হজযাত্রীরা মিনায় পৌঁছেছেন। যেদিকে চোখ যায়, তাঁবু আর তাঁবু। চৌচালা ঘরের মতো এসব তাঁবুতে থাকবেন তাঁরা।
হাজিরা মিনায় বড় শয়তানকে পাথর মারবেন, কোরবানি দেবেন, মাথা মুণ্ডন বা চুল ছেঁটে মক্কায় গিয়ে কাবা শরিফ তাওয়াফ করবেন। তাওয়াফ, সাঈ শেষে আবার মিনায় ফিরে ১১ ও ১২ জিলহজ অবস্থান করবেন। সেখানে প্রতিদিন তিনটি শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করবেন তাঁরা। প্রত্যেক শয়তানকে সাতটি করে পাথর মারতে হয়।
মসজিদে খায়েফের দিক থেকে মক্কার দিকে আসার সময় প্রথমে জামারায় সগির বা ছোট শয়তান, তারপর জামারায় ওস্তা বা মেজ শয়তান এরপর জামারায় আকাবা বা বড় শয়তান।
জনশ্রুতি আছে, হজরত ইব্রাহিম (আ.) নিজ সন্তান ইসমাঈলকে (আ.) কোরবানি করার জন্য মিনায় নিয়ে যাচ্ছিলেন। জামারায় পৌঁছালে শয়তান তাঁকে ধোঁকা দেয়। তখন শয়তানকে লক্ষ্য করে তিনি পাথর নিক্ষেপ করেন। তিন শয়তানকে তাকবিরসহ পাথর নিক্ষেপ করা হজের অপরিহার্য অংশ। শয়তানের প্রতি ঘৃণা প্রকাশের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে এই পাথর নিক্ষেপ করা হয়।
ভিড় এড়ানোর জন্য মোয়াল্লেম গাড়িতে করে গত রোববার আমাদের মিনায় নিয়ে এসেছেন। অন্য সময় গাড়িতে মিনায় পৌঁছাতে ২০ মিনিট লাগে। গতকাল লাগল দুই ঘণ্টারও বেশি। রাস্তায় প্রচণ্ড যানজট। তবে হজযাত্রীদের মধ্যে এ নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই। এখানে সবাই সার্বক্ষণিক ইবাদত-বন্দেগির মধ্যে থাকেন।
সেলাইবিহীন দুই টুকরা সাদা কাপড় পরে হজের নিয়তে হজযাত্রীদের মুখে ছিল তালবিয়া ‘লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হাম্দা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুল্ক, লা শারিকা লাক’। কেউ কেউ দোয়ার বই পড়ছিলেন। আর যাঁরা অপেক্ষা করতে চাননি, তাঁরা হেঁটেই রওনা হচ্ছেন। কাঁধে ছোট ঝোলা।
অনেক বৃদ্ধকে হুইলচেয়ারে যেতে দেখা গেল। মিনার প্রবেশ পথ দিয়ে অনুমতিপত্র ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
মিনা এখন যেন তাঁবুর শহর। যেদিকে চোখ যায়, তাঁবু আর তাঁবু। আমরা পুরুষের এক তাঁবুতে। নারীরা আলাদা তাঁবুতে। প্রত্যেকের জন্য আলাদা ফোম, বালিশ, কম্বল বরাদ্দ। আর ফোমের নিচে বালু। সঙ্গে আনা চাদর বিছিয়ে ব্যাগ রেখে নামাজ আদায় করলাম।
মিনায় নামাজ আদায় করাটা হলো সারা দিনের কাজ। নামাজ তাঁবুর ভেতরেই জামাতের সঙ্গে পড়লাম। তাঁবুর মধ্যেই আমরা নামাজ, দোয়া দরুদ ও কোরআন শরিফ পড়তে থাকলাম। হজযাত্রীরা নিজ নিজ তাঁবুতে নামাজ আদায়সহ অন্যান্য ইবাদত করছেন।
সবাই প্রাণ খুলে মোনাজাত করি। জামাত হলেও যার যার ফোমের বিছানায় জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে দাঁড়াই। ফোমে দাঁড়াতে যাঁরা পারেন না, চেয়ারে বসে নামাজ আদায় করেন। একইভাবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করি। এক তাঁবুতে হয়তো আজান হচ্ছে, আর এক তাঁবুতে চলছে নামাজ, পাশের তাঁবুতেই হয়তো হচ্ছে হৃদয়গ্রাহী মোনাজাত।
