পুরনো ঢাকার চকবাজার মডেল থানার উল্টো পাশের অদূরে নন্দ কুমার রোডে বুধবার রাতে স্মরণকালের দ্বিতীয় বৃহত্তম অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে।
নবাব কাটরা ট্রাডেজির পর ‘চকবাজার ট্রাজেডিতেও’ মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে নিভে গেল ৮১ তাজা প্রাণ। এরমধ্যে বেশির ভাগই পথচারী।
স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি মোতাবেক মৃতের সংখ্যা শতাধিক ছাড়াতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত নিখোঁজ কতজন রয়েছেন সেই হিসাব পাওয়া যায়নি। নন্দ কুমার রোডের ৫ রাস্তার মোড়ে ভয়াবহ আগুনের উৎপত্তিস্থল হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের আশপাশে পড়ে আছে অর্ধশতাধিক পোড়া গাড়ি। এরমধ্যে প্রাইভেট কার, পিকআপ ভ্যান, রিকশা, ঠেলাগাড়ি, মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল রয়েছে। এসব যানবাহনের চালক, যাত্রীদের প্রত্যেকে দুর্ঘটনার সময় এ রাস্তা দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন।
এ দিকে আগুনের সূত্রপাত হওয়া নিয়েও রয়েছে ধূম্রজাল। কেউ বলছেন, হাজী ওয়াহেদ মঞ্জিল লাগোয়া জামাল সরকার কমিউনিটি সেন্টারে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় প্রাইভেট কারের সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়েই আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। আবার কেউ বলছেন, হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনে দাঁড়ানো পিকআপভ্যানের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পর পাশের হোটেলে থাকা এলপি গ্যাস সিলিন্ডারে লাগে। এরপর সেটি বিস্ফোরিত হয়ে উপরে থাকা ভবনের দ্বিতীয় তলার স্প্রে গোডাউনে আগুন লেগে সেখান থেকে আগুন দ্রুত চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে।
গতকাল ঘটনাস্থলে সরেজমিন খোঁজ নিতে গেলে দেখা যায়, আগুনে বাবুল মিয়ার ৬ তলা ভবন, পাশের হাজী ওয়াহেদ ম্যানশন ভবন, উল্টো পাশের দুটি ভবন ও পশ্চিম-উত্তর পাশের দ্বিতীয় একটি ভবন ও দক্ষিণ পাশের একটি ভবনের আংশিক বিধ্বস্ত হয়। আগুনে এসব ভবনে থাকা সব মালামাল পুড়ে যায়। আগুন থেকে বাঁচতে এ সময় ভবনের বাসিন্দারা বের হয়ে যান বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। যে স্থানে আগুনের সূত্রপাত সেই মোড়টিকে ৫ রাস্তার মোড় হিসাবে চেনেন সবাই। চকবাজার থেকে রহমতগঞ্জের দিকে যাওয়ার রাস্তার উপর পোড়া পিকআপ ভ্যান দু’টি, রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, মোটরসাইকেল টালি গাড়ি, ঠেলাগাড়ি, অটোরিকশা পড়ে থাকতে দেখা যায়। পরে পোাড়া গাড়ি গুণে দেখা যায় ৫১টি গাড়ি পড়ে আছে ঘটনাস্থলে। খাজে দেওয়ান রোডের দিক দিয়ে জামাল সরদার কমিউনিটি সেন্টারের দিকে যেতে দুটি প্রাইভেটকার পড়ে আছে। এরমধ্যে পাশের মসজিদের সামনে ডিম বিক্রেতার ভ্যানগাড়ি পড়ে রয়েছে।
স্থানীয় এলাকাবাসী শাহীন আলম এ প্রতিবেদককে বলেন, এ দিন আশপাশের সবগুলো রাস্তায় ব্যাপক যানজট থাকার কারণে অনেক গাড়িই নন্দকুমার রোডের সরু রাস্তাটি ব্যবহার করছিল। একপর্যায়ে যানজটের কারণে এই রাস্তায় সবগুলো যানবাহন আটকা পড়ে। এ ছাড়া অনেকেই হেটে যাওয়ায় এই রাস্তাটিতে মানুষের ভিড় লেগে যায়। কে জানত এখানেই অপেক্ষা করছে ভয়াবহ আগুন ট্রাজেডি। তিনি আগুন লাগার সময়ের বর্ণনা দিয়ে এ প্রতিবেদককে বলেন, আগুন যখন লাগে তখন সময় আনুমানিক রাত ১০টা ১৭ মিনিট। আমার বাসা থেকে ৫ রাস্তার মোড় দেখা যায়। বেলকুনিতে দাঁড়ানো অবস্থায় হঠাৎ বিকট শব্দ শুনতে পাই। এরপর শুধু শব্দ আর শব্দ। এরপরই আগুনের গোলা দেখি উপরে উঠছে।
তিনি রাস্তায় পড়ে থাকা পোড়া প্রাইভেট কার দেখিয়ে বলেন, এই গাড়িতে করে সম্ভবত বিয়ের গায়ে হলুদে অংশ নিতে আসা যাত্রীরাও যানজটে পড়েন। পরে যাত্রীরা নেমে হেঁটে অনুষ্ঠানে যান। চালক গাড়িতেই থাকেন। ২ মিনিটের মধ্যে দেখি আগুনের লেলিহান শিখা। পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে বুঝতে পেরে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে খাজে দেওয়ানের রাস্তা দিয়ে বের হয়ে যাই। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমরা শুনেছি ৭০ জন মারা গেছে। কিন্তু এখানে যতগুলো গাড়ি পড়ে আছে এরমধ্যে এরা কেউ আর ফিরে যেতে পারেনি। স্পট ডেড হয়েছে। দু-একজন শুনেছি দৌড় দিয়ে প্রাণে বেঁচেছেন। সেই তুলনায় শতাধিক লোক মারা গেছেন। যারা মারা গেছেন তাদের বেশির ভাগই পথচারী। কোনো গাড়িতে তিনজন, কোনো গাড়িতে চার-পাঁচজনও ছিলেন।