ময়মনসিংহে করোনার ভয়াবহ সংক্রমণের ঝুঁকি : মৃত্যু ও শনাক্ত বাড়ছেই

ময়মনসিংহে থামছেই না করোনার ভয়াবহতা। প্রতিদিনই রেকর্ড ভেঙ্গে সর্বোচ্চ সংক্রমণের রেকর্ড গড়ার পাশাপাশি মৃত্যুর সংখ্যাও আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে। শনিবার সন্ধায় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিট সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, হাসপাতালের করোনা ইউনিটে রোগীর চাপ ক্রমাগত বাড়ছে। ঈদ উপলক্ষে নমুনা পরীক্ষার হার কম থাকলেও শনাক্তের হার ছিল উর্ধ্বমুখী।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, জুন মাসের তুলনায় জুলাইয়ে লকডাউন বা বিধিনিষেধ অমান্য করার কারণে এবং ঈদের আগে বিধি নিষেধ তুলে দেয়ায় জন সাধারণের অবাধ চলাচলে ময়মনসিংহে করোনা রোগীর সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। যে কারণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ময়মনসিংহ মেডিকেলের করোনা ইউনিট সম্প্রসারণ করে নতুন আরও দুটি ইউনিটকে সংযুক্ত করে সাধারণ বেড ও আইসিইউ বেডের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবে বৃদ্ধি করা বেডগুলো করোনার রোগীতে পরিপূর্ণ হয়ে ফ্লোরেও ভর্তি আছেন অসংখ্য রোগী। এ পর্যন্ত ময়মনসিংহ জেলায় মোট ১২৩০১ জনসহ বিভাগে ২১৯৯৩ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে ও ময়মনসিংহ বিভাগে মারা গেছেন ৩২৭ জন। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটি ময়মনসিংহ বিভাগের একমাত্র অত্যাধুনিক সুবিধা সম্বলিত হাসপাতাল হওয়ায় বিভাগের বাইরে থেকেও রোগী ভর্তি হচ্ছে প্রতিদিন।

মমেক সূত্রে জানা যায়, নতুন ভবনের ৫ম থেকে ৮ম তলায় করোনা ডেডিকেটেড ইউনিট চালুর সময় ২২০টি সাধারণ বেড ও ১০টি আইসিইউ ছিল। দিনের পর দিন রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় পাঁচ ধাপে ৪০০ বেড বাড়ানো হয়। নতুন ভবনের ৬টি ফ্লোরই করোনা ও উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হওয়া রোগীদের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হচ্ছে। রোগীর চাপ অনুভব করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে পুরাতন ভবনের জরুরিসেবা বিভাগের দু’তলায় অর্থোপেডিকস ওয়ার্ডকে করোনা ইউনিট হিসেবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হাসপাতালটিতে ডিজিটাল পদ্ধতিতে কোভিড টেস্টের রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া চালু করার কথাও ভাবছে কর্তৃপক্ষ।

করোনা ইউনিট ঘুরে দেখা যায়, নির্দিষ্ট বেডের তুলনায় অনেক বেশি রোগী ভর্তি। অনেক রোগী ফ্লোরে সেবা নিচ্ছে। কিডনি ডায়ালাইসিস রোগীদের জন্য দুটি আইসিইউ ছিল, সেগুলোও এখন করোনা রোগীদের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। সাধারণ শয্যা প্রতিদিন বাড়ানো গেলেও আইসিইউ সেবা পরিচালনা করতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসকের অভাব ও যন্ত্রপাতি না থাকায় আইসিইউ শয্যা বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না।

হাসপাতাল সূত্র নিশ্চিত করেছে, আইসিইউ সমমানের আরও ২৪টি ব্যাড নতুন বিল্ডিংয়ের ৫ম তলায় রয়েছে। সেখানে রোগীদের হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা দিয়ে সেবা দেয়া হচ্ছে। বাড়তি রোগীর চাপ সামলানোর জন্য ট্রায়াজ সিস্টেম এবং ফ্লু কর্ণারকে আরও বেশী সক্রিয় করা হয়েছে।

করোনা গাইডলাইন অনুসারে একজন চিকিৎসক ১৫ দিন একটানা কাজ করার পর তিনি ১৫ দিন সঙ্গনিরোধের আওতায় থাকেন। অনেক চিকিৎসক করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন। ফলে চিকিৎসক সংকট বেড়ে চলেছে। সম্প্রতি বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের সহযোগিতায় কলেজ ও বিভিন্ন উপজেলা থেকে এবং হাসপাতালের অন্যান্য ওয়ার্ড থেকে ২১ জন এনে মোট ৪০ জন চিকিৎসক দিয়ে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। সঙ্গনিরোধ মেনে ১৫০ জন সেবিকা কাজ করছেন তিন পালায়। পরিচ্ছন্নকর্মীর রয়েছে তীব্র সঙ্কট, মাত্র ২৫ জন পরীচ্ছন্ন কর্মী দিয়ে চলেছে ৪২৬ রোগীর পুরো ইউনিট ।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিট সূত্রে জানা যায়, হাসপাতালে ১০ হাজার লিটারের একটি সিলিন্ডারের মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহের সক্ষমতা রয়েছে। এছাড়া সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদের ব্যক্তিগতভাবে দেয়া ৫০টি অক্সিজেন সিলিন্ডারসহ ৭০০টি সাধারণ সিলিন্ডার রয়েছে। করোনা ইউনিটে ২৯টি হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, ২০টি ভেন্টিলেটর, ১৩টি অক্সিজেন কন্সেন্ট্রেটর রয়েছে। এখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত ঔষধ সরবরাহ অব্যাহত রয়েছে।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটের সমন্বয়কারী ডা. মহীউদ্দিন খান বলেন, করোনা ইউনিটে রোগীদের চাপ বাড়ছে। এ কারণে নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। আইসিইউ সিট বাড়ানোর জন্য যে দক্ষ জনবল প্রয়োজন, তার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চাহিদা পাঠানো হয়েছে। শীঘ্রই দক্ষ জনবল পাওয়া গেলে আইসিইউ এর চাহিদা পূরণ করা যাবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা রোগীদের জন্য সবচেয়ে জরুরি অক্সিজেন সাপোর্ট। তাই হাসপাতালে প্রথমেই দরকার হয় অক্সিজেন। হাসপাতালের প্রতিটি শয্যার সঙ্গে অক্সিজেন সরবরাহ থাকলে অনেক জটিল রোগীদের আইসিইউতে নিতে হয় না। তবে অক্সিজেনের সরবরাহ না থাকলে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হয় না। অক্সিজেন সাপ্লাই ঠিক থাকলে ভেন্টিলেটর পর্যন্ত যাওয়ারই দরকার হয় না। তাই করোনা হাসপাতালে শুরুতেই অক্সিজেন সার্পোট দরকার। এছাড়া প্রত্যেকটি করোনা হাসপাতালেই সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্লান্ট থাকা জরুরি। পর্যাপ্ত অক্সিজেন সিলিন্ডার থাকা দরকার। যেগুলো আছে তা পর্যাপ্ত নয়।

তবে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ময়মনসিংহ শাখার সভাপতি মতিউর রহমান বলেন, অক্সিজেন সংকট মোকাবিলায় পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে হাসপাতালে খুব দ্রুত আরও একটি সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিলিন্ডার স্থাপনের কাজ শুরু করা দরকার। করোনা সংক্রমণ রোধ ও আক্রান্তের হার কমানো না গেলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে।

Share this post

scroll to top