প্রতি ঘণ্টায় তিন লাখ হাজি পাথর নিক্ষেপ করতে পারবেন। জামারা কেন্দ্রীয়ভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, এখানে তাপমাত্রা থাকে ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের জন্য জামারার ভেতরে একাধিক ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা বসানো আছে। রয়েছে পর্যাপ্ত টয়লেট, খাবারের দোকান ও সেলুন। জরুরি প্রয়োজনে হেলিকপ্টার অবতরণের জন্য রয়েছে হেলিপ্যাডও।
পাথর নিক্ষেপের সুবিধার্থে মিনার পূর্ব দিক থেকে আসা হাজিরা আসবেন নিচতলা ও দোতলায়, মক্কা থেকে আসা হাজিরা তৃতীয় তলায়, উত্তর দিক ও মোয়াইসিম থেকে আসা হাজিরা চতুর্থ তলায় এবং আজিজিয়া থেকে আসা হাজিরা পঞ্চম তলায় উঠে পাথর নিক্ষেপ করবেন। দুর্ঘটনা এড়াতে ১২টি করে ঢোকার ও বের হওয়ার পথ আছে এখানে।এবার হাজিদের পাথর মারার নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। মোয়াল্লেম নম্বর অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে পাথর মারতে হবে।
সৌদি মোয়াচ্ছাসা ১০ জিলহজ সকাল ৬টা থেকে ১০টা পর্যন্ত এবং ১১ থেকে ১৩ জিলহজ সকাল ১০টা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত পাথর মারতে না যেতে হাজিদের অনুরোধ করেছে।
এদিকে মক্কা সিটি করপোরেশনের ২৩ হাজার পরিচ্ছন্নকর্মী হাজিদের চলাচলের রাস্তা পরিষ্কার রাখবেন। মক্কার ৮টি হাসপাতাল, মিনা, মুজদালিফাও আরাফাতের ২৫টি মেডিকেল সেন্টার থেকে হাজিদের চিকিৎসাসেবা দেবে।
অ্যাম্বুলেন্সের বহরে ৫৭টি বড় ও ১২০টি মিনি অ্যাম্বুলেন্স সার্বক্ষণিক প্রস্তুত।এসব অ্যাম্বুলেন্সে নিবিড় পর্যবেক্ষণকেন্দ্র (আইসিইউ)ও চিকিৎসক রয়েছে। সেবার জন্য পাঁচটি হাসপাতালে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স অবতরণের জন্য পাঁচটি হেলিপ্যাড তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়া জরুরি সেবার জন্য রেডক্রিসেন্টের এয়ার অ্যাম্বুলেন্স মোতায়েন থাকবে।
তাঁবুর শহর মিনা
মিনার তাঁবুগুলোতে আগুন ধরার ঝুঁকি নেই। কারণ, মিনা এলাকায় আগুন জ্বালানো নিষেধ। তাহলে এত লোকের খাবার কোথা থেকে আসে? জবাব সোজা, মিনার বাইরে থেকে রান্না করে আনা হয়।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এসব তাঁবুতে বাতি আছে। আছে পর্যাপ্ত বাথরুম। কিছু দূর পর পর আছে খাবারের দোকান। এই দোকানগুলো বছরে পাঁচ দিনের জন্য খোলা থাকে। মোয়াল্লেমের কাছ থেকে দরপত্রের মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা দোকান নেন। অল্প সময়ের দোকান বলে জিনিসপত্রের দামও বাইরের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি।
