আওয়ামী লীগের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে কিছু বলার আগে দলটির সফলতা নিয়ে কিছু বলা দরকার। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত সময়কে হিসাবের মধ্যে এনে আমরা যদি বিগত ১০ বছরের সফলতার খতিয়ান পর্যালোচনা করি, তবে দলটির কিছু মৌলিক সফলতা দেখতে পাবো। ৩০ ডিসেম্বরের ন্যক্কারজনক ঘটনা না ঘটলে আওয়ামী লীগের সেসব মৌলিক সফলতা টেকসই উন্নয়ন এবং স্বীকৃত ঐতিহ্য রূপে দলটির কপালে রাজতিলক হিসেবে মহাকালের ইতিহাসে উজ্জ্বলতা ছড়াত। আজকের লেখায় আমি বিগত দিনে আওয়ামী লীগের কিছু মৌলিক সফলতা এবং সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া কথিত সংসদ নির্বাচনের ভূমিধস বিজয়ের কাগুজে ফলাফলের বায়বীয় রসায়নের ফলে সৃষ্ট দীর্ঘমেয়াদি ক্ষয়ক্ষতির তুলনামূলক আলোচনার চেষ্টা করব।
১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৮০ সাল অবধি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যে কী অবস্থা ছিল, তা কেবল ভুক্তভোগীরাই বলতে পারবেন। ওই সময় পরিধিতে যারা বিদেশে পালিয়ে ছিলেন অথবা নিজ জেলা ছেড়ে অন্য জেলায় গিয়ে বসতি স্থাপন করেছিলেন, তারা কিছুতেই অনুধাবন করতে পারবেন না যে, দরিদ্র মানুষজন যারা আওয়ামী লীগকে ভালোবাসেন এবং সমর্থন করতেন তাদের জীবনে কত বড় বিপর্যয় নেমে এসেছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর যারা বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের আওয়ামী লীগ সমর্থকেরা টিটকারি, ঠাট্টা-মশকারা এবং ক্ষেত্রবিশেষে সমাজের অস্পৃশ্য শ্রেণীতে পরিণত হন, তাদের সেকালের দুর্ভোগ-দুর্দশার মূল কারণগুলো- আওয়ামী লীগ আজো খুঁজে বের করার চেষ্টা করেনি। স্বাধীনতাযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী একটি দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের বিরাট অংশ কেন মাত্র সাড়ে তিন বছরের আওয়ামী শাসনের করুণ যবনিকাপাতের পর সমাজে নিগৃহীত হতে থাকল, তার অন্তর্নিহিত কারণগুলো বের না করার কারণে আজকের আওয়ামী লীগ বুঝতে পারছে না যে, তারা আসলে কোন পথে এগোচ্ছে।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরার পর বঙ্গবন্ধু এক অদ্ভুত সমস্যায় পড়লেন। চতুর্মুখী অভ্যন্তরীণ চাপ এবং বহুমুখী বৈদেশিক চাপের কারণে তার উদার চিন্তা-চেতনা ও গণতান্ত্রিক মন-মানসিকতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। প্রয়াত সাংবাদিক এম আর আখতার মুকুল তার ‘মুজিবের রক্ত লাল’ বইতে অত্যন্ত খোলামেলাভাবে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে তার অসহায়ত্বগুলো ফুটিয়ে তুলেছেন। বঙ্গবন্ধুর প্রথম সমস্যা ছিল তার নিজ পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়স্বজনের অনুদার আচরণ। তাদের বেশির ভাগ রাষ্ট্রক্ষমতা এবং বঙ্গবন্ধুর সাথে তাদের আত্মীয়তাকে নেয়ামত হিসেবে ব্যবহার না করে হাতিয়ার অথবা অলঙ্কাররূপে ব্যবহার করে ক্রমেই বঙ্গবন্ধুকে গণমানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিলেন। রাজনীতি, অর্থনীতি, সরকারি প্রশাসন এবং পররাষ্ট্রনীতিতেও পঞ্চপাণ্ডব দিয়ে আক্রান্ত হতে থাকে। ওই পাণ্ডবগুলো হলো- মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া লোকজন, যারা নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা না বলতে পেরে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও নেতা পরিচয় দিয়ে দাপিয়ে বেড়াতে লাগলেন।
উল্লিখিত গ্রুপটি ছাড়া আরো চারটি গ্রুপ ছিল, যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি। কেউ কেউ সরকারি চাকরিতে ছিলেন এবং ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান সরকারের অনুগত ছিলেন। এই শ্রেণীটির সাথে স্বাধীনতার আগে আওয়ামী লীগের যোগাযোগ ছিল। তারা মনে মনে আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলেন এবং ক্ষেত্রবিশেষে বুদ্ধিশুদ্ধি ও টাকা দিয়ে দলকে সাহায্য করতেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর তারা তাদের দুর্বলচিত্ত অথবা কায়েমি স্বার্থের কারণে পাকিস্তান সরকারের পক্ষে থাকেন এবং হয়তো মনে মনে মুক্তিযুদ্ধের সফলতার জন্য দোয়া-দরুদ পড়ার পাশাপাশি ঝাড়ফুঁক নিতে আরম্ভ করেন। স্বাধীনতার পর এই শ্রেণীটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ক্ষমতার বলয়ে ঢুকে আলাদা রসায়ন সৃষ্টি করে।
