মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান

ময়মনসিংহ লাইভ : মুক্তিযুদ্ধের সময় জনসংখ্যা অনুপাতে অর্ধেক ছিল নারী। এ হিসেবে বলা যেতেই পারে, তিন কোটি ৭৪ লাখ নারী মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সময় নারীরা খবর আদান-প্রদান করতেন। রাডার যেমন ভেতর ও বাইরের খবর দেয় আমাদের নারীরাও ঠিক সেই ভূমিকাই পালন করেছেন। দেশ স্বাধীন হয়েছে শুধু পুরুষের জন্য নয় বরং নারীরাও এ ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে রাখা অস্ত্র এগিয়ে দেয়া, খাবারের ব্যবস্থা করা, যারা মা-বোনদের ফেলে রেখে যুদ্ধে গেছেন তাদের সবকিছু আমলে রাখা এর সব কিছুই নারীরা করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করা সম্ভব।

যেমন:

* গবেষক বা বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবস্থান।

* মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক কর্মকান্ডে ও বিভিন্ন আন্দোলনে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ

* গেরীলাযুদ্ধে নারী

* চিকিৎসা ও সেবা ক্ষেত্রে নারী

* সংগঠক হিসেবে নারীর ভূমিকা

*মুক্তিযোদ্ধাদের মায়ের ভূমিকা

* নারী গবেষক ও শব্দসৈনিক

* যুদ্ধাকালীন নারী নির্যাতনের বিচার প্রক্রিয়া প্রভৃতি

২০১২ সালের ১৮ নভেম্বর বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা কৃর্তক প্রকাশিত একটি বিবৃতি থেকে জানা যায় তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী এ.বি তাজুল ইসলাম বলেন, মোট ২০৩ জন নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভূক্ত রয়েছেন। যেখানে ২০১৩ সালে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় ১,৭৭,০০০ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি তালিকা প্রকাশ করে।

(২০১৪ইং সালের) এ বছর মার্চের ১ তারিখ প্রথমআলো কার্যালয়ে ছয় নারী মুক্তিযোদ্ধাকে সংবর্ধণা দেয়া হয়। তাঁরা হলেন পুষ্পরানী শুল্কবৈদ্য, মালতী রাণী শুল্ক বৈদ্য, হীরামনি সাওতাল, ফারিজা খাতুন, সাবিত্রী নায়েক ও রাজিয়া খাতুন।

‘চেতনা একাত্তর’ হবিগঞ্জের মহাসচিব কেয়া চৌধুরির সাত বছরের চেষ্টায় গত বছরের ৯ ডিসেম্বর এই মুক্তিযোদ্ধারা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পান। এদের কেউ সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, কেউ সন্তানসহ সেনা ক্যাম্পে অবরুদ্ধ ছিলেন দিনের পর দিন। কেউ বোমার আঘাতে অঙ্গ হারিয়েছেন। অনুষ্ঠানে এস ফোর্সের অধিনায়ক কে.এম. সফিউল্লাহ্ বলেন “আজও মা-বোনদের স্বীকৃতি দেয়ার মত মন-মানসিকতা হয়নি আমাদের। রাজিয়া আমার ক্যাম্পের শিক্ষার্থী ছিলেন। মা-বোনেরা মুক্তিযুদ্ধের সময় থাকার জায়গা দিয়েছেন। কোথায় পাকবাহিনী আসবে তার খবর এনে দিয়েছেন। তাদের স্বীকৃতি যত দিন আমরা না দেব ততদিন আমাদের কাজ শেষ হবে না।” মুক্তিযোদ্ধাদের খুজে বের করে স্বীকৃতি দানের ঘটনা এই প্রথম বলে উল্লেখ করেন কেয়া চৌধুরী।

সূত্র: ২ মার্চ, প্রথম আলো।

সুকুমার বিশ্বাস তার সম্পাদিত বই “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১/নারী প্রত্যক্ষদশী ও অংশগ্রহণকারীর বিবরণ” এ সম্পাদকের কথায় লিখেছেন- “বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের নারীর ভূমিকাকে আলাদা কারে দেখার প্রয়াস শুরু হয় বিগত নব্বইয়ের দশক থেকে। এর আগ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আলোচনায় নারীরা ছিলেন অনুপস্থিত।”