হজের সময় হজযাত্রীদের নিরাপদ খাবার সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য মক্কার দোকানে চলবে নজরদারি। বিভিন্ন দেশ থেকে আগত হজযাত্রীদের খাদ্য ও জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে খাদ্য উৎপাদন, সরবরাহ ও বিক্রয়কারী এসব দোকান-রেস্টুরেন্টকে নজরদারির আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মক্কার কর্তৃপক্ষ। রয়েছে দমকল বাহিনীর কার্যালয়, ক্লিনিক ও হাসপাতাল।
হজের এই পাঁচ দিন ছাড়া মিনার পুরো এলাকা খালি পড়ে থাকে। চারপাশের প্রবেশদ্বারও তখন বন্ধ করে দেওয়া হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় বৈদ্যুতিক সংযোগ, পানির লাইন, টেলিফোন সংযোগ। হজের দুই দিন আগে মিনা এলাকার ফটক খোলা হয়। হজের দুই দিন পর আবার সব বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখন দিন-রাত হেলিকপ্টারে টহল দেওয়া হয়, কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না আল্লাহর মেহমানদের।
তাঁবুগুলো দেখতে একই রকম হওয়ায় অনেক হাজির পক্ষে পথঘাট ঠিক রেখে নিজের তাঁবুতে যাতায়াত কঠিন হয়। এর জন্য এখানে আছে স্কাউট, হজ গাইড। বাংলাদেশ হজ কার্যালয়ের পক্ষ থেকেও হজযাত্রীদের সহায়ক মিনার তাঁবু নম্বরসংবলিত মানচিত্র বিতরণ করা হচ্ছে।
মিনায় ১২/৫৬ নম্বর তাঁবু অর্থাৎ বাংলাদেশ হজ কার্যালয়ের সামনে অনেক হজযাত্রী ভিড় জমান, তাঁবু দেখতে একই রকম হওয়ায় হজযাত্রীরা কিছুক্ষণের জন্য নিজের তাঁবু হারিয়ে ফেলেন। তাদের আবার নিজ নিজ তাঁবুতে পৌঁছেও দেওয়া হয়।
মিনায় অবস্থান করা হজের অংশ। হজযাত্রীরা মিনার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখছেন। ১০ জিলহজের পর জামারায় খুব ভিড় থাকে। তখন ভালো করে দেখা যায় না।
মিনার কাছেই সৌদি বাদশাহর বাড়ি, রাজকীয় অতিথি ভবন। হজযাত্রীরা মোয়াচ্ছাসা (হজের সার্বিক বিষয় দেখাশোনার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ) কার্যালয়, রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন স্থান ঘুরে ঘুরে দেখছেন।
ঢাকার মানিকদী থেকে বোনকে নিয়ে হজ করতে এসেছেন রাসেল আহমেদ। তাঁরা বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান দেখছেন। মিনার একমাত্র মসজিদ মসজিদে খায়েফের সামনে গিয়ে বেশ ভালো লাগল। কারণ, সেখানে বাংলায় লেখা মসজিদে খায়েফ। আরও কয়েকটি ভাষাতেও মসজিদের নাম লেখা আছে।
মসজিদে খায়েফ ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন হজযাত্রী মোহাম্মদ মজনু মিয়া ও মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক। বললেন, ‘স্ত্রীকে ছেড়ে ঈদ করব, একটু খারাপ লাগছে। তবে পবিত্র হজ পালন করতে এসেছি, এটা ভেবে ভালো লাগছে।’
প্রথমবার হজে আসা রাহানা আকতার বললেন, ‘হজে আসতে পেরেছি। এর জন্য আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানাই।’ সামান্য এই ঘোরাফেরার বাইরে হাজিরা সারা দিন নিজ নিজ তাঁবুতে নামাজ আদায়সহ ইবাদত-বন্দেগি করছেন।