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তিনটি গ্রুপ যথা- মুক্তিযোদ্ধা, অমুক্তিযোদ্ধা এবং পাকিস্তান প্রত্যাগতরা ত্রিমুখী ধারায় বিভক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু সরকারের বারোটা বাজাচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুর জন্য সবচেয়ে বড় বিপত্তির কারণ হয়েছিল ছাত্রলীগের প্রকাশ্য তিনটি গ্রুপ এবং অপ্রকাশ্য বহু গ্রুপ। ধড়িবাজ ব্যবসায়ী, দালাল-ফড়িয়া, সুবিধাবাদী চাটুকার, চোরাকারবারি এবং গুণ্ডা-বদমাশেরা রাতারাতি একটি সিন্ডিকেট তৈরি করে বঙ্গবন্ধুর কাছে কোনো আত্মীয় বা প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতার ছত্রছায়ায় ব্যবসায়-বাণিজ্য, ব্যাংক-বীমা, আমদানি-রফতানি, ঠিকাদারি, সরবরাহ ইত্যাদি সব কিছুকে প্রশ্নবিদ্ধ, বিতর্কিত ও কলঙ্কিত করে ফেলে। ফলে আমরা আজো লবণ চোর, কম্বল চোর, ব্যাংক লুটেরাদের কথা বললে তাদের মানসপিতা হিসেবে যাদের নাম চলে আসে তারা ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সাল অবধি সবাই মিলে আওয়ামী লীগের সর্বনাশ করেছিল।
পঞ্চম গ্রুপটি ছিল প্রভাবশালী বিদেশী রাষ্ট্রের এদেশীয় এজেন্ট যারা সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী, আমলা, ধর্মীয় নেতা প্রভৃতি পরিচয়ে অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও নির্মমভাবে সরকারের বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুকে ব্যক্তিগতভাবে কথা ও লেখনীর মাধ্যমে অপমাণিত করে তাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলেন। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা, সৎ ও দক্ষ আমলা, বঙ্গবন্ধুর যোগ্য রাজনৈতিক সহকর্মী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এমনকি রাজনৈতিক শত্রুরাও উল্লিখিত পঞ্চপাণ্ডবদের যন্ত্রণায় রীতিমতো অসহায়, নির্জীব ও ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েন। পঞ্চপাণ্ডবেরা বঙ্গবন্ধুর পঞ্চম ইন্দ্রীয়ের ওপর এমনই প্রভাব বিস্তার করেন যে, তিনি ১৯৭৫ সালের গোড়ার দিকে বুঝতেই পারলেন না, কেন ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ হলো? তিনি সব সমস্যা সমাধানের একমাত্র মহৌষধ হিসেবে বাকশালকে বেছে নিলেন এবং তিনি নিজেসহ তার আপনজন, নিরীহ, অন্ধ অনুরক্ত ও সুবিধাবঞ্চিত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিপদে ফেলে দিলেন।
আওয়ামী লীগের উপরোল্লিখিত বদনামি এবং বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যেই দলটির শীর্ষ নেতৃত্বে পরিবর্তন আসে আশির দশকের প্রথম দিকে। সামরিক শাসক হিসেবে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তার ৯ বছরের শাসনামলে দেশের পুরো রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, আর্থিক ব্যবস্থাসহ নির্বাচনী পদ্ধতি, সামাজিক সংহতি, মানবিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় চেতনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন আনেন; তাতে কেবল মন্দের জয়জয়কার সূচিত হতে থাকে। তিনি রাষ্ট্রীয় কোষাগার এবং রাষ্ট্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং গোলাবারুদ-বুলেট-বন্দুক সব কিছু নিজের ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও ভালো লাগা-মন্দ লাগার সাথে একীভূত করে এক শৈল্পিক ও কাব্যিক রূপ দান করেন। ফলে সারা দেশে শুরু হয় নীতি-নৈতিকতার ভাঙন এবং সামাজিক পচনশীলতা পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। তিনি ইচ্ছেমতো দল গড়ে থাকেন- আবার ক্ষণিক পরে তা ভাঙতে থাকেন। তিনি সরকারি অর্থে দয়া-দাক্ষিণ্য প্রদর্শন, দান-খয়রাত ইদ্যাদি আরম্ভ করার পাশাপাশি রাজপথের বিরোধী দলের মধ্যে বেঈমান ও মুনাফিক পয়দা করার প্রকল্প সফলভাবে চালু করেন।
