তাবলীগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নিতে বাংলাদেশের ঢাকার কাছে টঙ্গীতে তুরাগ নদীর তীরে প্রতি বছর সমবেত হয়ে থাকেন লাখ লাখ দেশি- বিদেশি ধর্মপ্রাণ মুসলিম। গত প্রায় ৫০ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে এই ইজতেমায় অংশ নিয়ে আসছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিদেশি। খবর বিবিসির।
কিন্তু এবারের বিশ্ব ইজতেমার পরিস্থিতি ভিন্ন।
মাওলানা সা’দ কান্দালভী’র অংশ নেয়া নিয়ে বিভক্ত হওয়ার পর দু’পক্ষ আলাদা করে যে ইজতেমার আয়োজন করেছে তাতে বিদেশিরা তেমন যোগ দেননি।
সা’দ বিরোধী পক্ষের মাওলানা ওমর ফারুক বলছেন, এবারের ইজতেমায় অংশ নিয়ে ৭/৮শ বিদেশি। অন্যদিকে সাদ সমর্থক পক্ষের রেজা য়ারিফ বলছেন, বিদেশিদের সংখ্যা সর্বোচ্চ সাড়ে ছয়শ ছিলো এবারের ইজতেমায়।
‘মুসলিম বিশ্বে নেতিবাচক বার্তা’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আব্দুর রশীদ বলছেন, দু’পক্ষ যাই বলুক যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা মুসলিম বিশ্বে নেতিবাচক বার্তা দিয়েছে।
বিশেষ করে ইজতেমাকে ঘিরে মারামারি হওয়ার কারণেই বিদেশিদের অনেকেই এবার আসতে আগ্রহী হননি বলে মনে করেন তিনি।
সৌদি আরবে হজের পর বাংলাদেশের এই বিশ্ব ইজতেমার পরিচিত গড়ে উঠেছিলো মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম জমায়েত।
তাবলীগ জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াস ভারতে এর গোড়াপত্তন করলেও পরবর্তী কালে তা উপমহাদেশের বাইরে আসে এবং বাংলাদেশে এর সূত্রপাত হয় ১৯৪০ এর দশকের শেষের দিকে।
বাংলাদেশে প্রথম তাবলীগের জামাত নিয়ে আসেন তাবলীগ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ ইলিয়াসের ছেলে মোহাম্মদ ইউসুফ। ১৯৪৬ সালে বাংলাদেশে ঢাকার কাকরাইলে এ সম্মেলন হয়। পরে ১৯৬৬ সালে টঙ্গীতে স্থানান্তর হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, শুরুতে এটি বার্ষিক সম্মেলন হিসেবে চললেও পরে কালক্রমে যখন বিদেশ থেকে লোকজন আসা শুরু করলো তখন থেকে এটি বিশ্ব ইজতেমা হিসেবে পরিচিত পেতে শুরু করে।
অধ্যাপক আব্দুর রশিদ বলছেন, এবার যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সে কারণেই বিদেশি অতিথিরা আসেননি এবং এটি এতদিনের যে ইমেজ তৈরি হয়েছিলো তাতে বড় ধাক্কা দিয়েছে।
“সা’দ কান্দালভীর কারণেই বিশ্বের কাছে পরিচিত তাবলীগ জামাত। তাকে নিয়েই যেহেতু প্রশ্ন উঠেছিলো সেটা অনেক বিদেশি মেনে নিতে পারেনি।”
তিনি বলেন, “কওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক ও সাধারণ তাবলীগ—ধর্মের নামে এ বিভক্তি ছিলো দু:খজনক”।
তিনি বলেন, এবার যে মেরুকরণ হয়েছে তার জের ধরে মারামারি পর্যন্ত দেখেছে সবাই।
‘সাধারণ মুসল্লিদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। নিশ্চয়ই আমাদের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এ আয়োজন করে একটু অন্য ভাবে উপস্থাপিত হচ্ছিলো’।
রশিদ আরো বলেন, ৩০/৪০ দেশের মানুষ এখানে একাকার হয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করতো। সেখানেই বিভক্তি তৈরি করা হলো।
“এটাই মুসলিম বিশ্বে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করেছে। আশা করি এ বিভক্তি সামনে থাকবেনা।”
