সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি লোক মারা গেছে ময়মনসিংহে

মোহাইমীন : ২০১৯ সালে সারা দেশের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে ময়মনসিংহে। গতকাল প্রকাশিত এক জরিপে সড়ক দুর্ঘটনায় শুধু ময়মনসিংহেই  ৪৮৮ জন মানুষ মারা গেছেন বলে দাবি করা হয়েছে। ২০১৯ সালে সারা দেশের মধ্যে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ঢাকায় (৩০৯টি)। এতে নিহত হয়েছে ৩৩৫ জন ও আহত হয়েছে ৩২৭ জন। আর সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে কম মারা গেছেন ঝালকাঠিতে (৫ জন)। সবচেয়ে কম দুর্ঘটনা ঘটেছে খাগড়াছড়িতে (৭টি)। এতে নিহত হয়েছে ২৭ জন ও আহত হয়েছে ১০ জন।

নিরাপদ সড়ক চাই এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেছেন, পুলিশ এবং প্রশাসনের অবহেলায় মহাসড়কে বেড়েছে দুর্ঘটনার সংখ্যা। ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে মোট ৪ হাজার ৭০২টি। নিহত হয়েছে ৪ হাজার ৩৫৬ জন যাত্রী। এসময় আহত হয়েছে ৬ হাজার ৯৫৩ জন। তবে হাসপাতালে ভর্তির পর ও হাসপাতাল থেকে রিলিজ হওয়ার পর আনুমানিক মৃত্যু হয়েছে ২০ শতাংশ অর্থাৎ ৮৭১ জনের। সব মিলিয়ে ২০১৯ সালের মোট নিহতের সংখ্যা ৫ হাজার ২২৭ জন। এছাড়া রেলপথে ১৬২টি দুর্ঘটনার ঘটনায় নিহত হন ১৯৮ জন এবং আহত হন ৩৪৭ জন। অন্যদিকে নৌ দুর্ঘটনার সংখ্যা ৩০টি, এতে নিহত হয়েছেন ৬৪ জন এবং আহত হিন ১৫৭ জন।

২০১৯ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ৫ হাজার ২২৭ জনের। ২০১৮ সাল থেকে এই বছর নিহতের সংখ্যা বেড়েছে ৭৮৮ জন। শনিবার সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে নিরাপদ সড়ক চাই এর এক প্রতিবেদনে তিনি এই তথ্য জানান।

নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর না হওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, গত বছরের ১ নভেম্বর থেকে কার্যকর হচ্ছে বলে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ থেকে ২৩ অক্টোবর এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হলেও তা সম্ভব হয়নি। নতুন সড়ক পরিবহন আইন নিয়ে একটি মহল ষড়যন্ত্র করছে। নতুন পরিবহন আইন নিয়ে চালকদের মধ্যে ভুল ধারণা দিয়েছে মালিকরা।

তিনি আরও বলেন, দেশের দুর্ঘটনা গত বছর ২০১৯ সালে বিগত ২ বছরের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। অশিক্ষিত ও অদক্ষ চালক, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, জনগণের অসচেতনতা, অনিয়ন্ত্রিত গতি, রাস্তা নির্মাণের ত্রুটি, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, আইন এবং তার যথারীতি না প্রয়োগ ইত্যাদিই এসব দুর্ঘটনার মূল কারণ।

ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার প্রকৃত সংখ্যা সঠিক ও নিখুঁতভাবে নির্ণয় করা আমাদের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এটা করার দায়িত্ব সরকারের। ইতিপূর্বে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের নির্দেশ থাকা সত্ত্বে পুলিশ, সিভিল সার্জন ও জেলা প্রশাসন থেকে নিরাপত্তা কাউন্সিলে নিয়মিত কোনো তথ্য প্রদান না করার কারণে সরকারিভাবে কোনো পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়ে না। প্রতিবারের মতো এবারও আমরা যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি দুর্ঘটনা অনুসন্ধান সেল গঠন করে প্রতিবছরের সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য জাতির কাছে উপস্থাপন করার অনুরোধ জানাচ্ছি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৯ জন বাসচালক ও সহকারী এবং ৭২ জন ট্রাকচালক ও সহকারী মারা গেছেন। এ ছাড়া ২ হাজার ৬৬১ জন পথচারী মারা গেছেন, যা মোট দুর্ঘটনার ৫০ দশমিক ৪ শতাংশ। পথচারীরা গাড়ি চাপায়, পেছন দিক থেকে ধাক্কাসহ বিভিন্নভাবে দুর্ঘটনায় পড়েছে। ট্রাফিক আইন সম্পর্কে ধারণা না থাকা, রাস্তা চলাচল ও পারাপারে মোবাইল ব্যবহার, জেব্রা ক্রসিং, আন্ডারপাস, পদচারী-সেতু ব্যবহার না করা, যত্রতত্র পারাপারের ফলে পথচারীরা দুর্ঘটনায় পড়ছে।

গত বছর বেশির ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে বড় শহর ও মহাসড়কগুলোতে। অবৈধ যানবাহন ভ্যান, রিকশা, নছিমন, অটোরিকশা এ জন্য দায়ী বলে প্রতীয়মান হয়। আইনকে অমান্য করে ধীরগতির বাহন মহাসড়কে এখনো চলাচল করে, যা দূরপাল্লার বড় গাড়িগুলোর চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। স্থানীয় প্রশাসন ও হাইওয়ে পুলিশকে এই ব্যাপারে তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা নিতে দেখা যায় না।

২০১২ সাল থেকে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন করে আসছে নিসচা। এবারের প্রতিবেদনটি ১১টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ, টিভি চ্যানেল ও অনলাইন গণমাধ্যমের তথ্য, নিসচার ১২০টি শাখা সংগঠনের তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে।
নিসচার প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালে মোটরসাইকেলে দুর্ঘটনার সংখ্যা ১ হাজার ৯৮টি।

নিহত হয়েছেন ৬৪৮ জন মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহী। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ২০১৯ সালের ২০ অক্টোবরের হিসাব অনুযায়ী দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ২৭ লাখ ৮৬ হাজার ৯৫৪টি। আর ড্রাইভিং লাইসেন্সের সংখ্যা ১৩ লাখ ৬০ হাজার ৯০৩টি। এতে প্রতীয়মান হচ্ছে, ১৪ লাখ ২৬ হাজার ২৫১ জন চালক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাকের ডগা দিয়ে অবৈধভাবে মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ বিআরটিএ তাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে যেন তাদের কিছুই করার নেই।

সংবাদ সম্মেলনে নিসচার পক্ষ থেকে আটটি সুপারিশ দেওয়া হয়। এর মধ্যে অন্যতমগুলো হলো: ট্রাফিক সিগন্যাল মানা, যত্রতত্র পার্কিং না করা, ওভারটেক বিষয়ে আইন প্রয়োগ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা, সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়গুলো স্কুলের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা, মিডিয়ায় সচেতনতা কার্যক্রম বাড়ানো, দক্ষ চালক তৈরিতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, মহাসড়ক ও প্রধান সড়ক চার লেনে উন্নীত করা, সড়কের ত্রুটি দূর করা।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন নিসচার মহাসচিব সৈয়দ এহসান-উল হক, উপদেষ্টা ও বিআরটিএর সাবেক চেয়ারম্যান আইয়ুবুর রহমান, যুগ্ম মহাসচিব লিটন এরশাদ প্রমুখ।

Share this post

scroll to top