ম্যালেরিয়ায় সমতলের মানুষ কেন বেশি মরে

দেশের বেশির ভাগ অঞ্চলে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণের কাছাকাছি থাকলেও পার্বত্য তিন জেলায় ম্যালেরিয়া এবার আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। কিন্তু পাহাড়িরা বেশি আক্রান্ত হলেও মরছে বেশি সমতলের মানুষ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পার্বত্য তিন জেলার পাহাড়িদের মধ্যে বেশি আক্রান্ত হলেও ওষুধে এরা দ্রুত সুস্থ হয়ে যায়। কিন্তু সমতলের মানুষ আক্রান্ত হলে এরা দ্রুত অসুস্থ হয়ে যান। ফলে এদের মধ্যে মৃত্যুর হারও বেশি। রাঙ্গামাটি জেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০১৬ সালে ম্যারেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সারা দেশে ১৭ জন মারা যায়। মৃতদের মধ্যে পাহাড়িদের সংখ্যা পাঁচ এবং অবশিষ্টরা ছিল সমতলেল মানুষ। এদের বেশির ভাগই হাসপাতালে শেষ পর্যায়ে চিকিৎসা নিতে এসেছে। ফলে চিকিৎসা ও ওষুধ থাকা সত্ত্বেও মৃত্যু এড়ানো যায়নি।

পার্বত্য এলাকার মানুষের অনেকেই মশক নিধন কর্মসূচি থাকে। তবুও একাধিকবার এরা ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে থাকেন। এমন নজির অনেক। রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলার বর্তমান চেয়ারম্যার মো: দিলদার হোসেন নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, তিনি নিজে ১১ বারের বেশি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। অসুস্থ হলে ওষুধ প্রয়োগে তিনি সুস্থ হন। কিন্তু বার বার আক্রান্ত হওয়ায় তিনি বিস্মিত। অন্যদিকে অনেক পাহাড়ি দিনের পর দিন গহীন অরণ্যে কাজ করছেন। এদের অনেকেই সেখানে মশারি টানানো ছাড়াই রাত যাপন করলেও বেশির ভাগই ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন না।

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ববিদ ডা: মো: মশিকুর রহমান বিটু জানান, পাহাড়ি ও সমতলের শরীরের গঠন আলাদা। শত বছর যাবত শুধু পাহাড়ে বসবাসের কারণে পাহাড়িদের শরীরে এক ধরনের অটো ইমিউন সিস্টেম (স্বয়ংক্রিয় প্রতিরোধী ব্যবস্থা) গড়ে উঠে। অন্যদিকে বাঙালিরা সমতলের লোক হওয়ায় তারা ম্যালেরিয়ার সাথে কম পরিচিত। বাঙালিদের মধ্যে প্রতিরোধ ব্যবস্থাটাও দুর্বল। এ কারণে সমতলের জনগোষ্ঠী আক্রান্ত হলে খুব বেশি সহ্য করতে পারে না।

রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি এই তিন পার্বত্য জেলায় সবচেয়ে বেশি ম্যালেরিয়া প্রবণ অঞ্চল। এই তিন জেলায় বনভূমির পরিমাণ বেশি। এখানে রয়েছে খুব ঘন অরণ্য। আবার এই তিন জেলার সাথে রয়েছে প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্ত। এই তিন জেলার ওপারে রয়েছে ভারত ও মিয়ানমারের গভীর বনাঞ্চল। বাংলাদেশের সর্বত্র ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে ব্যাপক কর্মসূচি থাকলেও প্রতিবেশী ওই দুই দেশের সীমান্ত অঞ্চলে মশক নিধনে অথবা ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে কোনো কর্মসূচি নেই। ফলে প্রতিবেশী দুই দেশ থেকে সহজেই মশা চলে আসছে।

ম্যালেরিয়া কর্মসূচির জাতীয় পর্যায়ের উপপ্রধান ডা: এম এম আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের দেশকে ম্যালেরিয়ামুক্ত করা একটি চ্যালেঞ্জ। কারণ ভারত, মিয়ানমারের মতো দেশগুলোর সীমান্ত রয়েছে বাংলাদেশের সাথে। সেখান থেকে ম্যালেরিয়ার জীবাণুযুক্ত মশা (প্লাজমোডিয়াম ফেলসিপ্যারাম ও প্লাজমোডিয়াম ভাইব্যাক্স প্রজাতির) এ দেশে চলে আসছে। ম্যালেরিয়া জীবাণুযুক্ত এসব মশা আবার ওষুধ প্রতিরোধী জীবাণুও বহন করছে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ অথবা ম্যালেরিয়ার চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও ভারত ও মিয়ানমারের বাংলাদেশ লাগোয়া সীমান্তের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এ ধরনের কোনো কর্মসূচি নেই। ফলে এখানে মশক নিধনের কর্মসূচি থাকলেও কিছু দিন পর ফের মশা চলে আসছে।’

বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ির মানুষ সবচেয়ে বেশি ম্যালেরিয়ার ঝুঁকিতে। জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ২৯ হাজার ২৪৭ জন ম্যালেরিয়ায় রোগীর ৯৩ শতাংশই এই তিন পার্বত্য জেলার। সীমান্তবর্তী পাহাড়, বেশি বৃষ্টিপাত, তিন জেলার অধিকাংশ এলাকায় রয়েছে ঘন বনাঞ্চল, অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও সেবাদানজনিত সমস্যার কারণে এ ঝুঁকি এখনো রয়ে গেছে বলে জানান ডা: এম এম আক্তারুজ্জামান।

কাপ্তাই উপজেলা চেয়ারম্যান মো: দিলদার হোসেন জানান, এই এলাকার মানুষের পানির সমস্যা রয়েছে। তারা পাহাড়ি ছড়া, ঝর্ণা অথবা নদীর পানি পান করেন। এই পানিতে মশা ডিম ছেড়ে থাকে। আবার এই পানিতে নানা ধরনের জীবাণু থাকা স্বাভাবিক। পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে হলে পানি সমস্যার সমাধান আগে করা উচিত।
রাঙ্গামাটি জেলার জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচির এসএমও ডা: অ্যান্ড্রু বিশ্বাস জানিয়েছেন, পাহাড়ের প্রতিটি মানুষকে মশারি দেয়া হয়েছে। আগে মশারি দেরি করে টানানো হতো। কিন্তু এখন আগে আগে টানানো হয়। ফলে কিছুটা উন্নতি হয়েছে।

রাঙ্গামাটি থেকে লেকের মধ্য দিয়ে কাপ্তাই যাওয়ার সময় দেখা গেছে পাহাড়ের ঢালে মশারি দিনের বেলায়ও টানিয়ে রেখেছে অনেকেই। ডা: মশিকুর রহমান বিটু জানান, এটা ভালো লক্ষণ। আমরা সব সময় মশারি টানিয়ে বিশ্রাম অথবা ঘুমানোর পরামর্শ দিয়ে থাকি।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top