চতুর্থ প্রজন্মের ‘সুবর্ণ রুই’ উদ্ভাবন করেছে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট

Suborna Ruiমহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এবার জেনেটিক গবেষনায় অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই)। ২০২০ সালে ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ এক যুগ গবেষনার মাধ্যমে রুই মাছের চতুর্থ প্রজন্মের নতুন জাত উদ্ভাবন করেছে। রুই মাছের নতুন ওই জাতটি দ্রুত বর্ধনশীল, স্থানীয় জাতের চেয়ে ২০.১২% অধিক উৎপাদনশীল, খেতে সুস্বাদু এবং দেখতে লালচে ও আকর্ষণীয়। উন্নত জাতের নতুন উদ্ভাবিত রুই মাছ মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণ করা হলে দেশে প্রায় আট টন মাছ অধিক উৎপাদন হবে। রুই মাছের চতুর্থ প্রজন্মের এ জাতটি ‘সুবর্ণ রুই’ হিসেবে নামকরণ করছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই)। মৎস্য খাতের সাথে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীকে স্মরণীয় করে রাখার লক্ষ্যে আজ বৃহস্পতিবার (১০ জুন) সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘সুবর্ণ রুই’ মাছের নতুন জাত ঘোষণা ও অবমুক্ত করা হবে। অনুষ্ঠানে মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম ও সচিব রওনক মাহমুদ ভার্চ্যূয়ালী উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ এমন সুখবর দিয়ে জানান, স্বাদুপানির অন্যতম প্রধান মৎস্য প্রজাতি হচ্ছে রুই। বাংলাদেশে চাষযোগ্য মাছের মধ্যে রুই সবচেয়ে বাণিজ্যিক গুরুত্ব সম্পন্ন মাছ। বর্তমানে মৎস্য চাষ প্রায় সম্পূর্ণভাবে হ্যাচারী উৎপাদিত পোনার উপর নির্ভরশীল। দুভার্গ্যজনক হলেও সত্য যে, হ্যাচারীতে উৎপাদিত রুই মাছের পোনার কৌলিতাত্ত্বিক অবস্থায় (genetic deterioration) ও অন্ত:প্রজননজনিত সমস্যা (inbreeding depression) মৎস্য চাষ উন্নয়নে অন্যতম অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সমস্যা হতে উত্তরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনিস্টিটিউটে কৌলিতাত্তি¡ক গবেষণার মাধ্যমে রুই মাছের নতুন উন্নত জাত উন্নয়নে গবেষণা পরিচালনা করে। এক্ষেত্রে যমুনা, ব্রহ্মপুত্র ও হালদা নদীর প্রাকৃতিক উৎসের রুই মাছ সংগ্রহ করে ধারাবাহিক গবেষণায় ২০২০ সালে রুই মাছের চতুর্থ প্রজন্ম উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়। নতুন জাতের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট হলো- স্থানীয় জাতের তুলনায় চতুর্থ প্রজন্মের ‘সুবর্ণ রুই’ ২০.১২% অধিক উৎপাদনশীল। এ মাছের গায়ের রঙ লালচে হওয়ায় দেখতে খুবই আকর্ষণীয় এবং অন্ত:প্রজনন সমস্যামুক্ত। জাত উন্নয়নের কৌশল প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি জানান, ভিন্ন ভিন্ন নদী যেমন – হালদা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদের উৎস থেকে সংগৃহীত স্থানীয় জাতের রুই মাছের মধ্যে দ্বৈত এ্যালিল ক্রসিং (di-allele crossing) এর মাধ্যমে ৯ টি গ্রæপ থেকে প্রথমে বেইজ পপুলেশন (base population) তৈরী করা হয়। অত:পর বেইজ পপুলেশন থেকে সিলেকটিভ ব্রিডিং (mass selection) এর মাধ্যমে ২০০৯ সালে রুই মাছের উন্নত জাতের প্রথম প্রজন্মের (F1) মাছ উদ্ভাবন করা হয়েছে – যা বেইজ পপুলেশন থেকে ৭.৫% অধিক উৎপাদনশীল। পরবর্তীতে সিলেকটিভ ব্রিডিং (family selection) এর মাধ্যমে রুই মাছের দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের যথাক্রমে ১২.৩৮% ও ১৬.৮৩% অধিক উৎপাদনশীলজাত উদ্ভাবন করা হয়। অত:পর ২০২০ সালে উন্নত জাতের চতুর্থ প্রজন্মের নতুন রুই মাছের জাত তৈরী করা সম্ভব হয়েছে – যা স্থানীয় জাতের চেয়ে ২০.১২% অধিক উৎপাদনশীল। গবেষনাকালে ডিএনএ (Polymorphic DNA) মার্কার ব্যবহার করে চতুর্থ প্রজন্মের জাতের তূলনামুলক বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, নতুন এই জাতের কৌলিতাত্বিক ভিন্নতা (genetic variation) রয়েছে অর্থাৎ Polymorphic লোকাস এবং জিন ডাইভার্সিটি স্থানীয় জাত অপেক্ষা অধিক। এতে প্রমাণিত হয় যে, চতুর্থ প্রজন্মের জাতের কৌলিতাত্তি¡ক অবদান (genetic contribution) স্থানীয় জাত অপেক্ষা অধিক যা প্রজাতির বিশুদ্ধতা (genetic purity) বজায় রাখার পাশাপাশি মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। চতুর্থ প্রজন্মের সুবর্ণ রুই, নদীর উৎস থেকে প্রাপ্ত রুই এবং হ্যাচারীতে উৎপাদিত পোনা থেকে রুই মাছের কৌলিতাত্তি¡ক ভিন্নতা রয়েছে যথাক্রমে লোকাস ৭১.৪৩%, ৬৬.৬৭% ও ৫৭.১৪%।

