৭ই মার্চের ভাষণ: শেখ মুজিব যেভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ এসেছিল এক ধারাবাহিক রাজনৈতিক আন্দোলনের পটভূমিতে। আন্দোলনের একপর্যায়ে মার্চের প্রথম দিন থেকেই উত্তাল হয়ে উঠেছিল ঢাকার রাজপথ। এর মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উড়ানো হয়েছে। পাঠ করা হয়েছে স্বাধীনতার ইশতেহার এবং নির্বাচন করা হয়েছে জাতীয় সঙ্গীত।

কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার প্রশ্নে বা আন্দোলনের ব্যাপারে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত কবে দেবেন, সেজন্যই ছিল মানুষের অধীর অপেক্ষা।

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবের ঘনিষ্ট ছিলেন। ২০১৬ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তোফায়েল আহমেদ বলছিলেন, আন্দোলন এবং মানুষের আকাঙ্খা বিবেচনায় নিয়েই শেখ মুজিব ৩রা মার্চ পল্টনে ছাত্র সমাবেশে ৭ই মার্চ ভাষণ দেয়ার ঘোষণা করেছিলেন।

একদিকে আন্দোলনের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়ার ব্যাপারে চাপ ছিল। সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণার দাবিতে ছাত্র নেতাদের একটা অংশ চাপ তৈরি করছিল। অন্যদিকে আলোচনার পথ খোলা রাখা হয়েছিল। ফলে শেখ মুজিব ছাত্র নেতা থেকে শুরু করে জাতীয় নেতা পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলেন।

৬ই মার্চ রাতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তাজউদ্দিন আহমেদসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ কয়েকজন নেতার সাথে আলোচনা করেছিলেন।

তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, “সামরিক শাসন তুলে নেয়া এবং সৈন্যদের ব্যারাকে ফেরত নেয়াসহ পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি চারটি শর্তের ব্যাপারেই শুধু বঙ্গবন্ধু তার সহকর্মীদের সাথে আলোচনা করেছিলেন। ভাষণ দিতে বাসা থেকে বেরোনোর সময় শেখ মুজিবকে তার স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব বলেছিলেন – তুমি যা বিশ্বাস করো, তাই বলবে। ৭ই মার্চের সেই ভাষণ তিনি নিজের চিন্তা থেকেই দিয়েছিলেন। ভাষণটি লিখিত ছিলো না।”

৭ই মার্চ সকাল থেকেই ঢাকায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে ছিল আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা এবং ছাত্র নেতাদের ভিড়। দুপুর দু‌’টার দিকে আব্দুর রাজ্জাক এবং তোফায়েল আহমেদসহ তরুণ নেতাকমীদের সাথে নিয়ে শেখ মুজিব তার বাড়ি থেকে রওনা হয়েছিলেন জনসভার উদ্দেশ্যে।

এদিকে সকাল থেকেই রাজধানী ঢাকা পরিণত হয়েছিল মিছিলের নগরীতে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সে সময় রেসকোর্স ময়দান নামে পরিচিত ছিল। সেই রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ মানুষের অপেক্ষার পালা শেষ করে সাদা পায়জামা পাঞ্জাবী এবং হাতাকাটা কালো কোট পড়ে শেখ মুজিব উপস্থিত হয়েছিলেন।

তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, আগের নির্ধারিত রাস্তা বাদ দিয়ে ভিন্নপথে তাকে সেখানে নেয়া হয়েছিল। মঞ্চে সকাল থেকেই গণসঙ্গীত চলছিল। সেদিন শেখ মুজিব সেই মঞ্চে একাই ভাষণ দিয়েছিলেন। ৭ই মার্চে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা আসতে পারে । মানুষের মধ্যে এ ধরণের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল।

তোফায়েল আহমেদ মনে করেন, প্রায় ১৮ মিনিটের এই ভাষণে সবদিকই উঠে এসেছিল।

”যাতে বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা না হয়, সেজন্য তিনি চারটি শর্ত দিয়ে পাকিস্তান ভাঙ্গার দায় নেননি। অন্যদিকে, এই একটি ভাষণের মাধ্যমে তিনি একটি জাতিকে সশস্ত্র বাঙ্গালী জাতিতে রূপান্তর করেছিলেন। স্বাধীনতার বীজ তিনি বপন করেছিলেন,” বলেছেন তোফায়েল আহমেদ।

তিনি আরও বলেছেন, ”এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকো – এই বক্তব্যের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু একটা গেরিলা মুক্তিযুদ্ধের দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন।”

জনসভায় ছিলেন এমন অনেকে বলেছেন, লাঠি, ফেস্টুন হাতে লাখ লাখ মানুষ উত্তপ্ত শ্লোগানে মুখরিত থাকলেও শেখ মুজিবের ভাষণের সময় সেখানে ছিল পিনপতন নিরবতা। ভাষণ শেষে আবার স্বাধীনতার পক্ষে শ্লোগান মুখর হয়ে উঠেছিল ঢাকার রাস্তাগুলো।

সূত্র: বিবিসি বাংলা।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top