সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে শুক্রবার দিনব্যাপী জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। গণশুনানিতে ধানের শীষের প্রার্থীরা ছাড়াও নির্বাচনে যারা বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন তাদের অভিজ্ঞতা শোনা হয়। সকাল দশটায় টায় কোরআন তেলাওয়াত, গীতা ও ত্রিপিটক পাঠের মাধ্যমে গণশুনানি শুরু হয়। গণশুনানিতে ৭ সদস্যের বিচারক প্যানেলের প্রধান হিসেবে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা নেতা ড.কামাল হোসেন। মঞ্চে অন্যদের মধ্যে অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ, নুরুল আমিন বেপারী, মহসিন রশীদ, আনিসুর রহমান খান, অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী ও আসিফ নজরুল উপস্থিত ছিলেন।
শুরুতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডে নিহত ও আহতদের স্মরণে শোকপ্রস্তাব উপস্থাপন করেন। এরপরে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এসময় মির্জা ফখরুল বলেন, গত ৩০ ডিসেম্বর দেশে তথাকথিত একটি প্রহসনের নির্বাচন করা হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় কারাগারে আটক রাখা হয়েছে। দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকার কারণে দেশে যা ইচ্ছা তাই করছে সরকার। তাকে কোনো কিছুর জন্য জবাবদিহিতা করতে হয় না।
অপরদিকে শুনানির শুরুতে ড. কামাল হোসেন বলেন, আমরা বিচারক না, কোনো বিচার করার ক্ষমতা আমাদের নেই, কর্তব্যও নেই। গণশুনানি হচ্ছে, জনগণের উদ্দেশ্যে প্রার্থীরা বক্তব্য দেবেন। বিচার যেটা হচ্ছে সেটা ট্রাইব্যুনালে হবে। আর গণআদালত যেটা বলা হয়, সেটার বিচার জনগণ করবে। আমরা এসেছি অনুষ্ঠানটা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা হোক, সেজন্য। যে বক্তব্যগুলো আসবে সেগুলো পরে প্রকাশ করা হবে। বই আকারেও প্রকাশ করা হবে। সবার বক্তব্য রেকর্ড করা হবে। এই গণশুনানির মূল উদ্দেশ্য সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধা জানোনো। সংবিধানে আছে এ দেশের জনগণ এই দেশের মালিক। ভোটাধিকার রক্ষা করার জন্য আমরা স্বাধীনতাযুদ্ধ করে জয়ী হয়েছিলাম। এবার যে নির্বাচন হয়েছে, সেটা নিয়ে প্রার্থীদের অনেকে ট্রাইব্যুনালে মামলা আকারে ফাইল করেছেন। মামলা ফাইল করা হয়েছে, সেটা হবে। কিন্তু জনগণ ক্ষমতার মালিক হিসেবে তাদেরও জানানো দরকার।
ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী ও গণফোরামের সভাপতিমণ্ডলির সদস্য রেজা কিবরিয়া অভিযোগ করে বলেন, সাদাপোশাকে তার কর্মীদের তুলে নেওয়া হয়। নির্বাচনের দেড় মাস আগে থেকেই কর্মীরা বাড়িছাড়া হয়েছেন। অনেকে ভোটের আগে মামলা-হামলা ভয়ে হাওরের বিভিন্ন এলাকায় পালিয়ে থাকতে হয়েছে।
গণশুনানিতে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী এস এম আকরাম বলেন, সভা-সমাবেশ করতে মঞ্চ তৈরির জন্য নিজের এলাকা থেকে লোক পাওয়া যায় না। বাইরে থেকে লোক আনতে গেলে বাধা দেওয়া হয়। এমনকি মুন্সিগঞ্জ থেকে মাইক ভাড়া করে আনতে হয়েছিল বলে তিনি জানান। তবে এত কিছুর পরও মানুষ ভোট দিতে পারবে এমন আসা ছিল তার বলে জানান তিনি। কিন্তু তা হয়নি।
রাজশাহীর সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনু বলেন, নির্বাচনের আগে তার এলাকায় মোড়ে মোড়ে নেতাকমীদের বিভিন্ন ধরণের সাদা পোশাকের বাহিনী কড়া নজরদাড়িতে রাখে। দিনভর কড়া নজরদাড়ির আর হামলা ভয়ে তারা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতেই পারেনি। তিনি বলেন, ভোট ডাকাতির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়েছে, জয়ী হয়েছে ঐক্যফ্রন্ট।
ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থী জেএসডি নেতা সাইফুল ইসলাম জানান, তার এলাকায় বিএনপি জোয়ার দেখে মুগ্ধ হন। তিনি বলেন, সঠিক নির্বাচন হলে অবশ্যই ঐক্যফ্রন্ট জয়লাভ করতে।
বিএনপি নেতা রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন ছবি বলেন, নির্বাচনে তার সাথে দলের পুরুষ কর্মী রেখে বিপাকে পড়তে হয়েছে। কারণ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা প্রশাসনের সহায়তায় তাদের হাতুড়ি পেটা করত। আর এজন্য নারী কর্মী নিয়ে প্রচারণা চালাতে হয়েছিল বলে তিনি জানিয়ে বলেন, তাতেও লাভ হয়নি কারণ তারা ভোট ডাকাতির মাধ্যমে নির্বাচিত হতে চেয়েছিল।
