স্মৃতির মিনারে এক কীর্তিমান মহাপুরুষ আল্লামা গিয়াছ উদ্দিন

শায়খে বালিয়া পীরে কামিল আলহাজ্ব হযরত মাওলানা গিয়াছ উদ্দিন আহমদ পাঠান (রহ্.)’চলে যাওয়ার নয়বছর সন্নিকটে।শায়েখের প্রিয় প্রতিষ্ঠান জামিয়া আরাবিয়া আশরাফুল উলুম বালিয়া মাদরাসার খতমে বোখারী ও দোয়া উপলক্ষে ১০৪ তম বার্ষিক বড় সভা আজ।

শায়খে বালিয়া (রহ.)’র জন্ম ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ১১ মার্চে ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার বালিয়া জাহাঙ্গীরপুর গ্রামের পাঠান বাড়িতে।তার পিতা ছিলেন মরহুম তৈয়্যব উদ্দিন পাঠান ও মাতা মরহুমা হাসান বানু বেগম।

তিনি গ্রামেই প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন।এরপর চলে যান সিলেটে। সেখানে পীরে কামিল হযরত মাওলানা মরহুম নূরুদ্দীন গহরপুরী (রহ্.)এর তত্ত্বাবধানে থেকে শিক্ষাদীক্ষার কাজ শেষ করেন ও উস্তাদের মাদরাসাতেই কর্মজীবন শুরু করেন।সেখান থেকে তাকে জামিয়া আরাবিয়া আশ্রাফুল উলূম বালিয়ায় নিয়ে আসা হয়।এরপর তার বাকি জীবন বালিয়াতেই শেষ হয়।ওয়াজ নসীহতের মাধ্যমে দেশ বিদেশে তিনি ফুলপুরের সম্মান বৃদ্ধি করে গেছেন।তিনি শুধু ফুলপুর নয় বরং বৃহত্তর ময়মনসিংহের একজন কৃতি সন্তান ছিলেন।

তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহ উলামার অভিভাবক ছিলেন। দিনের পর দিন,রাতের পর রাত এমনকি বছরের পর বছর দেশ ও সমাজের মানুষের জীবন মান উন্নয়নের পাশাপাশি পরকালে কিভাবে নাজাত পেতে পারে সে বিষয়ে ফিকির করতেন এই ইসলামিক স্কলার। হাজারো মানুষকে সৎ ও ন্যায়ের পথ দেখিয়ে গেছেন শায়খে বালিয়া (রহ্.)।

ওয়াজ নসীহতের ময়দানে বর্তমানে উলামায়ে কেরামের মাঝে যে বিদ্বেষী মনোভাব লক্ষ্য করা যায় শায়খে বালিয়ার বয়ানে এ ধরনের কোন ছাপ খুঁজে পাওয়া যায় না।যা করলে ইসলামের, নিজের,বাপ-মার ও দেশের মানহানি হয় তা থেকে বিরত থাকতে মানুষকে পরামর্শ দিতেন তিনি।যে কাজ করলে দীনের,নিজের ও দেশের সুনাম বৃদ্ধি পায় সেসব কাজের প্রতি মানুষকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করতেন।

কুরআন- হাদীসভিত্তিক জীবন গঠনের মাধ্যমে আলোকিত মানুষ তৈরি করতে আজীবন তার চেষ্টা অব্যাহত ছিল।তিনি দেশ ও দেশের বাইরে বয়ানের মাধ্যমে ফুলপুরের মর্যাদাবৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করেছেন ভন্ড,প্রতারক,মাদক নারী নির্যাতন,সুদ,ঘুষ ও দুর্নীতিসহ সমাজবিরোধী বর্বর কর্মকান্ডের তিনি ছিলেন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর।তিন ছিলেন
বৃহত্তর ময়মনসিংহ উলামাকে নিয়ে গঠিত ‘ইত্তেফাকুল উলামা’ সংগঠনের মজলিসে শুরার সভাপতি।

দেশের রাজনৈতিক অঙ্গণেও তিনি বিশেষ অবদান রেখে গেছেন। কিভাবে রাজনীতি করলে দেশের মানুষ উপকৃত হওয়ার পাশাপাশি ইসলামও ক্ষতিগ্রস্ত হবে না সে বিষয়ে রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি তার দিক নির্দেশনা রয়েছে।

