রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও তমদ্দুন মজলিস

আমাদের জাতীয় জীবনে সবচেয়ে গৌরবময় অর্জন নিঃসন্দেহে স্বাধীন বাংলাদেশ। আর এই অর্জনের পেছনে যেসব ঐতিহাসিক ঘটনা ঘুরে ফিরে স্মরণ করতে হয়, তার মধ্যে মহান রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম অন্যতম। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে পূর্ব বাংলায় যে আন্দোলন হয়েছিল, তারই ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত্তি তৈরি হয়। মূলত একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে এর সূচনা হলেও ক্রমান্বয়ে এটি একটি রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে এবং বাঙালি জাতিকে একটি রাজনৈতিক মঞ্চে ঐক্যবদ্ধ করে।

প্রতি বছর ভাষা আন্দোলনের স্মারক হিসেবে ফেব্রুয়ারি মাস আসে। আর আমরা একুশের চেতনায় উৎফুল্ল ও উদ্বেলিত হয়ে উঠি। সারা দেশে আলোচনা, সেমিনার ও সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠিত হয়। পত্র-পত্রিকায় প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখা হয়। যদিও এসব লেখার সবক্ষেত্রে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বা একুশের চেতনা সংক্রান্ত বস্তুনিষ্ঠ চিন্তন থাকে না।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয় জীবনের একটি সার্বজনীন আন্দোলন। ১৯৫২ সালে সমগ্র জাতির অংশগ্রহণে এটি সার্বজনীন আন্দোলনের রূপ নেয়। উল্লেখ্য, ভাষাসংক্রান্ত বিতর্কের শুরুটা কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির আগে থেকেই হয়েছিল। তবে পরিকল্পিত আন্দোলনের সূচনা হয় পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পরেই। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বহু সংগঠন ও ব্যক্তির অসামান্য অবদান রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ‘তমদ্দুন মজলিস’ নামক সংগঠনটি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করে। ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে তমদ্দুন মজলিস প্রতিষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেমের ১৯ নম্বর আজিমপুরের বাসায় একটি সভায় ‘তমদ্দুন মজলিস’ নামে এই সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়। তমদ্দুন মজলিস প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অধ্যাপক আবুল কাসেমের অগ্রণী সহযোগীদের মধ্যে ছিলেন দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, আবদুল গফুর, অধ্যাপক এ এস এম নূরুল হক ভূঁইয়া, অধ্যাপক আশরাফ ফারুকী, শাহেদ আলী, বদরুদ্দীন উমর, হাসান ইকবাল প্রমুখ। আবুল কাসেম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৯ সালে তমদ্দুন মজলিসের সভাপতি হন দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ।

তমদ্দুন মজলিসের ‘সৈনিক’ নামে একটি সাপ্তাহিক বাংলা মুখপত্র ছিল। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪৮ সালের ১৪ নভেম্বর (২৮ কার্তিক ১৩৫৫)। শুরুতে এর সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি ছিলেন শাহেদ আলী, পরে সভাপতি হন আবদুল গফুর। ১৯৬১ সাল পর্যন্ত পত্রিকাটি চালু ছিল।

উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগের বিরুদ্ধে বস্তুত তমদ্দুন মজলিসই প্রথম সংগঠিত ও পরিকল্পিত উপায়ে প্রতিবাদ উত্থাপন করে এবং বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে গণ-আন্দোলনের প্রেক্ষাপট রচনা করে।

তমদ্দুন মজলিসের নেতৃত্বেই ১৯৪৭ সালের ১ অক্টোবর প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এ পরিষদের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন মজলিস নেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ এস এম নূরুল হক ভূঁইয়া এবং কোষাধ্যক্ষ হন তমদ্দুন মজলিসের সাধারণ স¤পাদক অধ্যাপক আবুল কাসেম। এভাবেই প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের একটি সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি হয়। নভেম্বর মাসে আবুল কাসেম ও তার সহযোগীরা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের স্বাক্ষর নিয়ে সরকারের কাছে স্মারকলিপি পাঠান। উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার একতরফা সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যা¤পাসে আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়।

রাষ্ট্রভাষার দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এটি ছিল সর্বপ্রথম সাধারণ ছাত্রসভা। ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালে আবুল কাসেম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কয়েকজন সদস্যসহ কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান খানের সঙ্গে, ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ অধ্যাপক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল মন্ত্রী হাবীবুল্লাহ বাহার, নুরুল আমিন ও গিয়াস উদ্দীন পাঠানের সঙ্গে এবং পরে খাজা নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ভাষাসংক্রান্ত সংশোধনী প্রস্তাব নাকচ হলে ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে প্রতিবাদ সভা হয় এতে সভাপতিত্ব করেছিলেন আবুল কাসেম। বাংলাকে অবিলম্বে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্বপাকিস্তানের সরকারি ভাষা বলে ঘোষণা করার দাবিতে তমদ্দুন মজলিস ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের যুগ্ম রাষ্ট্রভাষা সাব কমিটির সিদ্ধান্ত ১১ মার্চ ১৯৪৮ সমগ্র পাকিস্তানে সাধারণ ধর্মঘট ডাকা হয়।

