রাজকপালে জাহালম!

আন্তরিক হোক আর লোক দেখানো হোক, জাহালমের জন্য বহুকণ্ঠের কান্না ছিল দেখার মতো। কয়েক দিন চলে অহর্নিশি। তার মা-স্বজনের বিলাপ বাদই দিলাম। বাকি অনেকের কান্না কিংবা মায়াকান্না যা-ই হোক না কেন, তার শব্দ আছড়ে পড়ে কানে। কেউ মানবাধিকারের নামে, কেউ হতভাগ্য জাহালমের কষ্টব্যথা ভেবে আকুল হৃদয়ে ব্যাকুল হয়ে কান্নায় বুক ভাসান। এ রোদন অমূল্য, ফেলনা নয়! কেউ মতলবি বলে মুখটিপে হাসেন। সত্যি এটি কিন্তু অন্যায়। মানুষের মনের কথা জানেন শুধু অন্তর্যামী। আমরা ইতরজন, যাদের হৃদয়ে মানবাধিকার কোনো আছর ফেলে না। কাটে না আঁচড়। ছুঁয়ে যায় না মন। তাদের ভাবনা একটু ভিন্ন। এই আমাদের কাছে জাহালম পরম ভাগ্যবান। রীতিমতো রাজকপালে! সংক্ষেপে বয়ান করলে দাঁড়ায় ‘রাজ’ মানে- বড় বা উৎকৃষ্ট। কপাল থেকে কপালে শব্দের উদ্ভব। বলা যায়, বড় কপালের অধিকারী যিনি তিনিই রাজকপালে। কে না জানে, গ্রামাঞ্চলে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে দেখা হয় কপাল।
অনেকে ভাবছেন বিনা দোষে বেচারা জাহালম তিন বছর কারাভোগ করলেন, হলেন প্রিয়তমা স্ত্রীর সান্নিধ্যবঞ্চিত। কলিজার টুকরো সন্তান হলো পিতৃস্নেহবঞ্চিত! তার ললাটে জুটল রাজকপালে অভিধা। গাঁজাখোরি কথা। আর কোনো শব্দবন্ধনীতে আবদ্ধ করলে না হয় মানা যেত। তাই বলে রাজকপালে!

এটি উদ্ভট মনে হলেও একদম সহি। জলবৎ তরলং। সংশয়ী মনে বিশ্বাস হচ্ছে না? তথ্য-উপাত্ত চাই। চাই প্রমাণ। না হলে মনের গহিনে থেকে যায় খচখচানি। থেকে যায় দ্বিধাদ্বন্দ্ব। আচ্ছা- আমাদের দাবিনামার সপক্ষে দলিল-দস্তাবেজ পেশ করছি। ব্যাপারটি যাতে আর হেঁয়ালি মনে না হয়। তবে এ কথাও ঠিক, এ বিষয়ে কারো কাছে যুতসই পরিসংখ্যান নেই- দেশের কারাগারগুলোতে বিনা বিচারে কতজন কারাবন্দী আছেন। গণমাধ্যমে ফাঁস হওয়া কয়েকটি ঘটনা নমুনা হিসেবে তুলে ধরছি। যারা বিনা দোষে ও বিনা বিচারে শ্রীঘরে ছিলেন বছরের পর বছর। কেউ তো সোজা কবরে গিয়ে পান মুক্তি সনদ। আর জাহালমের তিন বছরের জেলজীবন তো নস্যি! এ জন্য আবার ক্ষতিপূরণ দাবি- মামাবাড়ির আবদার আর কি! দুর্নীতি দমন কমিশন আর ব্যাংক কর্মকর্তারা না হয় আবু সালেক আর জাহালমকে চিনতে ভুল করেছেন। দু’জনের চেহারার মিল থাকায় এমন বিপত্তি। দুপুরের ভাতঘুম চোখে যে কারো এমন হতেই পারে।
বিষয়টি ভিন্নদৃষ্টিতে দেখলে মনের জ্বালা কিছুটা প্রশমিত হতে পারে। জাহালম শ্রমিক মানুষ। সেই জীবনে একমুহূর্ত ছিল না বিশ্রাম। অথচ এই ভুলের কারণে তিন-তিনটি বছর সরকারি খরচে খানাপিনা। গাঁওগেরামের ভাষায় জামাই আদর। এতে তার চেহারায় রোশনাই লেগেছে! এটি কম কী? বিনিময় শুধু মুক্তজীবন মর্টগেজ! যে কেউ কবুল করবেন, এক শ্রমজীবীর জীবনে এটি মস্ত পাওনা।