তিনি বিশেষ করে সারা জীবন কুরআন-হাদীস নিয়ে গবেষণা করেছেন।মহানবী (সা.)’র পথ ও মত অনুসরণের মাধ্যমে সমাজে আদর্শ ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় লড়ে গেছেন।

ইসলাম বিরোধী কর্মকান্ডের প্রতিবাদে কেন্দ্র থেকে মিটিং মিছিলের ডাক আসলে শায়খে বালিয়া সিপাহসালারের ভূমিকা পালন করতেন। তিনি ছাড়া যেন সবাই ছিল অচল। চোখের সামনে আজ সবই আছে,নেই শুধু শায়খে বালিয়া। এতে মনে হয় যেন কেউ নেই।‘মাওতুল আলিমে মাওতুল আলাম’ অর্থাৎ একজন আলিমের মৃত্যু যেন পুরো পৃথিবীর মৃত্যুসম।বাক্যটি বিদগ্ধ ও মুখলিস এই আলিমের ক্ষেত্রে যেন শতভাগ প্রযোজ্য।শায়খে বালিয়ার মধ্যে এক ধরনের অলৌকিক শক্তিশালী চুম্বক ছিল।যা মানুষকে আকর্ষণ করতো,কাছে টানতে পারতো।সদাসর্বদা মানুষ তাকে ঘিরে রাখতো।তিনিও মানুষের উপকারে ঝাপিয়ে পরতেন।

এতদাঞ্চলে এমন কোন মসজিদ মাদরাসা বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে দাওয়াত দিলে শায়খে বালিয়া যেতেন না।তিনি সবার ডাকেই সাড়া দিতেন।বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে তাকে রাখা হতো।দেশের অর্ধ শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মুহতামিম,সদরুল মুহতামিম,শায়খুল হাদীস ও প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।প্রতিষ্ঠানের পরিচিতি বৃদ্ধি,প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষকে আস্থাশীল করতে ও আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ বরকত লাভের আশায় তাকে উচ্চ সম্মানী পদ দিয়ে রাখা হতো।

শায়খে বালিয়ার প্রিয় উস্তাদ ও পীর নূরুদ্দীন গহরপুরী (রহ্.)’র তত্ত্বাবধানে সিলেটে তিনি হাদীস,তাফ্সীর ও ফিকাহ বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন।এসব বিষয়ের উপর গবেষণা শেষ করে ১৯৬০ সনে নিজ পীরের মাদ্রাসা জামিয়া ইসলামিয়া হুসাইনিয়ায় কর্মজীবন শুরু করেন। পরে মুরুব্বীদের আদেশ ও পীরের হুকুমে ১৯৬৮ সনে তিনি মুহাদ্দিস পদে বালিয়া মাদ্রাসায় যোগদান করেন।

১৯৮০ সনের ২৬ আগস্ট তাকে বালিয়া মাদরাসার মুহতামিম নিয়োগ করা হয়।২০০০ সন পর্যন্ত তিনি বালিয়া মাদরাসার মুহতামিম ও শায়খুল হাদীস ছিলেন।জীবনের শেষ দিকে তাকে বালিয়া মাদরাসার সদরুল মুহতামিম পদে অধিষ্ঠিত করা হয়।বালিয়া মাদরাসা ছাড়াও তিনি ময়মনসিংহ,ঢাকা,রাজশাহী ও সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন মাদ্রাসার মুহতামিম,শায়খুল হাদীস ও উপদেষ্টা ছিলেন।

উল্লেখ্য,২০১৩ সনের ২ ফেব্রুয়ারি ভোররাতে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শায়খে বালিয়া হযরত মাওলানা গিয়াছ উদ্দিন আহমদ পাঠান ইন্তিকাল করেন।