বিএফআরআই মহাপরিচালক জানান, অধিক উৎপাদনশীল ও অন্ত:প্রজনন সমস্যামুক্ত উন্নতজাতের চতুর্থ প্রজন্মের ‘সুবর্ণ রুই’ মাছ স্বাদুপানি ও আধা-লবণাক্ত পানির পুকুর, বিল, বাওড় এবং হাওরে চাষ করা যাবে। এতে সামগ্রিকভাবে দেশে প্রায় ৮০ হাজার কেজি মাছ অধিক উৎপাদিত হবে – যার বর্তমান বাজার মূল্য দুই কোটি ৪০ লাখ টাকায় দাঁড়াবে। তাছাড়া, উন্নত এ জাতের রেণু পোনা হ্যাচারী থেকে সংগ্রহ করে নার্সারী ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অনেকেই লাভবান হতে পারবে।
ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ আরো জানান, ‘সুবর্ণ রুই’ মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণের লক্ষ্যে প্রথমে এর জার্মপ্লাজম বিতরণ করা হবে। এ লক্ষ্যে ভিডিও সংযোগের মাধ্যমে মৎস্য অধিদপ্তর ও বেসরকারী পর্যায়ের নির্বাচিত ২০টি হ্যাচারীতে ‘সুবর্ণ রুই’ এর জার্মপ্লাজম (রেণু/পোনা) আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হবে। হ্যাচারীতে এসব রেণু/পোনা লালন-পালন করে ‘ব্রুড মাছ’ তৈরী করা হবে এবং পোনা উৎপাদনে ব্যবহার করা হবে। উৎপাদিত পোনা পরবর্তীতে চাষাবাদের জন্য ব্যবহৃত হবে। ফলে দেশে মাছের সামগ্রিক ফলন বৃদ্ধি পাবে। ‘সুবর্ণ রুই’ মাছের পোনা সরাসরি ইনস্টিটিউট হতে দেশের বিভিন্ন এলাকার ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা ও প্রতিবন্ধির পুকুরে বিনামূল্যে সরবরাহ করা হবে। তাঁদের পুকুরের উৎপাদন দেখে অন্যরাও সুবর্ণ রুই মাছ চাষে আগ্রহী হয়ে উঠবেন এবং ‘সুবর্ণ রুই’ দ্রুত মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারিত হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। ##

Share this post

scroll to top