বেহুদা প্যাচাল বাদ দিয়ে আসল কথায় আসি। আমাদের বক্তব্যের সপক্ষে পেশ করি তথ্য-উপাত্ত। ৬৫ বছর বয়সী শেখ আবেদ আলী। মৃত্যুদণ্ডের পরোয়ানা নিয়ে ১৩ বছর কারাগারে থেকে ২০১৮ সালের ৭ অক্টোবর সকালে মারা যান খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রিজন সেলে। ওই দিন বিকেলে সাতক্ষীরা নিবাসী আবেদ আলীর খালাসের রায়ের কপি কারাগারে পৌঁছে। মেয়ে নাজমা সুলতানা বাবাকে বাড়ি আনতে যান। তবে জীবিত নয়, বাবার লাশ নিয়ে বাড়ি ফেরেন। পুলিশের অভিযোগ ছিল, ২০০৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ইটাগাছা পুলিশ ফাঁড়ির দুই সদস্যকে ছুরিকাঘাতে হত্যার সাথে জড়িত আবেদ আলী। ওই মামলায় ২০০৬ সালে তিনিসহ তিনজনের মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন নি¤œ আদালত। ২০১১ সালের ১১ ডিসেম্বর হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের রায় বাতিল করে তাকে খালাস দেন। চার বছর চলে আপিল শুনানি। গত বছরের ১১ এপ্রিল আপিল বিভাগ খালাসের রায় বহাল রাখেন। তবে হতভাগ্য আবেদ আলী মামলা থেকে রেহাই পেলেও রায়ের কপি জেলা কারাগারে না পৌঁছানোয় আরো ছয় মাসের বেশি কাটান কনডেম সেলে। স্বজনেরা যখন ওই রায়ের কপি নিয়ে খুলনা মেডিক্যাল কলেজের প্রিজন সেলে যান, ততক্ষণে ক্যান্সারের রোগী আবেদ আলী দুনিয়াছাড়া।

২০১৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় ‘অবশেষে ২৫ বছর পর মুক্তি পেলেন তিনি’ শিরোনামে একটি সংবাদ। তিনি বাবুল মিয়া। বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরের বাখরনগরে। বিনা বিচারে ২৫ বছর ছিলেন কারাগারে। তার বিরুদ্ধে যে মামলা হয়, তাতে দোষী সাব্যস্ত হলেও সর্বোচ্চ শাস্তি হতো ১০ বছরের কারাদণ্ড।

১৯৯২ সালে গ্রেফতারের সময় বাবুল মিয়ার বয়স ছিল ১৮ বছর। মুক্তির সময় বয়স ঠেকে তেতাল্লিশে। ১৯৯৫ সালে বাবা আনোয়ার ও মা নিলুফা সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। তার সাত ভাই ও দুই বোন জন্মভিটা ছাড়েন বা ছাড়তে বাধ্য হন। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ১৯৯২ সালের ২১ আগস্ট রাত ৮টায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ফেরার পথে তাদের বাসে ডাকাতি হয়। চালকের সহকারী সন্দেহে ডাকাতি মামলায় তাকে ফাঁসানো হয়। পুলিশ অভিযোগপত্র দাখিল করে। ১৯৯৩ সালের ৪ জুলাই ওই মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। ২৫ বছরে মামলার ১১ সাক্ষীর মধ্যে আদালতে চারজন সাক্ষ্য দেন। মামলার বাদি ও তদন্ত কর্মকর্তা কখনোই আদালতে হাজির হননি।
পুরান ঢাকার সিপন এক হত্যা মামলায় বিনা বিচারে জেল খাটেন ১৬ বছর। ২০১৭ সালের মে মাসে মুক্তি মেলে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ১৯৯৪ সালের অক্টোবরে পুরান ঢাকার সূত্রাপুরে দুই মহল্লার মারামারিতে এক ব্যক্তি নিহত হন। সিপনসহ কয়েকজনকে আসামি করে মামলা হয়। ২০০০ সালের ৭ নভেম্বর সিপন গ্রেফতার হন।

এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ময়নার তদন্তকারী, চিকিৎসক, সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুতকারী পুলিশ কর্মকর্তাসহ ১৮ সাক্ষীকে সাক্ষ্য দিতে ৯০ বার সমন ও জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। তারা কেউ আদালতে হাজির হননি। তাদের গাফিলতিতেই বিচারিক আদালতে মামলাটি নিষ্পত্তি হতে সময় লাগে এত বছর। অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় সিপন খালাস পান।