আর ইজতেমার এবার যে পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে তার জের ধরে যে বিদেশিরা আসেননি – সেটা স্বীকার করছে বিবদমান দু’পক্ষই।
সা’দ কান্দালভীর অনুপস্থিতি বড় কারণ: সা’দ সমর্থক পক্ষ
সা’দ কান্দালভীর অনুসারীদের পক্ষের বিদেশি কমিউনিকেশনস বিভাগের দায়িত্বে আছেন রেজা য়ারিফ।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, বিদেশিরা এখানে আসতেন মূলত সা’দ কান্দালভীর কথা শুনতে ও নির্দেশনা নিতে।
“সারা বিশ্বের আলেম মুরুব্বিরা এসে পরবর্তী বছরের করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করেন ও নির্দেশনা নেন সা’দ সাহেবের কাছ থেকে। সে কারণেই এটি বিশ্ব ইজতেমা।”
মি. য়ারিফ বলেন, “তারা আগের বছর কী করেছেন ও পরের বছর কী করবেন – তা নিয়ে নির্দেশনা দিতেন আমির। তিনি না আসায় বিদেশিরা আসতে উৎসাহিত হননি।”
সা’দ সমর্থক এই নেতা আরো বলেন, গড়ে যেখানে প্রতি বছর ১৫ থেকে ১৮ হাজার বিদেশি মুসল্লি আসতেন এবার সেখানে সর্বোচ্চ ছিলো সাড়ে ছয়’শ জন।
“সাদ সাহেবের না আসা ও বিদেশিদের না থাকার বিষয়টি বিশ্ব ইজতেমার জৌলুস কমিয়ে দিলো। এবছর এটি জাতীয় ইজতেমায় পরিণত হলো।”
তিনি আশা করেন, “আগামী বছর সা’দ কান্দালভী আসলে ১৫ থেকে ১৮ হাজার বিদেশি আসবেন”।
তিনি বলেন তবলিগের কাজ হয় ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে। কিন্তু ভারত ও পাকিস্তানের অবস্থা সবাই জানেন।
“এ দুটি দেশে সবার জন্য ভিসা পাওয়াও কঠিন ছিলো। বাংলাদেশ সরকারও সবসময় তাবলীগের বিষয়ে সহনশীল ছিলো।”
এসব কারণে বাংলাদেশের দারুণ একটি ভাবমূর্তি আছে মুসলিম বিশ্বে -এমনটাই জানালেন তিনি।
সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্বকে কারণ মনে করছেন সা’দ বিরোধী পক্ষ
সা’দ কান্দালভী বিরোধী পক্ষের মাওলানা ওমর ফারুক অবশ্য মনে করেন বিদেশিদের না আসার কারণ ভিন্ন।
“এবার মাত্র দশদিন আগে সিদ্ধান্ত হয়েছে। তারপর সার্কুলার দেয়ার পর বিদেশিরা সময় পেয়েছে মাত্র ৪/৫ দিন। আর শীতের এ সময়টাতে হঠাৎ করে বিমান টিকেট পাওয়াও কঠিন হয়ে যায়।”
তাছাড়া গত পহেলা ডিসেম্বর যে মারামারি হয়েছে তাতেও বিদেশিরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
“বিশ্ব ইজতেমা আসলে তাবলীগ জমায়েত। তারপরেও এর যে পরিচিত হয়ে আসছিলো তাতে প্রভাব পড়েছে স্বাভাবিকভাবেই।”
“আমরা সরকারকেও বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম যে দেরি হয়ে গেলে ক্ষতি হবে। কিন্তু সরকারেরও হয়তো কিছু করার ছিলোনা। কারণ নির্বাচনের পর সতর্ক থাকতে হয়েছে,” বলেন মি. ফারুক।
তিনি বলেন, তাবলীগ জামায়াতে পাসপোর্ট গুনে বিদেশির সংখ্যা জানা যায়না। কারণ অনেকেই পর্যটক হিসেবে আসেন।
“তবে বিদেশিদের খানাদানার যে আয়োজন হয় সেখান থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এবার বিদেশি এসেছেন ৭/৮শ”।
তাবলীগ সংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে প্রায় ত্রিশ হাজার এবং ২০১৮ সালে ২২/২৩ হাজার বিদেশি বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিয়েছিলেন।
অধ্যাপক আব্দুর রশীদ বলছেন, বিভক্তি দূর করা গেলে ও রাজনৈতিক বিবেচনা না দেখলে নিরেট সাধারণ মুসল্লিদের ঐক্যবদ্ধ ইজতেমা হলে এটি বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।