মো. আব্দুল কাইয়ুম: ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী আনন্দমোহন কলেজে বৈষম্য বিরোধী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে এখনও ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বিতর্কিত অধ্যক্ষ মো. আমান উল্লাহ। আন্নদমোহন কলেজ ক্যাম্পাস ও হলগুলোতে ছাত্রলীগকে আধিপত্য বিস্তারে ব্যাপক সহযোগীতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয়, অধ্যক্ষ মো. আমান উল্লাহ এখনও আওয়ামীলীগের শীর্ষ নেতাদের সাথে মোবাইল ফোন ও হোয়াটসএ্যাপের মাধ্যমে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন। কলেজটিতে আওয়ামীপন্থি শিক্ষক ও ছাত্রলীগ নেতা কর্মীদের নিয়ে গত ৫ আগষ্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর এখন পর্যন্ত ৬ টি গোপন মিটিং করছেন অধ্যক্ষ। শুধু তাই নয়, ৫ আগষ্টের পর থেকে অধ্যক্ষ আমান উল্লাহ ময়মনসিংহ জেলা বিএনপির কতিপয় কয়েকজন নেতার সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ময়মনসিংহ নগরীতে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা যখন রাজপথে আন্দোলন করছিল ঠিক তখনও ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের কার্যক্রমকে সক্রিয় রাখতে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের নিয়ে নিয়মিত ভুনা খিচুরির আয়োজন করতেন অধ্যক্ষ আমান উল্লাহ। এমনকি গত ১৭ জুলাই আনন্দমোহন কলেজ এলাকায় অধ্যক্ষ আমান উল্লাহর নির্দেশে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে দেশী-বিদেশী অস্ত্র নিয়ে বৈষম্য বিরোধী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় যার একটি ভিডিও ইতোমধ্যে সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। অধ্যক্ষের সরাসরি ইন্ধনে কলেজটির কাজী নজরুল ইসলাম হল, ভাষা সৈনিক আবু সালেহ হল এবং ফজলুল হক হলে এখনও দেশী-বিদেশী অস্ত্র মজুত রেখেছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ফলে যেকোন সময় কলেজের হলগুলোতে মজুত থাকা লাঠিসোটা ও অস্ত্র নিয়ে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর ঝাপিয়ে পড়তে পারে ছাত্রলীগ, নষ্ট হতে পারে কলেজের সামগ্রিক পরিবেশ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ৯ জুন ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি এহতেশামুল আলমের সাথে দুই দফায় কয়েক মিনিট কথা বলেন অধ্যক্ষ মো. আমান উল্লাহ। এই আলাপচারিতায় আমান উল্লাহ মোবাইল ফোনে এহতেশামুল আলমকে আশ্বস্ত করেন যে, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ইতোমধ্যে ক্যাম্পাস ও হলগুলো দখলে রেখেছে। অন্যকোন ছাত্র সংগঠন কখনও কলেজ ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করতে পারবেনা বলেও নিশ্চয়তা দেন অধ্যক্ষ আমান উল্লাহ। পরবর্তীতে গত ১০ জুন ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক এড. মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুলের সাথে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনে বসে বেশ কয়েক মিনিট কথা বলেন অধ্যক্ষ আমান উল্লাহ। মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুলের সাথে কথা বলার পর আনন্দমোহন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের আহবায়ক কমিটির নেতা শেখ সজল, ওমর ইসলাম, নাজমুল ইসলাম, রাজন সিদ্দিকী ও জাহিদ হাসান (জিম) কে সাথে নিয়ে আমান উল্লাহ রাতে নিজ অফিসে বসে মিটিং করেন।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ইসলামের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খান সাদী হাসান, উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ আতিকুর রহমান, রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক পাপিয়া সুলতানা রোজী এবং দর্শন বিভাগের প্রভাষক মো. আশরাফ উজ জামান ছাত্রলীগ নেতাদের কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য বিভিন্ন সময় আর্থিক অনুদান দিয়ে সহযোগীতা করে আসছেন। গত জুন মাস থেকে আগস্টের ৩১ তারিখ পর্যন্ত এসব শিক্ষকের সাথে ছাত্রলীগ নেতা শেখ সজল, ওমর ইসলাম, নাজমুল ইসলাম, রাজন সিদ্দিকী ও জাহিদ হাসান (জিম) এক হাজারেরও বেশিবার ফোনে যোগাযোগ করেছেন।
অপরদিকে, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালাতে অধ্যক্ষ আমান উল্লাহ গত ২৩ জুলাই দুপুর ২ টা ১৩ মিনিটে ছাত্রলীগ নেতা শেখ সজলের সাথে প্রায় ৫ মিনিট কথা বলেন। ১৮ জুলাই আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা যখন ময়মনসিংহ নগরীর টাউন হলে অবস্থান নেয় সেদিন দুপুর ৩ টা ৪৯ মিনিটে শেখ সজলকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের নিয়ে টাউন হলে অবস্থান নিতে নির্দেশ দেন অধ্যক্ষ আমন উল্লাহ। এরকম করে প্রায়সময়ই শেখ সজলকে আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলতেন তিনি। অপরদিকে জুলাইয়ের ৪ তারিখ দুপুর ৪টা ১৪ মিনিটে ছাত্রলীগ নেতা ওমর ইসলামকে গোলকীবাড়ী রোডের একটি বাসায় মোবাইলে ডেকে পাঠান অধ্যক্ষ আমান উল্লাহ। পরবর্তী সময় ওমর ইসলাম আমান উল্লাহর বার্তা নিয়ে জেলা আওয়ামীলীগের সিনিয়র