খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের চার্চ ব্যবস্থায় নানা ধরনের যৌন নির্যাতনের কাহিনী সম্প্রতি অনেক শোনা যাচ্ছে। বিশেষ করে চার্চের পাদ্রী, ধর্মযাজক ও অন্যান্য ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের দ্বারা শিশুদের যৌন নির্যাতনের কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত ক্যাথলিক চার্চ।
থিওডোর ম্যাককারিক রোমান ক্যাথলিক ঘরানার একজন সাবেক কার্ডিনাল। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে পাঁচ বছরের মতো আর্চবিশপের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
থিওডোর ম্যাককারিক হলেন এ পর্যন্ত সবচেয়ে উচ্চ পদবীধারী ও প্রভাবশালী কোনো ক্যাথলিক ব্যক্তিত্ব যার ধর্মযাজক পদবি কেড়ে নেয়া হলো।
ভ্যাটিকান থেকে বলা হয়েছে, পোপ ফ্রান্সিস তার বহিষ্কারের ব্যাপারে চূড়ান্ত রায় দিয়েছেন এবং এ ব্যাপারে আপিলের কোনো সুযোগ নেই।
মার্কিন চার্চ কর্তৃপক্ষ বলছেন তার বিরুদ্ধে এক কিশোরকে পাঁচ দশক আগে যৌন নির্যাতনের যে অভিযোগ উঠেছে তার বিশ্বাসযোগ্যতা পাওয়া গেছে।
তার বিরুদ্ধে আরও বেশ কজন পুরুষ অভিযোগ করেছেন যে ধর্মযাজক হওয়ার জন্য তারা যখন পড়াশোনা করছিলেন তখন থিওডোর ম্যাককারিক তাদের যৌন সম্পর্কে বাধ্য করেছেন।
এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাথলিক বিশপদের সংঘ বলছে, “কোন বিশপ, সে যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।”
বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, “ম্যাককারিক যত নির্যাতন চালিয়েছেন তার ক্ষত নিরাময়ে এটি একটি ছোট ধাপ মাত্র।”
এসব অভিযোগ ওঠার পর এমনিতেই চার্চ থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন ম্যাককারিক।
১৯২৭ সালের পর তিনি পদত্যাগ করা প্রথম কার্ডিনাল। এখন ৮৮ বছর বয়সী ম্যাককারিক এমন কিছু কখনো করেছেন কিনা মনে করতে পারছেন না বলে দাবি করেছেন।
কী ধরনের অভিযোগ উঠেছে?
রোমান ক্যাথলিক চার্চে যৌন নির্যাতনের যে অভিযোগ একের একের পর উঠছে সেগুলো মোকাবেলায় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে মনে করা হচ্ছে।
যৌন নির্যাতনের কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত ক্যাথলিক চার্চ সম্পর্কিত যেসব ঘটনা শোনা যাচ্ছে এটি তার মধ্যে সবচেয়ে নতুন।
জার্মানিতে ফাঁস হয়ে যাওয়া কিছু নথিপত্রে দেখা গেছে ১৯৪৬ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সাড়ে তিন হাজারের বেশি শিশু পাদ্রী ও ধর্মযাজকদের দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভিনিয়াতে এক প্রতিবেদনে ৩০০ জন ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের নাম প্রকাশ করা হয়েছে যাদের কাছে এক হাজারের বেশি যৌন নির্যাতনের শিকার।
ধর্মযাজিকারাও এমন নির্যাতনের শিকার বলে সম্প্রতি খবরে প্রকাশিত হয়েছে।
চার্চের উচ্চপদস্থ ধর্মীয় ব্যক্তিরা এসব অভিযোগ নানা সময়ে চাপা দেয়ার চেষ্টা করেছেন বলে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে।
সূত্র : বিবিসি
পোপ ফ্রান্সিস : নানদের যৌনদাসী করেছিলেন যাজকরা
পোপ ফ্রান্সিস স্বীকার করেছেন যে, গির্জার যাজকরা নানদের যৌন নিপীড়ন করেছেন। এমনকি অনেক যাজক নানদের যৌনদাসী করেও রেখেছিলেন।
তিনি বলেছেন, তার পূর্বসূরি পোপ বেনেডিক্ট এ কারণে পুরো একটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
ধারণা করা হচ্ছে, গির্জার নানরা যে যাজকদের হাতে যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন, সেটা এই প্রথমবারের মতো স্বীকার করলেন পোপ ফ্রান্সিস।
তিনি বলেছেন, এই সমস্যাটি মোকাবেলার চেষ্টা করেছে গির্জা, তবে এসব ঘটনা এখনো ঘটছে।
গত নভেম্বর মাসে ক্যাথলিক গির্জার নানদের বৈশ্বিক সংগঠন জানায়, ‘ভয় ও নীরবতার সংস্কৃতির’ কারণে নানরা গির্জার এই যৌন নিপীড়নের ব্যাপারে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে পারেননি।
গির্জায় যাজকদের দ্বারা শিশু এবং তরুণদের ওপর যৌন নিপীড়নের লম্বা অভিযোগের মধ্যেই পোপ ফ্রান্সিস এই মন্তব্য করলেন।
পোপ কী বলেছেন?
