীয় মূলধারাকে আধুনিক পরিভাষায় মানবসম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মানবসম্পদ উন্নয়ন হচ্ছে- প্রয়োজনীয় সব উপায়ের মাধ্যমে মানুষের উন্নয়ন। মানবসম্পদ উন্নয়নের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো- মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য তার মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণের পাশাপাশি তার সহজাত ও সুপ্ত ক্ষমতা বিকাশের অনুকূল পরিবেশ ও সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া। এই দৃষ্টিতে মানবসম্পদ বলতে একটি দেশের সব জনসংখ্যাকে বোঝায়, শুধু যোগ্য ও প্রশিক্ষিত জনশক্তিকে বোঝায় না, বরং অদক্ষ শ্রমিকদেরও বোঝায়। অর্থাৎ যারা উৎপাদন খাতে অবদান রাখে তাদের সবাইকেই মানবসম্পদ বলে।

দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে দক্ষ মানবসম্পদের কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষাই দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির অন্যতম হাতিয়ার। তাই শিক্ষার মূল ভিত্তিই হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। দেশের জাতীয় উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় কার্যকরী ভূমিকা পালন করার জন্য প্রয়োজন একটি শিক্ষিত জাতি। আর প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে দেশের সব মানুষকে ন্যূনতম শিক্ষায় শিক্ষিত করার প্রথম সোপান। তাই জাতীয় অগ্রগতি ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। ফলে দেশের বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরিত করে উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করতে শিক্ষাই একমাত্র মাধ্যম। প্রাথমিক শিক্ষা শিক্ষিত জাতি গঠনের মূল ভিত্তি। মানুষকে উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনায় আনলে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে মানবসম্পদের বিষয়টি মুখ্য হয়ে ওঠে। উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন, সঠিক সংগঠন গড়ে তোলা এবং যথাযথ প্রযুক্তি নির্দিষ্টকরণ ও প্রয়োগের জন্য দক্ষ, যোগ্য, দেশপ্রেমিক, নিষ্ঠাবান, সৎ ও উৎপাদনশীল মানবসম্পদের প্রয়োজন। আর দেশের জনসম্পদকে মানবসম্পদে রূপান্তর করাতে হলে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। কারণ শিক্ষা মানবসম্পদ উন্নয়নে বিভিন্নভাবে অবদান রাখে।

মানব সন্তান সুনির্দিষ্ট কিছু সুপ্ত প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। মানবসম্পদ উন্নয়নের উদ্দেশ্য হলো- এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা, যেখানে সবাই তাদের যোগ্যতার প্রসার ঘটাতে পারে এবং বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্মগুলোর জন্য সুযোগের সম্প্রসারণ ঘটাতে পারে। প্রত্যেক মানুষের জীবনে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা লাভের জন্মগত অধিকার আছে। এই সুযোগ সুবিধা লাভের সার্বজনীন স্বীকৃতি হলো মানবসম্পদ উন্নয়নের মূলভিত্তি। মানবসম্পদ বলতে কী বোঝায়, সে সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন।

আমাদের দেশে বর্তমানে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষা প্রচলিত। তার সাথে কারিগরি, প্রকৌশলী, ডাক্তারি, ভোকেশনাল ইত্যাদি কর্মমুখী শিক্ষার ব্যবস্থাও রয়েছে। তাবে আমাদের দেশে কর্মমুখী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটেনি। ফলে প্রচলিত পন্থায় কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়েও লাখ লাখ যুবক বেকারত্বের অভিশাপে দুশ্চিন্তা ও হতাশাগ্রস্ত। অথচ উন্নত দেশগুলোর শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগই কারিগরি, বৃত্তিমূলক ও পেশাভিত্তিক শিক্ষায় শিক্ষিত। এমনকি এশিয়ায় দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা ইত্যাদি দ্রুত উন্নয়নশীল দেশে কর্মমুখী শিক্ষা যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর পাঁচ শতাংশ কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত। যেখানে বাংলাদেশে তার পরিমাণ মাত্র এক শতাংশেরও কম। এর কারণ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কর্মমুখী শিক্ষার প্রতি অনভিপ্রেত উপেক্ষা। এমনকি সাম্প্রতিককালে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, অনেক কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীতকরণের যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে এবং ইতোমধ্যে উন্নীত করা হয়েছে, তার মধ্যে কর্মমুখী শিক্ষার দিকটি যথেষ্ট উপেক্ষিত হয়েছে।

