লোভের জিহ্বা কেটে দেবে দুদক

দুর্নীতিবিরোধী অভিযান অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, এখন মানুষের আর অভাব নেই। লোভেই দুর্নীতি করে। আমরা লোভের জিহ্বা কেটে দিতে চাই। অলরেডি সেটা শুরু করেছি। দুর্নীতি করলে এখন ডেফেনিটলি শাস্তি হয়। গতকাল রোববার দুদকের প্রধান কার্যালয়ে ‘দুর্নীতি দমন কমিশনের কৌশলপত্র-২০১৯’-এর ওপর মতামত ও পরামর্শ গ্রহণের জন্য দেশের ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা লোভের জিহ্বা কেটে দিতে চাই। সেটা আমরা কাটা শুরু করেছি। আপনি বললেন শাস্তি হয় না, ডেফেনিটলি শাস্তি হয়। ৬৩ শতাংশ শাস্তি এমনিতে হয়নি। গত বছর ছিল ৬৮ শতাংশ, এটা কমছে। আমরা তা পজিটিভভাবে দেখছি।’

তিনি বলেন, ‘লজ্জা এখন কেউ পায় না। এক সময় বলা হতো অর্থ অনর্থের মূল। কিন্তু সব সময় অর্থ অনর্থের মূল নয়। অনেক সময় অর্থই অর্থের মূল। অর্থ মানেই পাওয়ার বা ক্ষমতা। মানুষ অর্থের পেছনে ছোটে। এটাতে এখন লজ্জা পায় না তারা। আমরা লজ্জা ফেরানোর চেষ্টা করছি। দুর্নীতিবাজদের লজ্জা ফিরিয়ে আনতে হলে প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষা। মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষা এবং মূল্যবোধসম্পন্ন উন্নয়নের প্রয়োজন। দুদককে ভয় পায় না এমন লোক হয়তো সমাজে নেই। তবে ভয় দিয়ে সব কিছু জয় করা যায় না।’

উপস্থিত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘আপনারাই দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সবচেয়ে যোগ্য এবং মেধাবী সন্তান। আপনাদের কাছ থেকে দুর্নীতি প্রতিরোধে নতুন ধারণা, সৃজনশীল আইডিয়া এবং সর্বোপরি কর্মপন্থা গ্রহণ করতে চাই।’

দুর্নীতি দমনের সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সব দুর্নীতিই দুদকের ম্যান্ডেটভুক্ত নয়। দণ্ডবিধির কিছু ধারা এবং অবৈধ সম্পদ অর্জন দুদকের তফসিলভুক্ত। দুর্নীতির উৎস বন্ধেও সরকারের কাছে সুপারিশ করার আইনি দায়িত্ব দুদকের রয়েছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং মানুষের হয়রানি রোধে বিভিন্ন সুপারিশমালা কমিশনের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে প্রেরণ করা হচ্ছে।’

ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া দুর্নীতি দমন সম্ভব নয়’ এ বিষয়টি অনুধাবন করেই রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বচনী ইশতেহারে দুর্নীতি দমনের বিষয়টি প্রাধান্য দিয়েছে। একদিন বা এক বছরেই এ থেকে পরিত্রাণের উপায় নেই। একটি ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় দুর্নীতি অবশ্যই সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসবে। দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে শিক্ষাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’

মতবিনিময় সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যায়ের শিক্ষার্থী তামান্না রিফাত আরা বলেন, ‘দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে এমন কোনো পদ্ধতি নেই যার সাহায্যে দুর্নীতি করার সুযোগ বন্ধ করা হয়েছে।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো: সাইদুর রহমান বলেন, ‘অপরাধীদের বিচার দ্রুত করা না গেলে অপরাধ দমন করা সম্ভব নয়।’ তিনি দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়ার সমালোচনা করেন।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মিরা রহমান বলেন, ‘খাদ্যে ভেজাল দুর্নীতি। ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা এ দুর্নীতি করছে এবং তারাই নিরাপদ খাদ্যের জন্য হুমকি।’

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো: ফারুক হোসেন বলেন, ‘কৃষি ভর্তুকির অর্থ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানোর আগেই বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতি সংঘটিত হয়।’

আর্মড ফোর্সেস মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী মো: আশিকুর রহমান মিয়া বলেন, ‘আমরা সুশিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছি কি না এটি বড় প্রশ্ন।’ দুর্নীতিকে একটি চেইন অপরাধ হিসেবে বর্ণনা করে তিনি আরো বলেন, ‘নিচের দিকে কর্মরত কর্মকর্তারা জানেন তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও দুর্নীতিপরায়ণ। তাই দুর্নীতি করলে কিছু হবে না।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শম্পা গুহ বলেন, ‘পদ্ধতিগত কারণেই দুর্নীতি অপ্রতিরোধ্য।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শামস আসিফ চৌধুরী বলেন, ‘দুদক স্কুল পর্যায়ে সততা সংঘ গঠন করলেও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এ ধরনের কোনো সংগঠন নেই।’ তিনি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এথিকস্ ক্লাব গঠনের আহ্বান জানান।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অর্পিতা মহাজন বলেন, ‘আইনি সংস্কার এবং প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে।’ তিনি বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ এবং তাৎক্ষণিক ফল চাই।’

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী টোটনচন্দ্র দেবনাথ বলেন, ‘দুর্নীতি যারা করেন তাদের জন্য ভয় ও লজ্জার ব্যবস্থা করতে হবে।’ দুর্নীতি দমনে তিনি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের আহ্বান জানান।

এ সময় দুদক কমিশনার এ এফ এম আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘দুর্নীতি দুটি পর্যায়ে বেশি হয়। একটি প্রাতিষ্ঠানিক এবং অন্যটি ব্যক্তি পর্যায়ে।’ তিনি বলেন, ‘প্রাতিষ্ঠানিক মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে দুর্নীতি অবশ্যই কমে আসবে। হাসপাতালে পর্যাপ্ত ওষুধ রয়েছে কিন্তু রোগীদের দেয়া হচ্ছে না, শুধু মনিটরিংয়ের অভাবেই রোগীর কাছে ওষুধ পৌঁছাচ্ছে না।’

অন্যদিকে দুদক কমিশনার ড. মো: মোজাম্মেল হক খান বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা আদর্শিক অবস্থানে রয়েছেন। সুনীতি, সদাচার এবং দেশপ্রেমই তাদের আদর্শ। তাদের কোনো ব্যক্তিস্বার্থ কিংবা গোষ্ঠীস্বার্থ নেই। পদ্ধতিগত সংস্কার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সিটিজেন চার্টার, ই-টেন্ডারিং পদ্ধতি, ক্রয় নীতিমালা সবই পদ্ধতিগত সংস্কারের অংশ।’

মতবিনিময় সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন দুদক মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) সারোয়ার মাহমুদ। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন দুদক সচিব মোহাম্মদ দিলোয়ার বখ্ত, মহাপরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী, মহাপরিচালক (তদন্ত) মো: মোস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top