ময়মনসিংহে আলো-বাতাস বিহীন বাড়িতেই মারা গেলেন স্নেহাশীষ চৌধুরী

snehashis-chowdhury স্নেহাশীষ চৌধুরীবাড়ির বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার দুইদিন আগে সাংস্কৃতিককর্মী পলাশ চৌধুরী প্রশাসনের কাছে মানবিক আকুতি জানিয়ে ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘ঘরে পানি নেই, আলো-বাতাস নেই; পরপর দু’বার স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী আমার বৃদ্ধ বাবার জীবন সংকটাপন্ন!’

তার এমন করুণ আর্তিতেও কাজ হয়নি। কয়েকদিন অন্ধকারে থেকে, শেষ পর্যন্ত সেই আলো-বাতাস বিহীন বাড়িতেই চিরকালের মতো হারিয়ে গেছেন পলাশ চৌধুরীর বাবা ও ময়মনসিংহের সংস্কৃতি অঙ্গনের প্রাণ পুরুষ স্নেহাশীষ চৌধুরী। ৮১ বছর বয়সে শনিবার সকালে পরলোকগমন করেন তিনি।

সকালে যখন তার বাবা মারা যান, তার কয়েকঘণ্টা আগে শুক্রবার রাতে ফেসবুকে আরেকটি পোস্ট দিয়ে এই অন্ধকারের কথা আবারও স্মরণ করিয়ে পলাশ চৌধুরী লিখেছিলেন, ‘‘এখনো অন্ধকার! ৯, মহারাজা রোড ময়মনসিংহ।’’

সারাদেশে যখন করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, মানুষ ব্যস্ত সেই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে; ঠিক এমনই একটি সময়ে ময়মনসিংহ শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত সংস্কৃতিজন স্নেহাশীষ চৌধুরীর পৈত্রিকভিটার দখল নিতে এক ভূমিদস্যু ষড়যন্ত্র করে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। জমি নিয়ে হাইকোর্টে রিট মামলার পাশাপাশি ১৪৪ ধারা জারি থাকার পরও বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নের ঘটনা ঘটে।

সেই ঘটনার পর থেকে প্রশাসনসহ বিভিন্ন মহলে জানিয়েও বিদ্যুত সংযোগ ফিরে পায়নি স্নেহাশীষ চৌধুরীর পরিবার। ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ইকরামুল হক টিটুকেও বিষয়টি জানান পলাশ চৌধুরী।

শুক্রবারও মেয়রের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফেসবুকে পলাশ চৌধুরী লিখেছেন, ‘আপনারা দীর্ঘদিন আমাদের পরিবারকে চেনেন-জানেন তাই এই অনুরোধপত্র: আমার বাবা গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ময়মনসিংহের বাসায় শয্যাশায়ী! তাঁর অসুস্থতা বিবেচনা করে, সম্পূর্ণ মানবিক কারণে বাসায় জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ/ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আপনাদের সবিনয় অনুরোধ জানাই। আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো।’

জীবদ্দশায় ন্যায়বিচার চেয়ে অসংখ্য মানুষের কাছে  গিয়েও নিজের পৈত্রিকভিটার সমস্যা সমাধান করতে পারেননি স্নেহাশীষ চৌধুরী।

তাই তিনি আফসোস করে বারবার বলতেন, ‘‘বাড়িটা রক্ষা করা গেলো না! রক্ষা করা গেলো না আমাদের স্থায়ী ঠিকানা ময়মনসিংহ জেলা শহরের ৯ নং মহারাজা রোডের বাড়িটি; গত ৫০ বছরের স্থায়ী ঠিকানা। আপনাদের কাছে একটা প্রশ্ন: ‘স্থায়ী ঠিকানা’ না থাকলে কষ্ট হওয়ার কী আছে? কত মানুষের তো মাথা গোঁজার ছাদটুকুও নেই, কত শত মানুষ ভূমিহীন!’’