মঙ্গলবার মধ্যপ্রাচ্যে একটি ঐতিহাসিক সফরের সময় সাংবাদিকদের পোপ ফ্রান্সিস বলেন, ”নারীদের দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ হিসাবে দেখার প্রবণতাটি এখনো গির্জায় একটি সমস্যা হিসাবে রয়ে গেছে।”
তিনি বলেছেন, ”যাজক এবং বিশপরা নানদের নিপীড়ন করেছেন। তবে গির্জা এখন এসব কেলেঙ্কারি নিয়ে সতর্ক হয়েছে এবং এটি বন্ধে কাজ করছে। বেশ কয়েকজন যাজককে বরখাস্ত করা হয়েছে। ”
”পোপ বেনেডিক্ট সাহস নিয়ে নারীদের একটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছিলেন, কারণ সেখানে যাজক বা প্রতিষ্ঠাতাদের হাতে নারীদের নিপীড়নের বিষয়টি যৌন দাসত্বে রূপ নিয়েছিল।
পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন, নানদের ওপর যৌন নিপিড়নের এখনো গির্জার একটি অব্যাহত সমস্যা, তবে কয়েকটি বিশেষ প্রতিষ্ঠানেই এগুলো ঘটছে, বিশেষ করে নতুনদের ক্ষেত্রে।
”আমি মনে করি, এটা এখনো ঘটছে, কারণ এটা এমন নয় যে, আপনি বিষয়টি জানার সঙ্গে সঙ্গেও তা বন্ধ হয়ে যাবে।”
কোথায় যৌন নিপিড়নের ঘটনা ঘটেছে?
পোপ বেনেডিক্ট ২০০৫ সালে ফ্রান্সের কম্যুনিটি অফ সেন্ট জেন নামে নারীদের একটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেন।
২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠানটি রোমান ক্যাথলিক পত্রিকার কাছে স্বীকার করে যে, যাজকরা বেশ কয়েকজন নারীর সঙ্গে এমন আচরণ করেছেন, যা তাদের কৌমার্য রক্ষার ব্রতের সঙ্গে খাপ খায়না।
ভারতে আরেকটি ঘটনায় গতবছর একজন বিশপকে গ্রেপ্তার কার হয়, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে ২০১৪ সাল থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে একজন নানকে ১৩বার ধর্ষণ করেছেন। যদিও ওই যাজক অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
গত বছর চিলিতে যাজকদের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তোলেন গির্জার নানরা। এরপর তদন্ত শুরু করে ভ্যাটিকান।
ইটালি এবং আফ্রিকার গির্জায় যৌন নিপীড়নের কয়েকটি ঘটনার খবর প্রকাশ করে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস।
চার্চের নারীরা কী বলছেন
ভ্যাটিকানের নারীদের ম্যাগাজিন, উইমেনস চার্চ ওয়ার্ল্ড বলছে, অনেক ঘটনায় নানরা ধর্মীয় বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও গর্ভপাত করাতে বাধ্য হয়েছেন।
নিপীড়নের বিষয়ে পোপের এই স্বীকারোক্তিকে স্বাগত জানিয়ে ম্যাগাজিনের সম্পাদক লুসেত্তা স্কারাফিয়া বলছেন, এটা হয়তো খানিকটা সাহায্য করবে,কিন্তু গির্জাকে আসলে শক্ত ভূমিকা নিতে হবে।
”এ ধরণের কেলেঙ্কারির প্রতি যদি বরাবরের মতো গির্জা চোখ বন্ধ করে রাখে, তাহলে নারীদের ওপর নির্যাতনের পরিস্থিতি কখনোই পাল্টাবে না।” তিনি বলছেন।
#মি টু আন্দোলনের কারণে অনেক নারী এখন তাদের নির্যাতনের বিষয়টি সামনে তুলে ধরছেন বলে ম্যাগাজিনটি মনে করে।
সূত্র : বিবিসি