নেতৃবৃন্দের সাথে সাক্ষাত করেন এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর কিভাবে হামলা চালানো যায় তার পরামর্শ নেন। এদিকে ৮ জুলাই ছাত্রলীগ নেতা নাজমুল ইসলামের সাথে বিকাল ৫ টা ২০ মিনিটের দিকে বেশ কয়েক মিনিট কথা বলেন আমান উল্লাহ। এসময় কলেজের হলগুলো ছাত্রলীগের দখলে রাখতে যা যা করা দরকার তার নির্দশ দেন অধ্যক্ষ আমান উল্লাহ। কথা শেষে নাজমুলকে নওমহলের বাসায় ডেকে নেন আমান উল্লাহ এবং এসময় জেলা আওয়ামীলীগের বেশ কয়েকজন নেতার সাথে মিটিং করেন। মিটিংয়ে হলগুলোতে দেশী বিদেশী অস্ত্রের মজুদ বাড়ানোর জন্য নাজমুলকে পরামর্শ দেন অধ্যক্ষসহ ময়মনসিংহ মহানগর আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি মোহিত উর রহমান শান্ত ও মহানগর আওয়ামীলীগের সভাপতি ও মেয়র ইকরামুল হক টিটু। এই মিটিংয়ে আরও উপস্থিত ছিলেন কলেজটির ইসলামের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খান সাদী হাসান, উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ আতিকুর রহমান ও রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক পাপিয়া সুলতানা রোজী।
আনন্দমোহন কলেজ সূত্রে জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা যেন কলেজ অধ্যক্ষকে পদত্যাগে বাধ্য না করে সেজন্য ছাত্রলীগকে ঐক্যবদ্ধ করতে শিক্ষক পরিষদের নেতারা অধ্যক্ষ আমান উল্লাহকে নিয়ে গত ১৩ আগস্ট কলেজ ক্যাম্পাসেই মিটিং করেন। এই মিটিংয়ে ছাত্রলীগের ২৫জন নেতাকর্মীও উপস্থিত ছিলেন। গত ৪ সেপ্টেম্বর কলেজ ক্যাম্পাসে আবারও ছাত্রলীগ নেতাদের সাথে রুদ্ধধার বৈঠক করেন আমান উল্লাহ। এই মিটিয়েরে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৫ সেপ্টেম্বর অধ্যক্ষ আমান উল্লাহ নিজের অবস্থানকে শক্তিশালী করতে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাদের শরণাপন্ন হন।
শুধু তাই নয়, ছাত্র জনতার বিপ্লবে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পলায়নের পর অধ্যক্ষ আমান উল্লাহ নিজের আসনকে পাকাপোক্ত রাখতে কতিপয় বিএনপি নেতার সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন। গত ১৩ আগস্ট রাত ৮টার দিকে ময়মনসিংহ জেলা বিএনপির এক নেতার সাথে বেশ কয়েক মিনিট কথা বলেন আমান উল্লাহ। বিএনপির কর্মীরা যেন তাকে পদত্যাগে বাধ্য না করে সেজন্য একটি আর্থিক লেনদেনের আলোচনাও হয় তখন। পরবর্তীতে ওই নেতার সাথেই ১লা সেপ্টেম্বর দুপুর দুইটার পরে বেশ কয়েকবার আর্থিক লেনদেনের ব্যাপারে ওই নেতার সাথে কথা বলেন আমান উল্লাহ। পরে বিএনপির ওই নেতার সাথে হামিদ উদ্দিন রোডের একটি বাসায় বসে আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন হয়।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানাযায়,ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মনিকে প্রায় অর্ধকোটি টাকা ঘুষ দিয়ে ময়মনসিংহ নগরীর ঐতিহ্যবাহী আনন্দ মোহন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ পদ বাগিয়ে নেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মো. আমান উল্লাহ। তৎকালীন এই ঘুষ লেনদেনের মধ্যস্থতা করেছিলেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী এনামুল হক শামীম। শুধু তাই নয়, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা অধ্যক্ষ আমান উল্লাহ ময়মনসিংহ শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে পদোন্নতির জন্য গত ২৬ মে ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ফারুক আহমেদ খানের মাধ্যমে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর কাছে সানকিপাড়ার একটি বাসা থেকে ৩০ লক্ষ টাকা পাঠান।
এব্যাপারে ব্যবস্থাপনা বিভাগের একজন সহযোগী অধ্যাপক নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, অধ্যক্ষ আমান উল্লাহ করোনাকালীন সময়ে একহাজার এইচএসসি পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে ফরম ফিলাপের নাম করে প্রায় ২৫ লক্ষ টাকা আত্মসাত করেছেন। তিনি কলেজের টাকা লুটপাট করে ছাত্রলীগের বিভিন্ন প্রোগ্রামে ডোনেশন দিতেন। শুধু তাই নয় এই আমান উল্লাহর বিরুদ্ধে নারী কেলেংকারীর ঘটনাও রয়েছে যা নিয়ে ২০০৪ সালে কলেজ ক্যাম্পাসে পোস্টারিংও করেছিল সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তার বিরুদ্ধে এত অভিযোগ থাকার পরও তিনি সবাইকে ম্যানেজ করেই চলছেন।
এব্যাপারে অধ্যক্ষ আমান উল্লাহর সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এদিকে অধ্যক্ষ আমান উল্লাহর এমন ষড়যন্ত্রের কারণে তার পদত্যাগ দাবিতে জোড় দাবি তুলেছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ স্বৈরাচারের দোসর সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আমান উল্লাহর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিবে এমনটিই আশা করছে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন ও শেখ হাসিনার পতনের আন্দোলনে অংশ নেয়া শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনগণ।
অধ্যক্ষ আমান উল্লাহর দুর্নীতির চিত্র নিয়ে পরবর্তী প্রতিবেদন দেখতে চোখ রাখুন ময়মনসিংহ লাইভে।