কাশ্মিরের পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলার কড়া ব্যবস্থা হিসেবে পাকিস্তানকে ‘একেবারে একঘরে’ করতে কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে ভারত। আন্তর্জাতিকভাবে পাকিস্তানকে একঘরে করে ফেলতে জাতিসঙ্ঘের পাঁচ স্থায়ী সদস্য, জাপান ও ইউরোপীয় দেশগুলোর প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করছে ভারত। চীনসহ এসব দেশের দূতদের কাছে সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষকতায় পকিস্তানের ভূমিকা ব্যাখ্যা করছেন ভারতের কূটনীতিকেরা। তারা বিশ্বনেতাদের প্রতি পাকিস্তানকে একঘরে করার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে এ লক্ষ্যে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে কোনো প্রস্তাব আনা হলে সে ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে রক্ষায় চীন ভেটো দিতে পারে। তাই কূটনৈতিকভাবে পাকিস্তানকে শায়েস্তা করার ভারতের সুযোগ সীমিত।
বৃহস্পতিবার কাশ্মিরের পুলওয়ামায় ভয়াবহ হামলায় ৪৪ জন সিআরপিএফ জওয়ান নিহতের পর শুক্রবার সকালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাসভবনে জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা কমিটির ওই বৈঠকের পর অর্থমন্ত্রী অরুন জেটলি জানান, পাকিস্তানকে দেয়া ‘মোস্ট ফেভারড নেশন’ মর্যাদা প্রত্যাহার করবে ভারত। আগের দিন সন্ধ্যায় জয়েশ-এ-মোহাম্মদ নেতা মাসুদ আজহারকে সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত করতে ভারতের প্রস্তাবে সমর্থন করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এর আগে ভারতের ওই প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে আটকে দিয়েছিল চীন।
খবরে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া ও ফ্রান্স সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের পাশে দাঁড়ানোর কথা বললেও নিরবতা ভেঙে চীন জানিয়ে দিয়েছে মাসুদ আজহারকে নিয়ে তাদের নীতি অপরিবর্তিত রয়েছে। শুক্রবার চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গেং সুয়াং বলেছেন, সন্ত্রাসী সংগঠন তালিকাভুক্তির বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদের সংশ্লিষ্ট কমিটির নিজস্ব সনদ রয়েছে।
মাসুদ আজহারকে সন্ত্রাসীর তালিকায় অন্তর্ভুক্তি করতে পারলে তা জয়েশ-ই-মুহাম্মদের জন্য বড় ধরনের আঘাত হতে পারে। যদিও এই সংগঠন পাকিস্তানে নিষিদ্ধ। তবে ভারত ও মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, বিভিন্ন ছদ্মনামে সংগঠনটি পাকিস্তানে কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে ও তহবিল সংগ্রহ করছে। বেশ কয়েক বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা করছে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের সন্ত্রাসীদের তালিকায় মাসুদ আজহারকে অন্তর্ভুক্ত করতে। শুক্রবার এক মার্কিন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, চীন সবসময় এই উদ্যোগ আটকে দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউজের পক্ষ থেকে সন্ত্রাসীদের সহযোগিতা বন্ধের জন্য পাকিস্তানের প্রতি দাবি জানানো হয়। কাশ্মির হামলার পর পাকিস্তানের হাইকমিশনার সোয়াইল মাহমুদকে তলব করে ভারত। তাকে কড়া রাজনৈতিক শাস্তির বিষয়ে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। ভারতের তরফ থেকে পাকিস্তানকে জয়েশ-এ-মোহাম্মদের বিরুদ্ধে দ্রুত এবং প্রমাণসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া পাকিস্তানের অভ্যন্তরে তৎপর বা সহায়তা পাওয়া সন্ত্রাসে জড়িত ব্যক্তি ও সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও সতর্ক করা হয়। এ ছাড়া ইসলামাবাদে নিযুক্ত ভারতীয় দূত অজয় বিসারিয়াকে ডেকে পাঠিয়েছে দিল্লি।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাশ্মিরের হামলাকে ‘গভীর উদ্বেগের’ বিষয় উল্লেখ করে বিবৃতি দিয়েছে। সংক্ষিপ্ত ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভারত সরকার বা দেশটির সংবাদমাধ্যমে তদন্ত ছাড়াই এই ঘটনার সাথে পাকিস্তানকে জড়িত করার যেকোনো পরোক্ষ ইঙ্গিতের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে পাকিস্তান।’
কাশ্মিরে হামলার পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে যেকোনো সময় যেকোনো পদক্ষেপ নেয়ার স্বাধীনতা ও অনুমতি দেশটির সেনাবাহিনীকে দেয়ার কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তবে মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমস বিশ্লেষকদের বরাতে জানিয়েছে, কাশ্মির হামলার ঘটনায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রেও সুযোগ সীমিত ভারতে। বিশেষ করে তুষারে ঢাকা দীর্ঘ সীমান্ত ও পাকিস্তানের সেনারা সর্বোচ্চ অবস্থায় থাকার কারণে এই সামরিক পদক্ষেপের সুযোগও কমে এসেছে।
২০১৬ সালে উরিতে ভারতীয় সেনা ঘাঁটিতে জয়েশ-ই-মুহাম্মদের নামে হামলার পর পাকিস্তানের ভেতরে এক সামরিক অভিযান চালায় ভারত। নয়াদিল্লি এই অভিযানকে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক হিসেবে অভিহিত করে। বিশেষকেরা বলছেন, বৃহস্পতিবারের হামলার প্রকৃতি জানান দেয়, এখন কাশ্মিরের স্থানীয়রা অনেক বেশি সশস্ত্র পন্থায় ঝুঁকে পড়ছে। এর সাথে পাকিস্তানের এত গভীর সম্পর্ক কিভাবে কাজ করতে তার সুদুত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। আত্মঘাতী হামলাকারী আদিল আহমদ দার ঘটনাস্থল থেকে ছয় মাইল দূরের একটি গ্রামের বাসিন্দা।
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, আগে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে সশস্ত্র কর্মকাণ্ড ও অস্ত্র এলেও এবারের হামলায় ব্যবহৃত যে গাড়িতে বিস্ফোরক ছিল তা স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও কাশ্মিরে নিরাপত্তাবাহিনীর কর্মকাণ্ডে কাশ্মিরিদের মধ্যে স্বাধীনতার দাবি জোরালে হওয়ার ফলেই এমনটা হয়ে থাকতে পারে।
দিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হ্যাপিমন জ্যাকব জানান, মোদি ক্ষমতায় আসার এক বছর আগে ২০১৩ সালে সশস্ত্র আন্দোলনে যোগদানকারী কাশ্মিরি যুবকের সংখ্যা ছিল খুম কম। কিন্তু গত বছর সশস্ত্র সংগ্রামে যোগ দেয়া যুবকের সংখ্যা ১৫০ ছাড়িয়ে গেছে। কাশ্মিরের সঙ্ঘাত পর্যালোচনা করা অধ্যাপক জ্যাকব বলেন, ইসলামী আদর্শের কারণে তারা লড়াইয়ে জড়াচ্ছে না। তারা মাত্র গ্র্যাজুয়েট হয়েছে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বা চাকরি করছে। কিন্তু পুরো একটি প্রজন্ম কাশ্মিরে ভারতীয় নীতির ব্যর্থতার কারণে অনেক বেশি ক্ষুব্ধ।
সূত্র : রয়টার্স ও এনডিটিভি