এরশাদ তার শাসনামলের প্রথম দিকে বিএনপির সাথে মৈত্রী করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরে তিনি বিএনপি ভাঙার চেষ্টা করেন এবং বেশির ভাগ শীর্ষ বিএনপি নেতাকে ছলে-বলে-কৌশলে নিজ দলে ভিড়িয়ে নেন। ফলে বিএনপির বিপুল জনসমর্থন একটি নেতৃত্ববিহীন অবস্থায় বর্তমান জমানার চেয়েও ভয়ঙ্কর অসহায় অবস্থায় নিপতিত হয়। এরশাদ এক দিকে বিএনপি ধ্বংসের প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং অন্য দিকে অনুগত ও বিশ্বস্ত বিরোধী দল সৃষ্টির পাঁয়তারার অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতকে যুগপৎভাবে পেয়ে যান তার মিত্র হিসেবে। ফলে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত এরশাদের অধীন নির্বাচন করে সংসদে স্থান করে নেয়। কিন্তু কিছু দিন পর তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে সংসদ ছেড়ে পুনরায় রাজপথে ফিরে আসে এবং বিএনপিসহ অন্যান্য আন্দোলনরত দলের সাথে একত্র হয়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে।
আশির দশকের রাজপথের আওয়ামী লীগ অথবা এরশাদের সাথে গোপন মৈত্রীর আড়ালে সংসদে বিরোধী দলের স্বীকৃতি ও সুবিধা লাভ, পরবর্তীকালে সংসদ থেকে পদত্যাগ, নিজ দলের অভ্যন্তরীণ কলহে প্রয়াত জাতীয় নেতা আবদুর রাজ্জাকের দলত্যাগ, মেয়র হানিফের দলত্যাগসহ নানান ঘটনায় দলটি অতীতের বদনামি কাটিয়ে উঠতে ব্যর্থ হয়। অধিকন্তু অস্থিরচিত্ত, বিশ্বাসহীনতা, কলহপ্রিয়তা ইত্যাদি বিশেষণে অভিষিক্ত হয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। ফলে এরশাদ সরকারের পতনের পর প্রচুর সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে তারা পরাজিত হয়। পরবর্তীকালে ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে তারা ক্ষমতায় এলেও নিজেদের রাজনীতির জন্য মৌলিক কিছু করতে পারেনি। ব্যাপক উন্নয়ন, ক্ষেত্রবিশেষে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সমাজে আপাত শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে পারলেও তারা জনমানুষে নানামুখী বিরক্তি উৎপাদন এবং হাস্যকর কর্মকাণ্ড করে নিজেদের ভাবগাম্ভীর্য নষ্ট করে ফেলে। ফলে ২০০১ সালের নির্বাচনে তারা অনিবার্যভাবে পরাজিত হয়।
এক-এগারোর নতুন প্রেক্ষাপট এবং নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দলের রাজনীতির জন্য কতগুলো মৌলিক সিদ্ধান্ত নেয়। তারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বাস্তবায়ন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং তা জনমানসে প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নেয়। ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্ব যদি জাতীয় রাজনীতির নিয়ামক হয় তাহলে কী ফলাফল হতে পারে, তা বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের প্রথম বছরের অভিজ্ঞতা এবং আশির দশকে ও নব্বইয়ের দশকে ছাত্রলীগের ভাঙনের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে তারা ছাত্রলীগের নেতৃত্বের বয়সসীমা ও ছাত্রত্বের মাপকাঠি নির্ধারণ করে দেয়। ১৯৯৬ সালের শাসনামলের লোক হাসানো কর্মকাণ্ডের লাগাম টেনে ধরা হয় এবং দলীয় প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার ভাবমর্যাদা ও সর্বময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করা হয়। দলের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করা হয় এবং সাংগঠনিক কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন এনে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর নেতৃত্বকে নানা রকম সুযোগ-সুবিধা দিয়ে দলের প্রতি একনিষ্ঠ করে তোলা হয়।
