ঘড়ির কাঁটার মতোই আফগান শান্তিপ্রক্রিয়াও টিকটিক করে এগিয়ে যাচ্ছে। আফগান জনগণ এই দীর্ঘ যুদ্ধে ভীষণ ক্ষয়ক্ষতি, নিদারুণ যন্ত্রণা ও দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেছেন। তারা এই যুদ্ধ ও সঙ্ঘাতের অবসান এবং এর একটি স্থায়ী নিষ্পত্তির দিকে তাকিয়ে আছেন। অপর দিকে, যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রশক্তি বৈঠকে বসে আধুনিক ইতিহাসে তাদের দীর্ঘতম যুদ্ধের ব্যয় ও ক্ষয়ক্ষতির হিসাব কষছে। ২০০২ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত আফগান যুদ্ধে আমেরিকা কয়েক হাজার সৈন্য ও অফিসারকে হারিয়েছে। প্রতিদিন ২০ জনেরও অধিক প্রবীণ যোদ্ধা আত্মহত্যা করছেন। প্রবীণ যোদ্ধা বা সৈনিকদের দুই লাখের বেশি পিটিএসডিতে (আতঙ্কজনিত মানসিক রোগ) ভুগছেন এবং আফগানিস্তান আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে।
কোনো সুস্থ সামরিক কৌশলবিদই ব্যর্থতা বা পরাজয় নিশ্চিত করার সুপারিশ করবেন না বা পরামর্শ দেবেন না। তাই বলা যায়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার পেন্টাগনের জেনারেলদের চেয়ে ‘অধিক বুদ্ধিমান’। তিনি সামরিক বাহিনীকে একটি রাজনৈতিক সমাধানের মধ্য দিয়ে মুখ রক্ষা করে আফগানিস্তান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য চাপ দিচ্ছেন। পাকিস্তান তালেবানদের আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যে দুঃসাধ্য প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তাতে ভূমিকা পালন করছে পাকিস্তান। আফগানিস্তানের সব প্রতিবেশীই শান্তির জন্য ব্যাকুল। সর্বোপরি, কোনো দেশই তাদের সীমান্তে যুদ্ধ ও সঙ্ঘাত চায় না।
প্রতিবেশী এসব দেশের মধ্যে রয়েছে ইরান, মধ্য এশীয় প্রজাতন্ত্রগুলো, পাকিস্তান ও চীন। সম্প্রতি মস্কোতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আফগান সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো জরুরি ভিত্তিতে বিশৃঙ্খলার অবসান চেয়েছে। এমনকি রুশ ফেডারেশনও এই সঙ্ঘাতের অবসানে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। শুধু একটি মাত্র দেশই শিগগির এই যুদ্ধ ও সঙ্ঘাতের অবসান চায় না। আশ্চর্যজনকভাবে, এটি আফগানিস্তানের কোনো নিকট প্রতিবেশী নয়Ñ দেশটা হলো ভারত। আফগান সঙ্ঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধান বা নিষ্পত্তিকে কেন এত নেতিবাচকভাবে দেখছে ভারত? কেন তারা এতে খুব উদ্বিগ্ন?
‘৯/১১’-এর পর ভারত পাকিস্তানের মতো প্রতিবেশী দেশে অত্যাধুনিক হাইব্রিড যুদ্ধের মাধ্যমে চাণক্যের ‘মানডালা তত্ত্ব’ প্রয়োগ করার একটি বিস্তীর্ণ এলাকা খুঁজে পায়।
সাউথ ব্লকের নেতারা চিন্তা করেন, আফগানিস্তানে প্রক্সিযুদ্ধের মাধ্যমে পারমাণবিক শক্তির অধিকারী পাকিস্তানকে চূড়ান্তভাবে ধ্বংস করে দেয়া যেতে পারে। আফগানিস্তানের মাটি থেকে যুদ্ধে লিপ্ত, বিরোধী বা শত্রুভাবাপন্ন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ‘র’-এর সহযোগিতায় দ্রুত এ খেলা শুরু করে। তাদের লক্ষ্য হলোÑ আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে ঘৃণা ও শত্রুতার বীজ বপন করে কৌশলে পাকিস্তানকে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে ফেলে তার অস্তিত্ব বিলীন করে দেয়া। সম্প্রতি ভারত ‘ফাটা’য় (এফএটিএ) অস্থিতিশীলতার বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য উগ্র জাতীয়বাদী ফ্যাসিবাদী তত্ত্ব প্রকাশ করেছে। অবশ্য এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।
আফগানিস্তান এবং ইরানের কয়েকটি বিরোধী গোয়েন্দা সংস্থার সাথে একটি সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার জন্য ভারত অনেক কষ্ট করে এবং ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়ে বিনিয়োগ করেছে। ‘র’-এর পদস্থ ‘গান অ্যান্ড দ্য ব্লুবার্ড’ কর্মকর্তা, কমান্ডার কুলভূষণ যাদব পাকিস্তানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড উসকে দেয়ার জন্য আফগানিস্তান ও ইরান, উভয় দেশের ভূমি ব্যবহার করেছেন। বিএলএ এবং বিআরএ’র মতো বিলুপ্ত সংগঠনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে সমর্থন দিয়ে ভারতের