ময়মনসিংহে ৬০ হাজার মৎস্যচাষির লোকসান ৩৩৫ কোটি টাকা

Fisheryময়মনসিংহে করোনা মহামারির কারণে হ্যাচারিতে রেণু পোনা এবং খামারে মাছের উৎপাদন দিন দিনই হ্রাস পাচ্ছে। গণপরিবহন ও ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক না হওয়ায় চাষিরা হ্যাচারীতে উৎপাদিত রেণু পোনা ও চাষ করা উদ্ধৃত্ত মাছ জেলার বাইরে সরবরাহ করতে পারছে না। বেচাকেনা কমে যাওয়ায় দেড় বছরের ব্যবধানে উৎপাদন কমে অর্ধেকের নিচে নেমে গেছে। উপরন্তু অর্ধেক মূল্যেও বিক্রি করা যাচ্ছে না পোনা মাছ। ফলে জেলার প্রায় ৬০ হাজার মৎস্যচাষির ৩৩৫ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে।

জেলা মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ময়মনসিংহ জেলায় প্রায় এক লাখ ১২ হাজার মাছ চাষি রয়েছেন। হ্যাচারি রয়েছে ৩১৭ টি। প্রতিবছর এক লাখ ৮০ হাজার কেজি পোনা এবং প্রায় চার লাখ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হয়। জেলার ৫৩ লাখ ১৩ হাজার ১৬৩ জনের চাহিদা রয়েছে এক লাখ ২৬ হাজার মেট্রিক টন। ফলে উদ্ধৃত্ত হয় দুই লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন। যা বাইরের জেলায় বিক্রি করতে হয়। করোনার কারণে উদ্ধৃত্ত মাছ বিক্রি না হওয়ায় এখন চাষিদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। সরকারি হিসেবেই ৫৮ হাজার ৪৬৭ জন মৎস্যচাষির আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৩৫ কোটি দুই লাখ ২২ হাজার টাকা। চষিদের নামের এ তালিকা মোবাইল নম্বরসহ মৎস্য অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে। সরকার মৎস্যচাষিদের জন্য প্রণোদনা দিলে ওই তালিকা অনুযায়ী প্রদান করা হবে বলেও সূত্র উল্লেখ করেন।

ত্রিশাল উপজেলার মৎস্যগ্রাম খ্যাত ধলার এশিয়া সায়েন্টিফিক ফিস হ্যাচারী এন্ড নার্সারীর স্বত্তাধিকারী মো. রফিকুল ইসলাম জানান, প্রতিদিনই পুকুরে রেণু পোনা ও মাছের খাবার দিয়ে যাচ্ছেন তাঁর মতো ময়মনসিংহের হাজারো মৎস্যচাষি ও খামারি। কিন্তু রেণু পোনা ও পোনামাছ কোনটাই বিক্রি করতে পারছেন না। পুকুরেই রেণু বড় হয়ে পোনায় পরিণত হচ্ছে। পোনা বড় হয়ে মাছে পুকুর ভরে যাচ্ছে। জেলার বাইরে সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। ক্রেতার অভাবে উৎপাদন কমে অর্ধেকের নিচে নেমে গেছে। ভাই ভাই মৎস্য হ্যাচারী ও নার্সারীর জুয়েল জানান, করোনার আগে তিনি পাঁচ কোটি পোনা উৎপাদন ও বিক্রি করতেন। এবছর দুই কোটির কম পোনা উৎপাদন করেছেন। কিন্তু মৌসুম চলে যাচ্ছে অথচ এখনো অর্ধেক পোনা বিক্রি হয়নি। ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বয়রা গ্রামের মৎস্যচাষি রুবেল মিয়া জানান, করোনার আগে শিং মাগুর ১৬ হাজার থেকে ১৮ হাজার টাকা মণে বেচাকেনা হতো। এখন ৬/৭ হাজার টাকায় ক্রেতা পাওয়া যায় না। করোনাকালীন গত দেড় বছরে লোকসান গুনতে গুনতে তাঁর মতো অনেকেই পুজি হারিয়ে পথে বসার উপক্রম হয়েছে। ধলা গ্রামের ক্ষুদ্র মৎস্যচাষি, ফড়িয়া ও শ্রমিকরা জানায়, দিনের পর দিন গণপরিবহন ও ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক না হওয়ায় রেণু পোনা ও পোনামাছ বিক্রির সাথে জড়িত হাজারো শ্রমিক, ফড়িয়া, ক্ষুদ্র চাষি ও ব্যবসায়ি এখন বেকার হয়ে পড়েছেন। তাদের পরিবারে দেখা দিয়ে অভাব অনটন।

বাংলাদেশ ফিস হ্যাচারি এন্ড ফার্ম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা ও ভাই ভাই মৎস্য হ্যাচারীর স্বত্ত¡াধিকারী এম এ বাতেন জানান, ময়মনসিংহের উৎপাদিত উদ্বৃত্ত মাছ রাজধানীসহ বিভিন্ন নগর ও জেলা শহরে বিক্রি করা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কোচিং সেন্টার ও ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ থাকায় শহরের মানুষ গ্রামে চলে যাওয়ায় রাজধানীসহ শহর, বন্দর ও নগরীতে মাছের চাহিদা কমে গেছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে, মাছের বেচাকেনা কমে যাওয়ায় পোনার চাহিদা কমে গেছে। যে পোনা একটায় বিক্রি হতো এখন পঞ্চাশ পয়সা দরে অর্থাৎ অর্ধেক মূল্যেও বিক্রি হচ্ছে না পোনা। ফলে পোনার উৎপাদনও হৃাস পেয়েছে। ফলে কোটি কোটি টাকার মাছ বেচাকেনা বন্ধ হয়ে গেছে। এই অবস্থায় অনেতে হ্যাচারী বন্ধের উপক্রম হয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি বন্ধ হয়ে গেছে। সরকার কম সুদে অথবা প্রনোদনা আকারে হ্যাচারীগুলোকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে তাহলে হ্যাচারী ও মাছের ব্যবসা আবারো নতুন করে দাঁড় করানো সম্ভব হবে। অন্যথায় হ্যাচারী ও মাছের ব্যবসায় যে ধস নেমেছে তা থেকে উত্তরণের কোনো উপায় নেই বলেও মনে করেন তিনি।

ময়মনসিংহ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা দিলীপ কুমার সাহা জানান, চলমান কোভিড-১৯ এর প্রভাবে জেলায় মাছের উৎপাদনে কোনো ঘাটতি হয়নি। বরং প্রদিবছর চাহিদা পুরণ করে দুই লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন উদ্ধৃত্ত হয়। যা জেলা বাইরে রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হয়। কোনো চাষি যদি বাইরে মাছ সরবরাহের ক্ষেত্রে গণপরিবহন সুবিধা চায় তবে মৎস্য অধিদপ্তর সেই সহযোগিতা প্রদান করবে। যদিও দেড় বছর ধরে করোনার কারণে ময়মনসিংহ জেলার ৫৮ হাজার ৪৬৭ জন মৎস্যচাষির আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩৩৫ কোটি দুই লাখ ২২ হাজার টাকা। এসব চষিদের নামের তালিকা মোবাইল নম্বরসহ মৎস্য অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে। সরকার যদি মৎস্যচাষিদের জন্য প্রণোদনা দেয় তখন ওই তালিকা অনুযায়ী চাষিদের সহায়তা প্রদান করা সম্ভব হবে বলে জানান তিনি। ##

Share this post

scroll to top