উল্লিখিত বিষয়গুলোর সাথে ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল অবধি সরকারের নানা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড, বিরোধী দলের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করা এবং দেশের সামগ্রিক রাজনীতি, অর্থনীতি, সংবাদমাধ্যমে বুদ্ধিজীবী মহল, শিক্ষাঙ্গন এবং সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নিজেদের মিত্র কাম-তাঁবেদার সৃষ্টির সফলতা যোগ হয়ে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশে অনেক ইতিবাচক সম্ভাবনা তৈরি হয়। যারা শেখ হাসিনাকে নিয়ে অতীতকালে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতেন, তারা নতুন প্রেক্ষাপটে চুপ হয়ে যেতে বাধ্য হন- নতুবা এ কথা মেনে নেন যে, শেখ হাসিনার বিকল্প বাংলাদেশে নেই। বঙ্গবন্ধুকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের মধ্যে ইতিবাচকতা লক্ষ করা যায়। আওয়ামী লীগবিরোধী লোকজন যারা কোনো দিন বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা তো দূরের কথা- কোনো সম্মানিত উপাধিতে ভূষিত করতেন না তারাও সার্বিক পরিস্থিতিতে চুপ হয়ে যান। ছাত্রলীগ ও যুবলীগ সম্পর্কে বিরোধী গ্রুপের ব্যাপক নেতিবাচক প্রচার-প্রপাগান্ডা সত্ত্বেও সংগঠন দুটোর গত ১০ বছরের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে অর্থ, নারী ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক কোনো বদনাম হয়নি যেভাবে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠনগুলোর নেতাদের বিরুদ্ধে অতীতকালে হয়েছিল।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ-পদবি, তার বাসভবন অর্থাৎ গণভবন এবং তার কার্যালয় গত ১০ বছরে ক্ষমতা, নির্ভরতা ও বিশ্বস্ততার একটি ভিন্নতর প্রতীকে পরিণত হয়েছিল, যা ২০০৯ সালের আগে কোনো কালে ছিল না। বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর গুণাবলি তার বিরোধীরা স্বীকার করে নিতে আরম্ভ করেছিলেন। এই কিছু দিন আগেও যারা তার অধীনে নির্বাচনের কথা কল্পনা করতেন না- তারাও অবলীলায় শেখ হাসিনাকে মোটামুটিরূপে আস্থায় এনেছিলেন। এসবের বাইরে সাধারণ জনগণের সাথেও আওয়ামী লীগ এবং দলের মন্ত্রী-এমপিদের সম্পর্কে জনমত বৃদ্ধি পেয়েছিল। দশম সংসদ নির্বাচন যদি প্রতিযোগিতামূলক হতো তবে দলের কয়েক ডজন এমপি-মন্ত্রী যারা সেবার নির্ঘাত পরাজিত হতেন, তারাও কিন্তু একাদশ সংসদ নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করেই জয়ী হয়ে আসতে পারতেন। অন্য দিকে, যেসব লোক কোনো দিন আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়নি, তাদের একাংশও এবার ভোট দিত। অধিকন্তু নতুন ভোটারদের বিরাট এক অংশ স্বভাবতই আওয়ামী লীগের প্রতি ঝুঁকে থাকত।
উপরোল্লিখিত প্রেক্ষাপটে দেশী-বিদেশী নানা জরিপে আওয়ামী লীগ এগিয়ে ছিল। একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে যুক্তফ্রন্ট, ঐক্যফ্রন্ট ইত্যাদি রাজনৈতিক মোর্চা গঠিত হওয়ার পরও বিরোধী দলের শীর্ষ নেতৃত্ব আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ জানায়নি। তারা শেখ হাসিনাকে বিশ্বাস করে গণভবনে গিয়েছিলেন এবং তার কথায় আস্থা রেখে বলতে গেলে বিনাশর্তে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু নির্বাচনের পর যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, তাতে বিশ্বাস ও আস্থার স্থানটি আওয়ামী লীগ এমনভাবে হারিয়েছে, তা আর কোনো দিন ফিরে পাওয়া যাবে না। অধিকন্তু মানুষের দীর্ঘশ্বাস, অভিশাপ, নির্লিপ্ততা, হতাশা ও খিস্তিখেউরের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়ে আওয়ামী লীগ যে পরিস্থতি মোকাবেলা করছে; তা কোন কালে এবং কিভাবে শেষ হবে তা-ও বলা মুশকিল।
পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষ সব কিছু ফেরত পেতে পারে, কেবল চরিত্র-সম্মান ও মর্যাদা ছাড়া। কারণ ওগুলো হারালে ফেরত পাওয়া যায় না। অন্য দিকে, কেউ যদি মানুষের অভিশাপ ও দীর্ঘশ্বাসের কারণ হয়, তবে তার ব্যাপারে সব সময় আসমানি ফয়সালা নির্ধারিত হয়ে যায়। কাজেই দুনিয়ার ইতিবাচক সম্ভাবনাকে কবর দিয়ে কে বা কারা আওয়ামী লীগের এত বড় সর্বনাশ করল, যার কারণে দলটির জন্য আসমানি ফয়সালা অনিবার্য হয়ে পড়েছে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য