অপর এক প্রার্থী আবুল হোসেন তার নির্বাচনী এলাকার বর্ননা তুলে ধরে বলেন, শুধু ঐক্যফ্রন্টই নয় আওয়ামী লীগ সমর্থিত ভোটারাও ভোট দিতে পারেনি।
বিএনপি নেতা শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি বলেন, বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব জানে কিভাবে তার এলাকায় ভোট ডাকাতির মঞ্চায়ন হয়েছে। তিনি বলেন, এধরণের ঘটনায় সারা দেশের জনগণকে প্রতিবাদ করতে হবে। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনই পারবে জনগণের বিজয় ফিরিয়ে আনতে, গনতন্ত্র মুক্ত করতে।
গাজীপুর-৩ (শ্রীপুর) আসনে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী ইকবাল সিদ্দিকী বলেন, একের পর এক মামলা দিয়ে ঐকফ্রন্টের নেতাকর্মীদের কার্যত এলাকা ছাড়া করে দেয় নির্বাচনের অনেক আগেই। প্রশাসনের সহায়তায় তারা মসজিদের খতিব প্রবীণ আলেমকে মামলা থেকে রেহাই দেয়নি।
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কন্যা কুড়ি সিদ্দিকী বলেন, ‘এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ চোর হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। আর ঐক্যফ্রন্ট প্রকৃত অর্থেই বিজযী হয়েছে। ঐক্যফ্রন্ট মানুষের মন পেয়েছে আর আওয়ামী লীগ তাদের মন থেকে চিরতরে মুছে যাচ্ছে।’
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিব জানান তার এলাকায় ২৯ ডিসেম্বর রাতে একদফা ভোট কাস্ট হয়ে গেলেও প্রশাসন পুরোপুরি বিজয়ী হবার ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল না। আর এজন্য দিনের বেলায়ও ‘ভোট চুরি’ করতে কেন্দ্রে মাহোৎসবে মেতে উঠে তারা। আর এ ধরণের কর্মকাণ্ডে প্রতিবাদ করতে যাওয়ায় তাকে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা প্রশাসনের সহায়তায় কুপিয়েছে বলে জানান।
সিরাজগঞ্জের ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী রুমানা মাহমুদ অভিযোগ করেন, তার প্রচার মিছিলে পুলিশ গুলি চালিয়েছে। গুলিতে তার কর্মী মেরী বেগমের দুই চোখ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এসময় তিনি মেরী বেগমকে নিয়ে মঞ্চে ওঠেন। তার বক্তব্য শুনে অনেকে অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। মেরী বলেন, তাকে ভোট দেওয়ার অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে, নয়তো চোখ ফেরত দিতে হবে। তিনি আরো বলেন, জেলায় জেলায় গণআদালত বসিয়ে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। ওই আদালতে জনগণ তার রায় দেবে। এক দফা কর্মসূচি দিয়ে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার দাবি জানান তারা।
যশোর (৩ আসন) প্রার্থী অনিন্দ্য ইসলাম অমিত বলেন, নির্বাচনের আগে আমার উপর তিন দফায় হামলা হয়েছে, আমার এক হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তিনি বলেন, ভোটের দিন সকাল ১০ টার মধ্যে সব ব্যালট শেষ হয়ে যায়। এটা কিসের ভোট হয়েছে। প্রশাসনের সহযোগিতায় ‘ভোট ডাকাতি’ হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
লেবার পার্টির চেয়ারম্যান পিরোজপুর-২ আসনের প্রার্থী ডাঃ মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, দেশে ৩০ ডিসেম্বর ভোট হয়নি, হয়েছে ডাকাতি। তিনি অভিযোগ করেন, তার এলাকায় এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করা হয় যা অতীতে কোন আমলেই তা হয়নি। তিনি বলেন, একমাত্র ঐকবদ্ধ আন্দোলনই পারবে ভোট ডাকাতির এ ধরণের ফলাফল বাতিল করে দিয়ে সুষ্ঠু নিবৃাচনে পথ তৈরি করতে।
নরসিংদী থেকে নির্বাচন করা ঐকফ্রন্ট প্রার্থী বিএনপি নেতা খায়রুল কবির খোকন বলেন, নির্বাচনে অনেক আগ থেকে তার এলাকায় প্রশাসন এমনভাবে এলাকা কর্ডন করে রাখে যেনো কেউ কোন প্রচারণাও চালাতে না পারে। তিনি বলেন, ধানের শীষের গণজোয়ারে ভয়ে তারা সারা দেশেই এক ভীতিকর পরিস্থিতির তৈরি করে।
বরিশাল-৪ (হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জ) আসনের ঐক্যফ্রন্ট মনোনীত (ধানের শীষ) প্রার্থী নাগরিক ঐক্যের নেতা নুরুর রহমান জাহাঙ্গীর জানান কিভাবে তাকে ও তার নেতাকর্মীদের বেদম প্রহার করে। আর মামলার জালে ফেলা হয় নেতাকর্মীদের।