সংশোধিত মজুরি কাঠামোতেও কেন সন্তুষ্ট নয় শ্রমিকরা?

বাংলাদেশে পোশাক শ্রমিকদের প্রায় সব গ্রেডের মজুরী সংশোধনের ঘোষণা দেয়ার পরও তা মানছেন না পোশাক শ্রমিকেরা। আজ সোমবার আবারো বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভে নেমেছেন তারা। আশুলিয়ায় হাজার হাজার শ্রমিক কাজ ছেড়ে বের হয়ে গেছেন। এরপর সকাল আটটা থেকে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করার চেষ্টা করেন শ্রমিকেরা।

কিছু কারখানার মালিকরা ভাংচুরের আশঙ্কায় নিজেরাই কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন। আশুলিয়ায় কয়েক শ্রমিকের সাথে কথা বলে যা বোঝা গেলো তা হচ্ছে, সংশোধিত মজুরীতে কয়েকশ টাকা বাড়লেও সেটি দেয়া হচ্ছে মূলত খাবার ও যাতায়াত ভাতা হিসেবে আলাদা করে।

কিন্তু শ্রমিকদের দাবি সেটি মূল বেতনের সাথে একসাথে দেয়া হোক।

কেন সন্তুষ্ট নয় শ্রমিকরা?

আশুলিয়ায় ডেবোনেয়ার গ্রুপের শ্রমিকদের একজন বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলছিলেন,‘যে টাকা সরকার বাড়িয়েছে সেটি আমাদের বেসিক বেতনের সাথে অ্যডজাস্ট কইরা দেক। তা না করে তারা এটা আলাদা করে খাবার ও যাতায়াতের সাথে দিচ্ছে। বেসিকের পরিমাণ বাড়লে আমার ওভারটাইমের হার বাড়বে।’

তিনি আরো বলেন,‘মনে করেন আমাদের ওভারটাইমের হার আছে ৪০ টাকা বা ৩০ টাকা। বেসিকের সাথে দিলে ওভারটাইমের হার আসে ঘণ্টায় ৫০ টাকা।’

শ্রমিকেরা নতুন ঘোষিত সমন্বিত কাঠামোতে খুশি নন বলে জানান। তারা বলছেন, ২০ থেকে ২০০-২৫০ টাকায় তাদের জীবনের এমন কোনো পরিবর্তন তারা আনতে পারবেন না।

এই খাতে শ্রমিকের বেশিরভাগই ওভারটাইমের বাড়তি আয়ের উপর নির্ভরশীল। যেসব শ্রমিকের সাথে কথা হচ্ছিলো তারা কেউই নাম পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি।

তাদের একজন বলছেন,‘যা বাড়াইছে এতেও আমাদের কিছু হবে না। কারণ গার্মেন্টসে যখনই বেতন বাড়ানোর কথা সরকার বললো, বলার পরই আমাদের বাসা ভাড়া বাড়াইছে এক টানে ৩০০ টাকা। কাচা তরকারিসহ সব যাবতীয় জিনিসের দাম বাড়াইয়া দিছে। রাত ১০ টা পর্যন্ত ওভারটাইম করেও আমি সব মিলাইয়া মাত্র পাই ১০ হাজার টাকা।’

তিনি আরো বলেন,‘এখন ছেলের পড়াশুনার খরচ দেবো? নাকি ২৮শ টাকা বাসা ভাড়া দেবো? তাহলে আমরা খাবো কি? দেশে পাঠাবো কি?’

