১৯ বছরেও রহস্যাবৃত নাইন ইলেভেন

১১ সেপ্টেম্বর ২০০১! মঙ্গলবার সকাল। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ সেদিনও স্বাভাবিকভাবেই দিনের শুরু করেছিল। তবে দিনটি সুখকর হয়নি। এমনকি এখনও দিনটি দেশবাসীর জন্য ‘দুঃস্বপ্নের দিন’ হয়ে আছে।

সেদিন পরপর চারটি বিমান হামলায় প্রাণ হারায় প্রায় ৩ হাজার মানুষ। এ ঘটনায় স্তব্ধ হয়ে যায় বিশ্ব! পাল্টে যায় রাজনীতির প্রেক্ষাপট। পাল্টে যায় অনেক চেনা হিসাব। কিন্তু গত ১৯ বছরেও মেলেনি অনেক প্রশ্নের জবাব। ভয়াবহ এই হামলার পেছনে কারা মদদ জুগিয়েছিল? কোথায় হয়েছে এর পরিকল্পনা? মোটাদাগে বিশ্ববাসী এই হামলা সম্পর্কে যা জানে, সেটাই কি সত্য? নাকি এর পেছনেও লুকিয়ে আছে আরো বড় কোনো সত্য। হয়নি তার চুলচেড়া বিশ্লেষণ। হামলার ১৯ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও এ নিয়ে বিতর্ক শেষ হয়নি। ক্যালিফোর্নিয়ার চ্যাপম্যান বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৬ সালে একটি জরিপ পরিচালনা করে। জরিপে বলা হয়, অর্ধেকেরও বেশি আমেরিকান বিশ্বাস করে, সরকার ৯/১১-র ঘটনা সম্পর্কে তথ্য গোপন করেছে।

অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া এই হামলা সম্পর্কিত ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ নিয়ে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কারেন ডগলাস বলেন, যখন কোনো একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে তখন লোকেরা এর একটা ব্যাখ্যা পেতে চায়। কিন্তু অনেক সময় সরকারি ব্যাখ্যা জনগণকে সন্তুষ্ট করতে পারে না। তারা চায়, ঘটনা যে মাপের ব্যাখ্যাটাও সেই মাপের হতে হবে। আর তা না হলেই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের জন্ম হয়। টুইন টাওয়ারে হামলার ব্যাপারেও তাই ঘটেছে।

সেদিন যা ঘটেছিল

১৯ জনের একটি সন্ত্রসী দল চারটি বিমান ছিনতাই করে সিরিজ আক্রমণ করে। সন্ত্রসীরা এ কাজে এমন সব বিমান ব্যবহার করেছিল যেগুলোতে প্রচুর পরিমাণ জ্বালানি ছিল। বিস্ফোরণের সুবিধা নিতেই তারা এভাবে পরিকল্পনা করেছিল। প্রথম হামলা হয় স্থানীয় সময় ৮.৪৬ মিনিটে। মুহূর্তেই ধ্বসে পড়ে আমেরিকার ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার। দ্বিতীয় হামলা হয় সকাল ৯.০৩ মিনিটে। ‘টুইন টাওয়ার’ হিসেবে পরিচিত বিশ্বের অন্যতম উঁচু দালানটিতে আঘাত হানে সন্ত্রাসীদের দখল করা দুটি যাত্রীবাহী বিমান। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে এমন ধ্বংসযজ্ঞ বিশ্ববাসীর কল্পনাকেও হার মানায়। মুহূর্তে নিউইয়র্কের নীলাকাশ ঢেকে যায় নিকষ কালো ধোঁয়ায়। সবার চোখের সামনে মুখ থুবড়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক গৌরবের প্রতীক ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার। শুধু তাই নয়, তৃতীয় হামলা করা হয় সকাল ৯.৩৭ মিনিটে পেন্টাগনে। যা যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক গৌরবের প্রতীক। এ ছাড়াও পেনসিলভেনিয়ায় আরেকটি বিমান হামলার চেষ্টা সেদিন ব্যর্থ হয়। শাংকসভেলি এলাকায় বিমানটি বিধ্বস্ত হয়।

এদিকে, ২০১৬ সালে প্রকাশিত আল কায়েদার মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত ‘আল-মাসর’ নামে এক সাময়িকীতে দাবি করা হয়, মিসরের কো-পাইলট গামিল আল-বাতৌতির একটি ঘটনা ওসামা বিন লাদেনের কাছে এই হামলার প্রেরণা যুগিয়েছিল। সাময়িকীতে দাবি করা হয়, ১৯৯৯ সালে আটলান্টিক মহাসাগরে মিসরের একটি বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা থেকে ৯/১১-এর হামলার ধারণা পেয়েছিলেন ওসামা। সেই বিমানের কো-পাইলট ছিলেন গামিল। লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে কায়রোগামী বিমানটি গামিল ইচ্ছাকৃতভাবে সাগরে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন বলে কথিত রয়েছে।

বুশ প্রশাসনের পদক্ষেপ

হামলার সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ ফ্লোরিডার একটি স্কুল পরিদর্শন করছিলেন। সেসময় চিফ অব স্টাফ অ্যান্ড্রু কার্ড প্রেসিডেন্ট বুশকে বিমান হামলার বিষয়টি অবহিত করেন। ঘটনার দিন রাত ৮.৩০ মিনিটে প্রেসিডেন্ট বুশ জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। এই ভাষণেই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি পাল্টে দেওয়ার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল। হামলার ফল হিসেবে বলা যায়, ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোকে আর্টিকেল ৫ বাস্তবায়নের জন্য আহ্বান জানানো হয়। এক্ষেত্রে যৌথ আত্মরক্ষা মনে করে সে বছরই অক্টোবরের ৭ তারিখ আফগানিস্তানে হামলা চালায় মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো সামরিক বাহিনী। তারা ৯/১১-এর হামলাকে ‘আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্ট এবং ধৃষ্টতাপূর্ণ হামলা’আখ্যা দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সম্মিলিত ন্যাটো বাহিনী ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’একতাবদ্ধ হয়। আফগানিস্তানে হামলা চালিয়ে তারা ক্ষমতাচ্যুত করে তালেবান জঙ্গিদের। আফগান যুদ্ধ শুরুর পর ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ অংশ হিসেবে হামলা হয় ইরাকে। হামলার কয়েক মাসের মধ্যেই আল-কায়েদার অনেক নেতাকে হত্যা এবং বন্দি করা হয়। তবে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যান হামলার মূল নায়ক ও আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন। তবে শেষ রক্ষা হয়নি বিন লাদেনের। টুইন টাওয়ার ধ্বংসের প্রায় ১০ বছর পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার নির্দেশে ২০১১ সালের ২ মে পাকিস্তানের অ্যাবটাবাদের একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে লাদেনকে হত্যা করে মার্কিন নেভি সিল সদস্যরা। প্রেসিডেন্ট ওবামা টেলিভিশনে দেওয়া এক রাষ্ট্রীয় ভাষণে দেশবাসীকে এ তথ্য জানিয়েছিলেন।

Share this post

scroll to top