২০১৬ সালের ১২ জুলাই। গণমাধ্যমের আরেকটি শিরোনাম ছিল ‘বিনা অপরাধে ৯ বছর জেলে থাকার পর মুক্ত ফরিদ’। বাট্টি ফরিদ নামে পরিচিত ৩০ বছর বয়সী মানুষটি ছিলেন দিনমজুর। মা-বাবা ছাড়া বেড়ে ওঠা ফরিদ থাকতেন রাজধানীর খিলগাঁও বস্তিতে। সন্দেহভাজন হিসেবে পুলিশ ২০০৭ সালের ২০ এপ্রিল খিলগাঁও রেললাইন থেকে আটক করে তাকে। একটি ডাকাতি মামলায় সন্দেহভাজন গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে চালান দেয়া হয়। আদালতে তার পক্ষে আইনজীবী না থাকায় ওই দিন জামিনের আবেদন করা হয়নি। এখান থেকেই শুরু কারাবাস। পরে মানবাধিকার সংগঠন লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স টু হেল্পলেস প্রিজনার্স অ্যান্ড পারসন্সের (এলএএইচপি) সহায়তায় কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্তি মেলে।

মুক্তির পর ফরিদ জানান, বাবাকে দেখেননি তিনি। বাড়ি বলতে কিছু নেই। আট বছর বয়সে মা আরেকটি বিয়ে করে আলাদা হয়ে যান। মা কোথায় আছেন বা বেঁচে আছেন কি না, তা জানেন না তিনি। ঘটনার দিন কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তাকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। গত ১২ জুলাই এলএএইচপি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শুধু ফরিদ নন, এমন অনেকেই বিনা বিচারে দীর্ঘ সময় কারাভোগ করে মুক্ত হয়েছেন। সাত বছর বিনা বিচারে কারাভোগ করে ২০১৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পাওয়া আলমগীর হোসেনের নাম প্রকাশ করা হয় ওই প্রতিবেদনে। আলমগীর ২০০৮ সালের ২৯ নভেম্বর গ্রেফতার হন। কোনো ওকালতনামা জমা না পড়ায় বিনা বিচারে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দিজীবন কাটান। বিনা বিচারে জেল খেটে মুক্তি পাওয়া আরেকটি নাম গাজীপুরের বাবুল আক্তার। ১৭ বছর কারাবাসের পর তিনি অনেকটা স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। খালাসের পর বাড়িতেও ফিরে যাননি। পরে গণমাধ্যমের বদৌলতে ২০১৬ সালের নভেম্বরে পরিবারের কাছে ফিরে যান। বাড়ি ফিরলেও স্ত্রীকে ফিরে পাননি তিনি।

বর্তমানে বিনা দোষে কারাগারে থাকা আলোচিত নাম বাদল ফরাজি। আসামির সাথে নামের মিলজনিত বিপত্তি ঘটায় একটি খুনের মামলায় ১১ বছর ধরে তিনি কারাগারে। ২০০৮ সালের ১৩ জুলাই ভারতে বেড়াতে গিয়ে গ্রেফতার হন তিনি। এরপর দিল্লির নি¤œ ও উচ্চ আদালত তাকে ওই মামলায় দোষী প্রমাণিত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। পরে বন্দিবিনিময় চুক্তির আওতায় গত বছরের ৬ জুলাই তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। এখনো তিনি কারাগারে। অথচ ভারতসহ সবাই জানে, এ বাদল সেই বাদল নন, যিনি দিল্লির অমর কলোনির এক বৃদ্ধকে খুনের সাথে জড়িত। বাদল সিং নামের প্রকৃত খুনি ধরতে গিয়ে বিএসএফ ভুলে বাংলাদেশী পর্যটক বাদল ফরাজিকে গ্রেফতার করে। ইংরেজি বা হিন্দি জানা না থাকায় তিনি নিজের কথা তখন কাউকে বোঝাতেও পারেননি। বাগেরহাটের ১৮ বছর বয়সী সেই বাদল এখন ২৯ বছরের যুবক। আইনের মারপ্যাঁচে তার জীবন কাটে দাগী আসামিদের সাথে। তাই বলছিলাম, শুধু জাহালমকে নিয়ে এই বিলাপ কী ধরনের ইনসাফ? চক্ষুলজ্জা বলেও তো একটি কথা আছে! তাই না!
পাদটীকা : আইন-আদালতের ব্যাপারে আমরা সাধারণেরা অজ্ঞ। তবে এই জাহালম, বাদল, বাবুল আক্তার, বাবুল মিয়া, সিপন ও ফরিদদের জীবনের কি কোনো মূল্য নেই? কেউ কেউ কারাগারেই কিশোর থেকে যুবক হচ্ছেন। আর এসব ব্যক্তির পরিবারের কী অবস্থা, তা কি একবারও কেউ ভেবে দেখেছেন?

camiramza@yahoo.com

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top