ময়মনসিংহের দুর্ঘটনা: অতিরিক্ত বোঝাই ট্রাকটি বঙ্গবন্ধু সেতু পার হলো কীভাবে?

ময়মনসিংহের ত্রিশালে আলোচিত সড়ক দুর্ঘটনায় জড়িত ট্রাকটির ওজন ছিল মালামালসহ সাড়ে ১৩ টনের বেশি। অথচ স্বাভাকিভাবে ট্রাকটির সর্বোচ্চ ওজন হওয়ার কথা ৭ টন। বাড়তি ওজনের এই মালামাল নিয়ে ট্রাকটি সেতুর ওজন স্কেল কীভাবে পার হয়েছে, সেই প্রশ্ন তুলেছেন র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ানের (র‌্যাব) গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) দুপুরে কারওয়ান বাজার মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি পাল্টা এই প্রশ্ন রাখেন। একইসঙ্গে বলেন, নিয়ম বহির্ভূতভাবে এরকম ট্রাকের অবাধ চলাচলের জন্য সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষেরেই দায় রয়েছে।

এদিন ওই দুর্ঘটনায় জড়িত ট্রাকটির চালক মো. রাজু আহমেদ শিপনকে (৪২) গ্রেফতারের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরতেই আয়োজন করা হয় সংবাদ সম্মেলনটি। এসময় জানানো হয়, ত্রিশালে খান ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সামনে মহাসড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি পরিবারের তিন সদস্যকে চাপা দেওয়া সেই ট্রাকচালক রাজু আহমেদ শিপনকে সাভার থেকে গ্রেফতার করা হয়। ওই দুর্ঘটনায় পরিবারের তিন সদস্যই প্রাণ হারান। তবে দুর্ঘটনার সময়ই প্রাণ হারানো তিন জনের মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা নারী সন্তান প্রসব করেন। নবজাতকটি বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

দেশে সংঘটিত সাম্প্রতিক সড়ক দুর্ঘটনাগুলোতে জড়িত সংশ্লিষ্টদের গ্রেফতারের তথ্যে দেখা গেছে, গাড়িগুলো ছিল ফিটনেসবিহীন কিংবা চালকের লাইসেন্স ছিল না। এ বিষয়গুলোর জন্য কারা দায়ী— এমন প্রশ্ন রাখা হয় র‌্যাব কমান্ডার আল মঈনের কাছে। জবাবে তিনি বলেন, রাজু (ময়মনসিংহের দুর্ঘটনায় ট্রাকচালক) আগের দিন রাজশাহী থেকে যখন মালামাল নিয়ে রওনা হয়ে বঙ্গবন্ধু সেতু পার হন, তখন কেন ওজন স্কেলে ধরা হলো না? ট্রাকে লেখা ছিল সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা ৭ টন। কিন্তু ১৩ টনেরও বেশি মালামাল নিয়ে ট্রাকটি সেতু পার হয়েছে। সেটি কীভাবে সম্ভব হলো? নিশ্চয় সেখানকার সংশ্লিষ্টদের গাফিলতি রয়েছে। এ বিষয়গুলো দেখা দরকার।

খন্দকার আল মঈন বলেন, দুর্ঘটনা কবলিত ট্রাকটির ফিটনেস নেই ২০১৬ সালের পর থেকেই। লাইসেন্স নবায়ন করা হয়নি। ট্যাক্স টোকেন ছিল ফেল। এরপরও ওই ট্রাক রাস্তায় চলে কীভাবে? অন্যদিকে চালকেরও ২০১৬ সালের পর থেকে ভারী যানবাহন চালানোর জন্য কোনো লাইসেন্স ছিল না। ২০১৬ সালের আগে যে লাইসেন্স ছিল, তা কেবল হালকা যানবাহন চালানোর জন্য। সড়কে এসব বিষয় যারা দেখভাল করেন, তারা কী করলেন? এত বছর চালক লাইসেন্স ছাড়া ও একটি ফিটনেসবিহীন ট্রাক সড়কে চলল কীভাবে— আপনাদের (সাংবাদিক) কাছেই প্রশ্ন রেখে গেলাম।

র‌্যাব পরিচালক অবশ্য নিজেদের দায়ও অস্বীকার করেননি। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হিসেবে আমাদেরও (র‌্যাব) দায় রয়েছে। আমরাও সময়মতো এসবের বিরুদ্ধে অনেক বেশি অভিযান চালাতে পারছি না। আমাদের আরও বেশি অভিযান চালানো দরকার। আবার আমরা অভিযানে নামলে দেখা যায় সড়কে গাড়ি থাকছে না। একেবারে কমে যায়। তখন যারা উপকারভোগী, তারাই ভুক্তভোগী হয়ে পড়েন। যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালনকারী বিআরটিএ’র এসব বিষয়ে আরও বেশি সক্রিয় হওয়া উচিত বলেও এসময় মন্তব্য করেন র‌্যাব কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, গ্রেফতারের পর ট্রাকচালক রাজু আহমেদ শিপন র‌্যাবকে বলেছেন, ট্রাকের অতিরিক্ত মালামালের ওজন, গতিসীমা বেশি থাকা, পেছন থেকে ওভারটেক করার জন্য বাসের হর্ন দেওয়া এবং ব্রেক চেপে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার কারণেই মহাসড়কে দাঁড়িয়ে থাকা ওই পরিবারটির ওপর তিনি ট্রাক তুলে দেন। ফলে দুর্ঘটনাস্থলেই ওই পরিবারের তিন জন (স্বামী-স্ত্রী ও মেয়ে) মারা যান। অন্তঃসত্ত্বা মায়ের পেট ফেটে বেরিয়ে আসে নবজাতক কন্যাশিশু।

জিজ্ঞাসাবাদে ওই চালক র‌্যাবকে আরও বলেন, দুর্ঘটনার আগে তিন দিন নির্ঘুম ছিলেন তিনি। কোনো বিশ্রাম না নিয়েই তিনি একটানা ট্রাক চালাচ্ছিলেন। ৩৪ হাজার টাকা ভাড়ায় তিনি রাজশাহী থেকে আম, পেঁয়াজ ও আলু নিয়ে কিশোরগঞ্জের তাড়াইলে যাচ্ছিলেন। এই টাকা থেকে ১০ শতাংশ অর্থাৎ তিন হাজার ৪০০ টাকা ভাড়া পেতেন তিনি। অতিরিক্ত টাকা কামাতেই বাঁ পায়ের সমস্যা নিয়েই নির্ঘুম ট্রাক চালিয়ে যাচ্ছিলেন চালক রাজু।

র‌্যাব জানিয়েছে, এ ঘটনায় বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে হত্যার দায়ে ত্রিশাল থানায় ট্রাকচালকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। সেই মামলায় রাজুকে গ্রেফতার দেখিয়ে ত্রিশাল থানায় হস্তান্তর করা হবে। দুর্ঘটনায় আরও কেউ জড়িত বলে তদন্তে উঠে এলে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।

Share this post

scroll to top