উদ্যোগে সাজানো, উপজাতীয়তাবাদীদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা তৈরি করার বিষয়টি বিশ্ববাসীর কাছে আর গোপন থাকেনি। ভারতের একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল হর্ষ কাকার যখন দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায় ‘আফগানিস্তানের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির জন্য দায়ী কে’ শিরোনামে নিবন্ধ লিখেন, তখন ভারত সরকারের ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি ওই লেখায় আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়ায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সমালোচনা করে ওয়াশিংটনের সামরিক কর্তৃপক্ষের প্রতি যুদ্ধ অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান। কেবল ভারতের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যই তিনি এই আহ্বান জানালেন। ওই জেনারেল যখন আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সাথে তুলনা এবং মনের সেই ভূতকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করেন, তখন হাস্যরসাত্মক অবস্থার সৃষ্টি হয়। সর্বোপরি, বাস্তবতা ভিন্ন। ভারতের সামরিক কর্তৃপক্ষ এবং ‘র’ আফগানিস্তানে দীর্ঘ দিন নোংরা খেলা খেলার পর বুঝতে পেরেছে তাদের ‘বিনিয়োগ কাবুল নদীতে ডুবে গেছে’।
পাকিস্তানকে অস্থিতিশীল করার জন্য ভারতের রয়েছে সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক। এ জন্য কয়েকটি কনসুলেটকে ব্যবহার করা হয়। এটি শ্রীলঙ্কায় যা ঘটেছে তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। শ্রীলঙ্কায় এলটিটিই নেতা প্রভাকরণ যখন নিহত হন, তখন মুলাইতিভু বনাঞ্চল এবং জাফনা উপদ্বীপে এলটিটিইকে ‘র’-এর সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক কর্তৃক সমর্থনদানের বিষয়টি আবিষ্কৃত হয়েছিল।
আফগানিস্তানের চলমান শান্তিপ্রক্রিয়ায় যখন অগ্রগতি হচ্ছে, তখন তালেবান যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ভারত কিভাবে সরাসরি সামরিক অভিযানে অংশগ্রহণ করেছে এবং এ ক্ষেত্রে ভারতের বিনিয়োগের বিভ্রান্তিকর চেহারা ক্রমান্বয়ে বেরিয়ে আসছে। এ সংক্রান্ত অনেকগুলো স্টোরি প্রকাশ পেয়েছে। সম্প্রতি নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত ডায়ালগের সময় ভারতীয় সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াত তালেবানদের সাথে আলোচনায় বসার প্রয়োজনীয়তার ওপর যে গুরুত্ব দিয়েছেন, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।
পাকিস্তান ও আফগানিস্তান একত্রে বড় হওয়া যমজ ভাইয়ের মতো। আর দু’টি দেশই হচ্ছে প্রতিবেশী। ঐতিহাসিকভাবে তারা পরস্পরের সাথে এতই সম্পৃক্ত যে, বলা যায় দু’টি দেশ অবিচ্ছিন্ন। তাদেরকে সহাবস্থান করতে হবে। পরস্পর দুই ভাইয়ের মতো, এ দুই দেশের মধ্যে বাইরের কোনো শক্তি ফাটল ধরানোর চেষ্টা করলে তারা ব্যর্থ হবেন। এ ক্ষেত্রে ভারত কোনো ব্যতিক্রম নয়। এখন থেকে কাবুলের দিকে যাওয়া সব সড়ক ইসলামাবাদের মধ্য দিয়ে যাবে।
একটি বিষয় হলো- চাণক্যের মান্দাল সিদ্ধান্ত তত্ত্বে¡র ওপর ভিত্তি করে ভারত-আফগান এন্টারপ্রাইজ পরিচালিত হচ্ছে। এই থিওরির আওতায়, পাকিস্তান কাছের প্রতিবেশী হিসেবে চরম শত্রু (অরি) এবং আফগানিস্তান ও ইরান মিত্রের ক্যাটাগরিতে পড়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে ‘উদাসীনা’ (নিরপেক্ষ রাজা)। দিল্লির সাউথ ব্লক থেকে আফগানিস্তানের ভবিষ্যতের দিকে তাকালে এটাই মনে হয়। অরি (পাকিস্তান) মিত্রের (আফগানিস্তানে) সাথে পুনরায় যোগ দিয়েছে এবং উদাসীনা (যুক্তরাষ্ট্র) নিঃশেষিত হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং বিজুসু’র (ভারত) দ্বিধাগ্রস্ত বা অনিশ্চিত যাত্রা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। আফগানিস্তানে দোভাল-মোদি সার্কাসের এখন করুণ দশা। এই সার্কাস ব্যর্থ; এটাকে অবশ্যই গুটিয়ে ফেলতে হবে। এখন ভারতের আফগানিস্তান ত্যাগ করার সময়।
লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক।
পাকিস্তানের দ্য ন্যাশন পত্রিকা থেকে ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার