ময়মনসিংহে অনেকেই জানেন না এসপি কবির উদ্দিনের আত্মদানের কথা

পুলিশ সুপার মুন্সি কবির উদ্দিন আহমেদ ১ জানুয়ারি ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দ তারিখে সিরাজগঞ্জে জন্ম গ্রহন করেন। তিনি টাংগাইলের করটিয়া সাদত কলেজ থেকে  এইচএসসি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। তিনি ১৯৪৩ সালে বেঙ্গল পুলিশ সার্ভিসে সরাসরি সাব-ইন্সপেক্টর পদে নিযুক্তি পেয়ে কলকাতায় কাজে যোগদান করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৪৭ সালে ভারত-ভাগের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন পদে চাকরি শেষে ১৯৭১ সালের প্রথম থেকে কুমিল্লা জেলার এসপি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পেশাগত জীবনে সাহসিকতাপূর্ন কর্মকান্ডের জন্য তিনি ১৯৬৭ সালে রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক  লাভ করেন।

কুমিল্লা জেলার পুলিশ সুপার মুন্সি কবির উদ্দিন আহমেদ ১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের শুরু থেকেই আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষনা করেন। এ সময় কুমিল্লা জেলা প্রশাসক ছিলেন মোঃ শামছুল হক খান। ডিসি এবং এসপি দুজনেই সর্বতোভাবে আন্দোলনের সাথে একাত্ম ছিলেন। কুমিল্লার সামরিক কর্তৃপক্ষ জেলা প্র্রশাসক, সুপারসহ আর আই সিরাজুল ইসলামকে ২২ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাসে অবস্থানকারী তৎকালীন ব্রিগেড কমান্ডার ইকবাল সফির নিকট কুমিল্লা জেলা পুলিশের  অস্ত্র ভান্ডারের চাবি তুলে দিতে নির্দেশ দেয়। পুলিশ সুপার শহিদ মুন্সি কবির উদ্দিন আহমেদ সরকারি চাকুরি হারানোসহ নিশ্চিত মৃত্যুর আশংকা সত্ত্বেও সামরিক কর্তৃপক্ষের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে পুলিশ লাইন্স অস্ত্র ভান্ডারের চাবি জমা দিতে অস্বীকৃতি জানান এবং সকল অস্ত্র পুলিশ সদস্যদের মাঝে বিতরণ করার নির্দেশ দেন। পুলিশ লাইন্সের সদস্যরা গোপনে জেলার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে তাদের যোগাযোগ স্থাপন করেন।এই সময় কুমিল্লা সার্কিট  হাউজে অসহযোগ আন্দোলনের কন্ট্রোল রুম স্থাপিত হয়।

২৫ মার্চ বিকেল থেকে পাকবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণের সংবাদ সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য ২৫ মার্চ সন্ধ্যা থেকে কুমিল্লা পুলিশ লাইন্সের সকল সদস্য  সন্ধ্যার আগেই রাতের আহার পর্ব শেষ করে পুলিশ লাইন্সের চারদিকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান গ্রহন করে। পুলিশ লাইন্সের প্রবেশের মুখে রাস্তার দুপাশে পরিখা খুঁড়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা হয়। পুলিশ সুপারের নির্দেশে আর আই সিরাজুল ইসলাম এই সময় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।এই সময় কুমিল্লা পুলিশ লাইন্সে প্রায় ৩০০ পুলিশ সদস্যের অবস্থান ছিল।

২৫ মার্চ রাত ১২ টার পর পুলিশ কন্ট্রোল রুমে পাকবাহিনী কর্তৃক রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং পিলখানা ইপিআর সদর দপ্তর হতে আক্রমনের সংবাদ আসে। সারাদিনের প্রাপ্ত সংবাদের সাথে এই আক্রমনের খবরটি পুলিশ লাইন্সে অবস্থানরত সদস্যদের আরো বেশি সংঘবদ্ধ করে তোলে।