কর্মমুখী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বহুবিধ। এ শিক্ষা গ্রহণের পর একজন শিক্ষার্থীকে চাকরির জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও দারিদ্র্যবিমোচনে এ শিক্ষা সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। এ শিক্ষা নতুন কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা দেয়। আছে সুস্থ-সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ জীবন গঠনের অঙ্গীকার। কর্মমুখী শিক্ষায় দক্ষ জনশক্তিকে বিদেশে পাঠিয়ে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। তাই কর্মমুখী শিক্ষা আরো ব্যাপক হওয়া প্রয়োজন। কর্মমুখী শিক্ষার ওপর যত বেশি গুরুত্ব দেয়া হবে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা তত সুদৃঢ় হবে। তাই আমাদের উচিত- এ শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করা। এ শিক্ষার মধ্য দিয়েই দেশের অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন সম্ভব। বিভিন্ন ঘরে যে হতাশা আর দুঃখ দারিদ্র্যের চিত্র, এ শিক্ষা সেখানে দূর করবে তার দুঃখ-রজনীর হতাশা আর অন্ধকার। আবার উচ্চারিত হবে জীবনের জয়গান। উচ্চতর শিক্ষাক্ষেত্রে হ্রাস পাবে শক্তির অবাঞ্ছিত অপচয়। এ দেশবাসী আবার ফিরে পাবে তার হারানো সমৃদ্ধ অতীত। কর্মমুখী শিক্ষার ব্যাপক ও বাস্তব রূপায়ণের মধ্য দিয়েই এ দেশ হবে স্বনির্ভর। কর্মমুখী শিক্ষার মধ্যেই আছে সেই পথনির্দেশ।

বর্তমানে আমাদের দেশে কারিগরি শিক্ষা একেবারে সম্প্রসারিত হয়নি তা নয়। স্বাধীনতা অর্থবহ করে তুলতে হলে কর্মমুখী শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। তবে আশাব্যঞ্জক এই যে, বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারিপর্যায়ে কারিগরি, বৃত্তিমূলক শিক্ষার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হচ্ছে। দেশে প্রকৌশল, কৃষি, চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ইনস্টিটিউট, ভোকেশনাল, লেদার, সিরামিক, পাট, টেকনিক্যাল কলেজ, গ্রাফিক আর্ট ইনস্টিটিউট রয়েছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই কম। বস্ত্র শিল্প, জাহাজ শিল্প, চিনিকল, ইস্পাত ইত্যাদি শিল্পের দক্ষ কারিগর সৃষ্টির জন্য সহায়ক কর্মমুখী শিক্ষার দরকার রয়েছে। নতুন যুগোপযোগী জীবনসম্পর্কিত শিক্ষা পাঠ্যসূচি করতে হবে পর্যায়ক্রমে।

বিশ্বের অষ্টম জনবহুল দেশ হিসেবে আমাদের দেশে আছে অর্থনৈতিক সঙ্কট ও কর্মসংস্থানের অভাব। তাই আর বিলম্ব না করে আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও বিশ্বের জাতিগুলোর উন্নয়ন ও প্রগতির ধারার সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য শিক্ষাকে জীবনমুখী করে তোলার সময় এসেছে। জাতীয় প্রতিভার অপচয় আর অর্থনৈতিক প্রশ্ন বিবেচনায় এনে আমাদের এ ব্যাপারে সতর্ক ব্যবস্থা গ্রহণ একান্ত অপরিহার্য।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top