‘মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র’ থেকে প্রথমবারের মতো বিভিন্ন অঞ্চলের মোট ১১৩ জন নারীর নিজ অভিজ্ঞতার বিবরণ তিন খন্ডে প্রকাশিত হয়। এছাড়া গবেষক আফসান চৌধুরি তাঁর ‘বাংলাদেশের ১৯৭১’ বইয়ের তৃতীয় খন্ডে ‘আদিবাসী ও বাংলাদেশের যুদ্ধ’ অধ্যায়ে মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী নারীদের অংশগ্রহনের বিষয়ে লিখেছেন।

খেতাবপ্রাপ্ত মোট ৬৭৬ জন মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ২ জন নারী বীর প্রতীক রয়েছেন। তাঁরা হলেন মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি ও ক্যাপ্টেন সিতারা। কিন্তু নারী ও পুরুষ মুক্তিযোদ্ধা অনুপাত ১:৩৩৮ হলেও অংশগ্রহণের অনুপাতটি এতটা ব্যবধান সূচক নয়। অনুমান করা যায় অন্য অনেক কিছুর পাশাপাশি স্বীকৃত নারীযোদ্ধার সংখ্যাগত এ দৈন্য পরবর্তী সময়ের ইতিহাস প্রণেতাগণকে নারীযোদ্ধাদের অনুসন্ধান ও মূল্যায়নে প্রবৃত্ত না হতে প্রভাবিত করে থাকবে।

পৃথিবীর যেকোন দেশে যেকোন যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হন নারীরা।

গবেষকরা বিশ্লেষন করে দেখাতে চেয়েছেন, সহিংসতার শিকারে নারী কিভাবে বৈষম্যমূলক মর্যাদা পায় একই সময়ের সহিংসতার শিকারে পুরুষের তুলনায়। পুরুষ হয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা, নারী হয়েছেন বীরাঙ্গণা, পুরুষ পেয়েছেন স্বীকৃতি আর নারী পেয়েছেন অস্বীকৃতি।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধ ও নারী, মালেকা বেগম

ইতিহাসের পরিক্রমায় এটা লক্ষণীয়ভাবে প্রমাণিত হয় যে, যুদ্ধকালীণ নারীর প্রতি সহিংসতা, ধর্ষণ ও যৌন অপরাধ কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বরং এটি একটি পরিকল্পিত বিষয় এবং যুদ্ধকৌশল। সাধারণভাবে দখলদারিত্ব ও আধিপত্য বিস্তারের কৌশল হিসেবে নারী নির্যাতন এবং ধর্ষণের ব্যবহার হয়ে থাকে। একটি জাতীয় মানসিক মুক্তিকে পর্যদুস্ত করার উপায় হিসেবে ভাবা হয়।

কেননা, এটি আঘাত হানে নারীর সম্মানের উপর। এই সম্মান মূলত পুরুষের, কেননা প্রচলিত ভাবধারা অনুযায়ী পুরুষই নারীর অভিভাবক, পিতা, স্বামী, ভাই এবং সন্তানরূপে। সুতরাং কোন নারীর প্রতি এই আচরণের অর্থ তার পুরুষ অভিভাবককে হেয় করা, তার পৌরষত্বকে চ্যালেঞ্জ করা। তাই এটি একটি যুদ্ধ কৌশল। আর এই যুদ্ধ কৌশলের শিকার হয় কেবল নারীরাই। সূত্র: মেঘনা গুহঠাকুরতা, “নারীবাদী দৃষ্টিতে ধর্ষণ ও আন্তজাতীক মানবাধিকার আইন।”

মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে সারা পূর্ববঙ্গে ১৪ লাখ বাঙ্গালী নারীকে বিভিন্নভাবে নির্যাতিত লাঞ্চিত ও স্বজনহারা নিঃস্বে পরিণত হতে হয়েছে। এই ১৪ লাখের মধ্যে ৪ লাখ মতান্তরে ২ লাখ নারী বর্বর পাকিস্তানী সেনা ও তাদের দোসর, রাজাকার এবং বিহারীগণ কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হন। তাদের কেউ পরে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করেন।