আক্ষেপের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল প্রতি বছর সকল প্রাতিষ্ঠানিক পেশার মতই পোশাক খাতে পাঁচ শতাংশ হারে মূলবেতন বা বেসিক বেতন বাড়ার কথা। যা সাধারণত ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে বাড়ানো হয়। সেটি এবার দেয়া হচ্ছে না। সেই অংকটি যোগ হলে সরকার ঘোষিত কাঠামোর সাথে আরও কিছু টাকা যোগ হতো বলে জানালেন শ্রমিক নেতারা।

অন্যদিকে বেসিক বা মূলবেতন বাড়লে ঈদ বোনাস, ছুটি-কালীন টাকা, সার্ভিস বেনিফিটও তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে এমনিতেই বাড়ত। সার্ভিস বেনিফিট হল পাঁচ বছর চাকরি করলে চাকরি ছাড়ার সময় প্রত্যেক শ্রমিককে প্রতি মাসের অর্ধেক বেতন দেয়ার নিয়ম।

এছাড়া নারীদের মাতৃত্বকালীন সময় চার মাসের বেসিক দেয়ার নিয়ম রয়েছে। সেটিও তারা কম পাবে। পোশাক খাতে নারী শ্রমিকের সংখ্যাই সিংহভাগ। পোশাক মালিকেরা খুব সূক্ষ্মভাবে এভাবে শ্রমিকদের বঞ্চিত করার চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ তাদের।

তবে এসব বিষয়ে শ্রমিক নেতারাও আজ সরাসরি কথা সাহস করছেন না।

কী পরিবর্তন হয়েছে বেতন গ্রেডে?

গত বছর সেপ্টেম্বরে পোশাক খাতে শ্রমিকদের জন্য নতুন বেতন কাঠামো ঘোষণা করা হয়েছিল।

সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল ৫১ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধি। কিন্তু দেখা গেছে যে মূলত প্রথম ধাপের শ্রমিক সপ্তম গ্রেডে যারা আছেন তাদের বেতন বেড়েছে ৫৩০০ টাকা থেকে ৮০০০ টাকা।

নতুন কাঠামোতে হেলপার গ্রেড ছাড়া অন্যদের বেতন খুব সামান্য বেড়েছে বলে অভিযোগ করে আসছিলেন শ্রমিকরা।

তৃতীয় গ্রেডের মূল বেতন বরং ৪১ টাকার মতো কমে গিয়েছিলো। সেটিকে ঘিরে ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই আশুলিয়া, সাভার, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার নানা কারখানার শ্রমিকেরা দফায় দফায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন।

এর প্রেক্ষিতে সব পক্ষের একটি পর্যালোচনা কমিটি তৈরি করে সরকার। যে কমিটি কয়েকটি জরুরী বৈঠকের পর মাত্র রোববার সন্ধ্যায় নতুন একটি মজুরী তালিকা প্রকাশ করে। যাতে সেখানে উপস্থিত সকল শ্রমিক নেতারা সাক্ষর করেছেন।

যে গ্রেডটির শ্রমিকদের বেতন নিয়ে সবচাইতে আপত্তি উঠেছিলো সেই তৃতীয় গ্রেডের সর্বমোট বেতন ২০১৩ সালে ছিল ৬৮০৫ টাকা।

২০১৮ সালে ঘোষিত কাঠামোতে ঠিক হয়েছিলো ৯ হাজার ৮৪৫ টাকা। এখন নতুন সমন্বিত কাঠামোতে তার সাথে আড়াইশ টাকার মতো যুক্ত হবে।

দ্বিতীয় গ্রেডে যারা আছেন তাদের ৭৮৬ টাকা সংশোধন হচ্ছে। সবচাইতে সিনিয়র যারা অর্থাৎ প্রথম গ্রেডে সাড়ে সাতশোর টাকার মতো যুক্ত হবে। সাত নম্বর গ্রেড ছাড়া বাকি সবার মোট বেতন কিছুটা সমন্বয় করা হয়েছে।

সর্বনিম্ন গ্রেডে সবমিলিয়ে বেতন হল আট হাজার টাকা। আর সর্বোচ্চ গ্রেডে ১৮ হাজার ২৫৭ টাকা। এখন সর্বশেষ সমন্বিত কাঠামোতেও তাদের খুব একটা লাভ হয়নি বলে মনে করছেন শ্রমিকরা।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top