প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ১৯৮১ সালে একটি পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রণালয় হিসেবে কাজ শুরু করে। একই সাথে দেশের প্রাথমিক শিক্ষাকার্যক্রম জোরদার ও শতভাগ শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের (ডিপিই) কার্যক্রম শুরু হয়।
এরপর গত ৩৮ বছরেও ডিপিইতে একটি গ্রহণযোগ্য নিয়োগ বিধিমালা তৈরি করা হয়নি। এ কারণে অনেক কর্মকর্তা দীর্ঘদিন পদোন্নতি পাচ্ছেন না। শুধু কর্মকর্তাই নন, নিম্নস্তরে পদোন্নতির কোনো ব্যবস্থা না থাকায় সর্বত্রই এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। এর প্রভাব পড়ছে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনা এবং শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনায়।
মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, ১৯৮২ সালে সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের আওতায় প্রাথমিক শিক্ষা পরিচালনা করতে কিছু পদ সৃষ্টি করা হয়। ১৯৮৯ সালে ক্যাডার বিধি সংশোধন করে নিয়োগবিধির মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা ক্যাডার তৈরির বিষয়টি উল্লেখ করা হলেও আজো তার বাস্তবায়ন হয়নি।
এ কারণে উপপরিচালক, সহকারী পরিচালক, পিটিআই সুপার, সহকারী সুপার, জেলা ও সহকারী প্রাথমিক শিক্ষাকর্মকর্তা, পিটিআই ইনস্ট্রাক্টর, উপজেলা শিক্ষাকর্মকর্তা, অধিদফতরের শিক্ষাকর্মকর্তা, গবেষণা অফিসার, পরিসংখ্যান কর্মকর্তাসহ প্রথম শ্রেণীর ১২টি পদে সরাসরি নিয়োগ দেয়া হয়।
তারা আরো জানান, পদোন্নতি ও প্রণোদনা না থাকায় বিভিন্ন সময় নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের পেশাগত আন্তরিকতা আসছে না। একজন আরেকজনকে সহযোগী না ভেবে প্রতিযোগী ভাবছে। ২০ বছরের অধিক সময় ধরে অনেকে একই পদে কর্মরত রয়েছেন। এ কারণে কাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকছে না। ফলে প্রাথমিক শিক্ষায় নানা পরিবর্তন আনা হলেও স্থায়ী কোনো উন্নতি বা কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া যাচ্ছে না।
এ কারণে গত ৩৮ বছরেও প্রাথমিকে শিশুদের শতভাগ তালিকাভুক্তি (এনরোলমেন্ট) নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। যদিও বর্তমান সরকার দাবি করছে প্রাথমিক শিক্ষায় ৯৮ শতাংশের বেশি ভর্তি হচ্ছে শিশু। অন্যদিকে প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ১৭ শতাংশের বেশি বলে ডিপিই সূত্রে জানা গেছে।
ডিপিইর নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এ এফ এম মঞ্জুর কাদির এ ব্যাপারে বলেন, প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় কিছু স্থানে ত্রুটি রয়েছে। এসব চিহ্নিত করে সমাধান করা হচ্ছে। এ খাতে যত কাজের পরিধি বাড়ছে তত মামলার সংখ্যা বাড়ছে। এসব মামলার জন্য আমাদের কাজকর্মে বিঘ্ন ঘটছে।
মহাপরিচালক বলেন, পর্যাপ্ত পদ না থাকায় অনেক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তারা আদালতে গিয়ে মামলা করছে। দীর্ঘদিন মামলা চলার কারণে সে সমস্যা আর সহজে সমাধান হচ্ছে না। এ ছাড়া নিয়োগ, বদলি, জাতীয়করণসহ বিভিন্ন মামলা হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
ডিপিইর আইন শাখা সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিক শিক্ষা বিভিন্ন খাতে সারা দেশে ৪ হাজার ৭৮৭টি রিট মামলা রয়েছে। এর মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ সংক্রান্ত মামলা বেশি। ২০১৩ সালের ৯ জানুয়ারি থেকে পরবর্তী তিন অর্থবছরে তিন ধাপে, চার ক্যাটাগরির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (রেজিস্টার্ড ও এমপিওভুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়, স্থায়ী-অস্থায়ী নিবন্ধনপ্রাপ্ত, পাঠদানের অনুমতিপ্রাপ্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়, কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং সরকারি অর্থায়নে এনজিও পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয়) জাতীয়করণ কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর অনেকে নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করে জাতীয়করণের জন্য আদালতে গিয়ে মামলা করেন।
২০১৩ সালের আগে অনেক শিক্ষক চাকরি ছেড়ে দিলেও জাতীয়করণ হওয়ার পর তারা নতুন করে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে বিদ্যমান শিক্ষক দেখিয়ে জাতীয়করণের দাবিতে মামলা করেন।
দেখা গেছে, চার ক্যাটাগরিতে ২৬ হাজারের বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হলেও তার মধ্যে ডিপিইর অনুমোদিত বিদ্যালয়ে দায়িত্বরত প্রধান শিক্ষকদের সমপদে জাতীয়করণ করা হয়েছে। অথচ নিবন্ধিত বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের সহকারী শিক্ষক হিসেবে জাতীয়করণ করা হয়। সমপদে জাতীয়করণের দাবিতে তারা সম্মিলিতভাবে আদালতে কয়েকটি মামলা করেন।
অন্যদিকে, সরকারি কর্মকমিশন-বিসিএস পরীক্ষায় নন-ক্যাডার থেকে নিয়োগ পাওয়া প্রধান শিক্ষকদের ১৩তম গ্রেডে বেতন-ভাতা দেয়া হলেও তাদের দশম গ্রেড বা দ্বিতীয় শ্রেণীর পদমর্যাদার জন্য মামলা করা হয়েছে। জাতীয়করণ হওয়ার আগের চাকরির সময়কালের অর্ধেক সময় শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা নির্ণয় করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠান বেসরকারি থাকা সময়ের শতভাগ সময়সীমা জ্যেষ্ঠ হিসেবে গণ্য করতে শিক্ষকরা মামলা করেন।
জানা গেছে, ডিপিইর বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত উপপরিচালকরা ২০ বছরের অধিক সময় ধরে একই পদে দায়িত্ব পালন করছেন। দীর্ঘ দিন ধরে পদোন্নতি না হওয়ায় বা পরিচালক হিসেবে পদোন্নতি না পেয়ে তাদের পক্ষ থেকে কয়েকটি মামলা করা হয়েছে। এ দিকে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘দফতরি কাম নৈশপ্রহরী’ নিয়োগ কার্যক্রমে সংসদ সদস্যদেরকে নিয়োগ কমিটির প্রধান করা হয়। এখানে নিয়োগবাণিজ্য হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। অনেকে অর্থ দিয়েও চাকরি পায়নি অভিযোগে বেশ কয়েকটি মামলা দায়ের হওয়ায় এ কার্যক্রম স্থগিত হয়ে গেছে।
মেয়াদ শেষ হয়েছে বা মেয়াদ শেষের পথে, ডিপিইর অধীন এমন সব প্রকল্পে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজস্ব খাতে নিয়োগ, বিভিন্ন শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিভিন্ন স্থানে বদলি করা হলেও সেই বদলি ঠেকাতে একাধিক মামলা করা হয়েছে। এ ছাড়া কর্মচারীদের বিভিন্ন পদে নিয়োগসংক্রান্ত মামলার কারণে দীর্ঘদিন নিয়োগ স্থগিত রয়েছে।
ফলে একের পর এক মামলার ভারে নুয়ে পড়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের (ডিপিই) কার্যক্রম।