ওই বছর ১ ফেব্রুয়ারি জামিয়া আরাবিয়া আশরাফুল উলূম বালিয়ার ৯৪তম বড় সভা ছিল।এবারের বড়সভা ছিল ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি।মৃত্যুর পূর্ব মূহুর্তে অসুস্থতা নিয়েই মধ্যরাতে বয়ান করেছেন শায়েখ।বয়ানের পর তিনিই খতমে বুখারী করেন ও মুনাজাত পরিচালনা করেন।

এরপর জামিয়ার অফিসে কিছুক্ষণ বসে মুহতামিম মাওলানা আইনুদ্দীন ও তৎকালীন নায়েবে মুহতামিম মাওলানা ওয়াইজুদ্দীনকে দিক নির্দেশনামূলক নসীহত করেন।তারপর মাদ্রাসা সংলগ্ন বাসায় যান।বাসায় যাওয়ার পর পরই তার অসুস্থতা বেড়ে যায়।পরে দ্রুত তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে ভোর পৌনে ৫টার সময় চিকিৎসাধীন অবস্থায় কালেমা পড়তে পড়তে শায়খে বালিয়ার ইন্তিকাল হয়।

শায়খে বালিয়া (রহ.) বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল উলামার আধ্যাত্মিক নেতা ও অভিভাবক ছিলেন।জীবনে প্রচুর ছাত্র গঠনের পাশাপাশি আধ্যাত্মিক লাইনে সিলেটের মাওলানা সাদেক আহমাদ লন্ডনী,জামালপুরের মাওলানা জিল্লুর রহমান,ঈশ্বরগঞ্জের মাওলানা ওয়াহিদুজ্জামান আবুল কালাম,নেত্রকোণার মাওলানা সিরাজুল ইসলাম,সিলেটের মাওলানা নিজামুদ্দীন,সুনামগঞ্জের মাওলানা ইসহাক

দুর্গাপুরের মাওলানা রফিকুল ইসলাম,পূর্বধলার মাওলানা মুজিবুর রহমান,কেন্দুয়ার মাওলানা জাহিরুদ্দীন,ফুলপুরের মাওলানা আজীমুদ্দীন শাহ জামালী ও গফরগাঁওয়ের মাওলানা নছরুতুল্লাহ নামে ১১জন মুরীদকে তিনি খেলাফত দান করেন।দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে এমনকি সুদূর লন্ডনেও ওয়াজ নসীহত ও দারসে বুখারীর খেদমত করে গেছেন শায়খে বালিয়া।

ব্যক্তিজীবনে শায়খে বালিয়া (রহ) দুই স্ত্রীর মাধ্যমে ৮ পুত্র ও ১৪ কন্যা সন্তানের জনক ছিলেন।মাওলানা ওলীউল্লাহ ও মাওলানা ফরিদ আহমাদ নামে দুই ছেলে ও জিবুন্নাহার, আসমা,নাজমা,সালমা ও হুসনা নামে ৫ মেয়ে জন্ম নেওয়ার পর তার প্রথম স্ত্রী মারা যান।

এরপর ১৯৭৭ সনে তিনি দ্বিতীয় বিবাহ করেন।ওই ঘর থেকে নূরুল্লাহ হাফিজ্জি,আতাউল্লাহ হযরতজী,ফয়জুল্লাহ মিয়াজী,ইমদাদুল্লাহ মোল্লাজী,রেজাউল্লাহ নূরুজ্জী ও সানাউল্লাহ শাহজী নামে ৬ ছেলে

নাসিমা,বিলকিস,শামীমা,বরকতি,রাহমাতি,তুহফা,জান্নাতি, আতিয়া ও নিয়ামাতি নামে ৯ কন্যা সন্তান জন্ম নেন।তাদের মধ্যে জান্নাতি,আতিয়া ও তুহফা নামে তিনজন মারা গেছেন।ছেলে-মেয়ে ও জামাতারা সবাই ব্যবসা ও শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত।শায়খে বালিয়ার নামে সুলতানের মোড়ে,বাড়িতে ও বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেছে।মৃত্যুর নয় বছর পরেও তিনি স্মৃতির মিনারে এক কীর্তিমান মহাপুরুষ,আল্লাহ পাক উনাকে জান্নাতে আ’লা মাক্বাম দান করুন।আমীন।

Share this post

scroll to top