সূত্র : “মুক্তিযুদ্ধ ও নারী” রোকাইয়া কবির ও মুজিব মেহেদী

‘মুক্তিযুদ্ধে নারীকে একদিকে যেমন অসহায় করেছে, তেমনই সাহসী করেছে, যোদ্ধা করেছে। যুদ্ধ করেছেন বহু নারী অথচ সেই তুলনায় বীর প্রতীক খেতাব বা বীরের সম্মান তেমনভাবে দেয়া হয়নি অথচ পুরুষরা পেয়েছেন আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বীরের সম্মান।

সরকারী বেসরকারী বা রাজনৈতিক কোন উদ্যোগের সঙ্গেই নারীদের সংযুক্ত করা হয়নি। ব্যক্তি উদ্যোগে সংগঠক হিসেবে কাজ করেছেন যেসব নারী তাঁদের নামের কোন তালিকা নেই। তাঁরা যে কষ্ট করেছেন, নির্যাতিত হয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছেন এসব কিছু মুক্তিযোদ্ধাদের কাজ বলে আজও স্বীকৃতি পায়।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে নারী, মালেকা বেগম।

কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান বিষয়ে গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ লিখেছেন। ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত তাঁর “যুদ্ধ’ উপন্যাসে তিনি নতুন দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষিত নির্যাতিত নারীর পরিচয় তুলে ধরেছেন। তুলে ধরেছেন একাত্তরের নারীদের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ পরিচয়ে অনুপম সাহিত্যিক ভাষ্যে।

শওকত আরা হোসেন, তার মুক্তিযুদ্ধ ও নারী গ্রন্থে বলেন “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনেছে। কিন্তু মুক্তি আনেনি। শুধু একজন নারী নয়। লাখো লাখো নারী তাদের স্বামী হারিয়েছেন, সন্তান হারিয়েছেন, অথচ বিনিময়ে কিছুই পায়নি। শুধু তাই নয় দু’এক বছর আগে একটি পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধে যাদেরকে পাকবাহিনী বাসায় হত্যা করে এবং ধরে নিয়ে গেছে এর উপর একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। দেখা যায় প্রত্যেকটি পরিবারের ছেলেমেয়েরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। যে মহিলারা লাঞ্চিত হয়েছেন তাদের সমাজের সাথে সম্পৃক্ত করার চেয়ে এক নাম ‘বীরাঙ্গনা’ কি প্রয়োজন?

যুগে যুগে অনেক দেশেই স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু এভাবে বিভক্তি ও বৈষম্য অন্যদেশগুলোতে খুব কমই দেখা গেছে। নারীরা প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেছিলেন ট্রেনিং এবং যুদ্ধে অংশ গ্রহনের মাধ্যমে। আশ্রয়কেন্দ্রে নারীর অংশগ্রহণ, স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের কর্মকান্ড নারী পুরুষ উভয়ের সম্মিলিত আত্মত্যাগের ফসল এই বাংলাদেশ। একক ভাবে যখন নারীর প্রশ্নটি আসে তখনও দেখা যায় নারীর আত্মহুতি আত্মত্যাগ এখানে যথেষ্ট.. কিন্তু তাদের খোঁজ কে রাখে! বাংলাদেশে যারা সুপ্রতিষ্ঠিত তারা ভুলে গেছেন বাংলাদেশ না হলে তারা আজ এই আসনটি পেতেন না। আসলে ত্যাগের মহিমা যত উজ্জ্বল বঞ্চনাও বোধ হয় তত বেশি। তাই ত্যাগীরা হারিয়ে যাচ্ছেন। আর সুবিধা ভোগীরাই বেঁচে আছেন বিত্ত বৈভবে পরিবেষ্টিত হয়ে।

রাজনৈতিক কর্মকান্ডে ও বিভিন্ন আন্দোলনে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ

১৯৫২

যত আন্দোলনই করা হোক, বাঙ্গালী মুসলিম মেয়েদের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও ঘরের বাইরে এসে প্রত্যক্ষ আন্দোলন সংগ্রামে অংশগ্রহনের পেছনে ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা সবচেয়ে প্রত্যক্ষ ও মহোত্তম।