রাত ০১.৩০ মিনিটের কিছু আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া বহর আলো নিভিয়ে অতি সন্তর্পনে পুলিশ লাইন্সের অতি সন্নিকটে অবস্থান গ্রহন করে। এই সময় সমস্ত পুলিশ লাইন্স অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। ০১.৩০ মিনিট বাজার সাথে সাথে পাকিস্তানি সৈন্যরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র আর মর্টার থেকে পুলিশ লাইন্সের উপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। বাঙালি পুলিশ সদস্যরা পাল্টা আক্রমনের প্রস্তুতি নেয়। পুলিশ সদস্যদের কাছে ক্ষুদ্র অস্ত্র থাকলেও দৃঢ় মনোবল নিয়ে যুদ্ধ শুরু করে। চারদিকে অন্ধকার থাকায় সেনাবাহিনী আকাশে ট্রেসার বুলেট ছুঁড়ে এলাকা আলোকিত করে পুলিশ সদস্যদের অবস্থান খুঁজে পেতে চেষ্টা চালায়। একটানা ভোর ৬টা পর্যন্ত প্রচন্ড যুদ্ধ চলে।এই সময় সেনাবাহিনী চারদিক দিয়ে পুলিশ লাইন্স ঘিরে ফেলে। সারারাত যুদ্ধের পরেও পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রাথমিক অবস্থায় পুলিশ লাইন্সে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়। এই যুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর অনেক সদস্য হতাহত হওয়ায় অবস্থান ধরে রাখা কষ্টকর হয়ে পড়ে। এমন অবস্থায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেশ কিছু পুলিশ সদস্য পার্শ্ববর্তী ধানক্ষেতের মধ্যদিয়ে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়। অনেকে অবস্থান ত্যাগ করতে ব্যর্থ হয়ে লাইন্সের অভ্যন্তরে নিজেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করে। ভোর সাড়ে ৬টার দিকে পাকসেনারা পুলিশ লাইন্সে প্রবেশ করে। পাকবাহিনী আহত ও বন্দি অবস্থায় বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে সেনানিবাসে নিয়ে যায়।

২৬ মার্চ ১৯৭১ সকাল ৭টায় সেনাবাহিনীর একটি জিপ পুলিশ সুপার মুন্সি কবির উদ্দিনকে তার বাসা থেকে বন্দি করে সেনানিবাসে নিয়ে যায়। একই সাথে জেলা প্রশাসক মো. শামসুল হককেও বন্দি অবস্থায় সেনানিবাসে নেয়া হয়। ৩০ মার্চ বন্দি অবস্থায় জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ সুপারকে সেনানিবাসে নৃশংস, পৈশাচিক ও নির্মমভাবে হত্যা করে। এরপর তার লাশ পাওয়া যায়নি।

দেশ মাতৃকার দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে পুলিশ সুপার মুন্সি কবির উদ্দিন নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে মৃত্যুকে হাসিমুখে আলিঙ্গন করে দেশবাসীকে চিরঋণী করে গেছেন। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে তাঁর এই বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১৪ সালের ২৬ মার্চ তাঁকে মরণোত্তর স্বধীনতা পদক প্রদান করা হয়।

 ১৯৭২ সালের পর থেকে ময়মনসিংহ শহরে শহীদ এসপি কবীর উদ্দিন আহমেদের পরিবারের বসবাস। কিন্তু এ পরিবারটির গৌরবগাথা ময়মনসিংহ শহরবাসীর কাছে অনেকটাই অজানা। প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি কিংবা রাজনীতিবিদ কেউ-ই এ পরিবারের তেমন কোনো খবর রাখেন না। নিরিবিলি ও নিভৃতে শহীদ এ পরিবারটি ময়মনসিংহ শহরে বাস করে চলেছে দীর্ঘ সময় ধরে।

বর্তমানে ময়মনসিংহ শহরের সড়কের শ্যাামচরণ রায় রোডে এখন নিরিবিলি বসবাস করেন মাকসুদা কবীর। তাঁর বর্তমান বয়স ৮৬ এর কাছাকাছি। ১ মেয়ে আর ৫ ছেলের মাঝে দুই ছেলে তার সঙ্গে ময়মনসিংহের  এ বাসাতেই থাকেন। অন্যা সন্তানরা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। এসপি কবির উদ্দিনের বড় ছেলে কামাল উদ্দিন আহমদ বলেন, তেমন কেউ তাদের খোঁজ নেয় না। শহরের অনেকে তাদের সর্ম্পকে সেভাবে জানেও না।

Share this post

scroll to top