ঐতিহাসিক একটি বাড়ি
এই বাড়ির অংখ্য স্মৃতিচারণ করে এক সাক্ষাতকারে এই সংস্কৃতজন বলেছিলেন, ‘‘স্বাধীনতার পর এই বাড়িতে এসেছেন জাতীয় চারনেতা, বাজার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে; বঙ্গবন্ধু হত্যার পরপরই আওয়ামী লীগ করার দায়ে এই বাড়ি থেকেই গভীর রাতে আমাকে গ্রেফতার করা হয়, কারাবরণ করি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে! তো তাতে কি?

এই বাসাতেই আড্ডায় এসেছেন দেশবরেণ্য বহ জ্ঞাণী-গুণী মানুষ; পাঠচক্র, খেলাঘর, রবীন্দ্র-নজরুল চর্চা, সাংস্কৃতিক আন্দোলন-সংগঠন, নির্মূল কমিটি গঠন, লোকসাহিত্য-ছড়া সংসদ, আবৃত্তি সংগঠন কতো কি হলো এই বাড়িতে! এ বাড়িতেই প্রতিষ্ঠা হয়, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও শেখ ফজলুল হক মনির প্রিয় লোক সংস্কৃতি সংগঠন ‘ মন পবনের নাও’; তো তাতে কি? ১৯৭৪ সালে পল্টন ময়দানে আওয়ামী যুব কংগ্রেসে পরিবেশিত হয় ‘মহুয়া’ লোকনৃত্য নাট্য!’’

এক মুক্তিযোদ্ধার মায়ের বাড়ি
‘‘এটি এক মুক্তিযোদ্ধার মায়ের বাড়ি, তো তাতেই বা কি? টাকার জোরে তাও কেনা যায়! ক্ষমতার খুব কাছাকাছিই নাকি এই ভূমিদখলদারদের চলাচল; সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার দোহাই দিয়ে বলছে, তারাও নাকি এর পেছনে আছে! কী অদ্ভুত কথা! টাকা, পেশীশক্তি আর রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কি সব কিনে ফেলা যায় এদেশে? কেউ কিছু বলছে না, সবাই কি শরম পাচ্ছেন? নাকি ‘উপভোগ্য’ মনে হচ্ছে ?

সবাই দেখছে যে, আমরা শত বছরের পুরোনো বাড়িটা ছেড়ে বেরিয়ে আসছি! আমার প্রায় ৮০ বছরের জীবনে এমন অপমান শরীররটা আর নিতে পারছে না; অসুস্থ শরীরেও পরিবারের নিকটজনদের নিয়ে নামছি রাস্তায়; গন্তব্য অজানা! সবাই চুপ! সবার মুখ কি বন্ধ করে রাখা হয়েছে? এও সম্ভব?’’

অনুসারীদের শোক-শ্রদ্ধা
স্নেহাশীষ চৌধুরীর মৃত্যুর পর দীর্ঘবছরেও তার সম্পত্তি দখলমুক্ত না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন অনেকে।

স্বপন পাল লিখেছেন ‘‘গভীর শোক ও সমবেদনা। উনার স্মৃতির প্রতি অতল শ্রদ্ধা। ময়মনসিংহের ইতিহাসের অংশ উনি। কিন্তু শেষ সময়টা উনার জন্যে ছিল খুবই কষ্টকর। বিশেষ করে মানসিকভাবে যে যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে উনি গেছেন, তা খুবই বেদনার।’’

শামীমা দোলা লিখেছেন, ‘‘আহাহা!! কিছুই করতে পারলাম না!!!’’

ইয়াজদানী কোরাইশি লিখেছেন, ‘’তাঁর বিদায়ের মধ্যদিয়ে ময়মনসিংহের একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি হলো-এ ই কথাগুলো শ্রদ্ধেয় স্নেহাশীষ চৌধুরীর সঙ্গে আক্ষরিক অর্থেই যায়। খুব কষ্ট নিয়ে উনি জীবনের শেষ সময়গুলো পার করেছেন। শ্রদ্ধা জানাই প্রিয়জনকে।’’

Share this post

scroll to top