১৯৪৮ সালে ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে তমদ্দুন মজলিস এবং মুসলিম ছাত্রলীগের যৌথ সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠন ও সম্প্রসারিত করা হয়। পরিষদে এই দুই সংগঠনের বাইরেও আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও অন্য দলীয় পরিচয়ের ব্যক্তিদের যুক্ত করা হয়। এটিই দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ বা প্রথম সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ নামে পরিচিত। ১৫ মার্চ প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে বৈঠকে বসে আট দফা চুক্তি সই করলেন, যাতে প্রধানমন্ত্রী স্বীকার করলেন যে, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার বিষয় গণপরিষদে তোলা হবে। বর্ধমান হাউজে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে তমদ্দুন মজলিসের আবুল কাসেম, কামরুদ্দীন আহমদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

কিন্তু পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ২১ মার্চ ১৯৪৮ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করলে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এর প্রতিবাদে ২২ মার্চ আবুল কাসেম ও শাহেদ আলী তমদ্দুন মজলিসের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি দেন। ২৪ মার্চ ১৯৪৮ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটি প্রতিনিধিদল গভর্নর জেনারেলের সাথে সাক্ষাৎ করে একটি স্মারকলিপি দেন। এ প্রতিনিধিদলে ছিলেন আবুল কাসেম ও কামরুদ্দীন আহমদ প্রমুখ।

এরপর ১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তান গণপরিষদের সাংবিধানিক মূলনীতি কমিটির রিপোর্টে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করা হয়। একই সময় প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান গণপরিষদে একই কথা বললে পূর্ব বাংলায় প্রচণ্ড বিক্ষোভের সৃষ্টি করে। ভবিষ্যতে ভাষা আন্দোলন পরিচালনার উদ্দেশ্যে ছাত্রনেতা আবদুল মতিনকে আহ্বায়ক করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ১৯৫২ সালের শুরুতেই পূর্ব বাংলায় ভাষা আন্দোলন নতুন মাত্রা লাভ করে। ১৯৫২ সালে ২৬ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে জনসভায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র ‘রাষ্ট্রভাষা’ হিসেবে ঘোষণা করায় পুনরায় আন্দোলনের গতি সঞ্চারিত হয়। দেশব্যাপী ধর্মঘট ও হরতাল কর্মসূচি পালন করা হয়।

৩১ জানুয়ারি মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনে সমগ্র পূর্ব বাংলায় হরতাল, জনসভা ও বিক্ষোভ কর্মসূচি গ্রহণ করে। সরকার ঘোষিত ১৪৪ ধারা অগ্রাহ্য করে ওই দিন ছাত্র-জনতা রাজপথে নেমে এলে পুলিশের গুলিতে রফিক উদ্দিন, আবুল বরকত, আবদুল জব্বার ঘটনাস্থলে শহীদ হন।

ভাষার আন্দোলনে তমদ্দুন মজলিসের অবস্থানজনিত কারণে তাদের আদর্শে বিশ^াসী না হয়েও এদেশের উদার ও মুক্তবুদ্ধির বিশিষ্ট জনগোষ্ঠীও এ সংগঠনের পক্ষে তাদের সমর্থন জুগিয়েছে। আর এ সমর্থন নিয়ে তমদ্দুন মজলিস অত্যন্ত সফলভাবে দীর্ঘ পাঁচ বছর ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে এবং সামাজিক প্রত্যয় ও রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্বিশেষে দেশের সব জনগোষ্ঠীকে এর সাথে স¤পৃক্ত করে ভাষা আন্দোলনকে একটি জাতীয় ইস্যুতে পরিণত করেছে।

ভাষা আন্দোলনে তমদ্দুন মজলিসের অগ্রণী ভূমিকা আজ অনেকেই উল্লেখ করতে চান না। ভাষা আন্দোলনের উৎপত্তি ও উৎসের ইতিহাস আজ সচেতন ও সূক্ষ্মভাবেই খণ্ডিত করা হয়। কিন্তু ইতিহাস চাপা দিয়ে রাখা যায় না। সুদীর্ঘ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ঐতিহ্য ধারণ করে তমদ্দুন মজলিস এখনো টিকে আছে। যদিও আগের মতো প্রাণবন্তু ও সক্রিয় নয়।
লেখক : অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top