২। ফেব্রুয়ারী ঢা:বি: আমতলায় সভায় যোগদান করে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙ্গে এবং ১৪৪ ধারা অমান্য করে মেয়েরাই প্রথম বের হয়ে আসে। এদের মধ্যে ছিলেন ঢা: বি: এর ড: হালিমা খাতুন, ড: সুফিয়া খাতুন, রওশন আরা বাচ্চু, জুলেখা নুরী, ইডেন কলেজের গুলে ফেরদৌস, চেমন আরা, রওশন জাহান হোসেন, সোফিয়া করিম এবং আরও অনেকে পুলিশের লাঠি চার্জে প্রায় ৮ জন মেয়ে গুরুতর আহত হয় আর অনেকেই গ্রেফতার হন এ সময়। জহির রায়হান এর ‘আরেক ফাল্গুন’ এ যার আখ্যান আমরা পাই ।

সূত্র: বাংলার নারী সংগ্রামের ইতিহাস, অদিতি ফাল্গুনী।

সুপা সাদিয়া তাঁর “৫২র বায়ান্ন নারী” গ্রন্থে উল্লেখ করেন, “পাঁচ জন, সাত জন, দশজন বারে ছেলে ও মেয়েদের দল” রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, স্লোগান তুলে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। তিনি তাঁর বইয়ের ১৪৩ পৃষ্ঠায় একটি পত্রিকার বিবৃতি তুলে ধরেন। সেখানে বলা হয়, “ঢাকার ছাত্র ও জনসাধারণের উপর পুলিশের গুলি বর্ষণ সম্পর্কে প্রতিবাদের ১২ নং অভয় দাস লেনে মহিলাদের একটি বিরাট সভা হয়। সভার বিশেষত্ব ছিল এই সে, শহরে রিক্সা ও ঘোড়ার গাড়ি বন্ধ সত্ত্বেও বহুদূর হইতে পায়ে হাটিয়া বৃদ্ধা ও বয়সী মহিলারা পর্যন্ত সভায় যোগদান করেন।”

১৯৫৪

মুসলিম লীগ সরকারকতৃক মেয়েদের উপর চাপিয়ে দেয়া ক্রমাগত নিপীড়নমূলক আইনের প্রতিবাদে এদেশের মেয়েরা উৎসাহ ভরে যুক্তফ্রন্ট সরকারের সাধারণ নির্বাচনে ভূমিকা রাখেন।

৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী হিসেবে ১৪ জন নারী আইন পরিষদে নির্বাচিত হিয়েছিলেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেনঃ নূরজাহান মোর্শেদ, দৌলতুন্নেসা খাতুন, বদরুন্নেসা আহমেদ, আমেনা বেগম, সেলিনা বানু, তফাতুন্নেসা, মেহেরুন্নেসা খাতুন ও তিনজন সংখ্যালঘু সদস্যা। ১৯৫৮ সরলে আইয়ূব খান সামরিক শাসন জারি করলে নারী আন্দোলন কিছুদিনের জন্য থিতিয়ে পড়ে।

১৯৬০

সালের শুরুতে ধীরে ধীরে নারী সংগঠন গুলো যেমন, গেন্ডারিয়া মহিলা সমিতি। ওয়ারী মহিলা সমিতি, আপওয়া, নিখিল পাকিস্থান সমাজকল্যান সমিতি প্রমুখ তাদের সংগঠনিক কাজকর্ম পুনরায় শুরু করে। আইয়ূব খানের শাসনামলে ৫৬ সালের শাসনতন্ত্র বাতিল করে নতুন সংবিধান রচনার প্রাক্কালে নারীসমাজ এই দাবীতে সোচ্চার হন যে, নতুন সংবিধানে নারীর সমঅধিকার যেন রক্ষিত হয়।

১৯৬১

১৯৬১ সালের মুসলিম পরিবারিক আইন মেয়েদের আন্দোলনের একটি বিজয়মালার এ আইনে জাস্টিস রশিদ কমিশনের সকল সুপারিশ গৃহিত না হলেও নারীসমাজের অধিকার অর্জনের ইতিহাসের এটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। বহু বিবাহ প্রথা নিরুৎসাহিত করা, স্ত্রীকে যথেচ্ছ তালাক দেয়া নিয়ন্ত্রিত করা, বিয়ের রেজিষ্ট্রেশন নিশ্চিত করা, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে মোহরানা দাবীমাত্র পরিশোধ করা প্রভৃতি আইনের ধারা সংযুক্ত করা হয়েছে।

কিন্তু উভয় পাকিস্তানের ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃবৃন্দ বলেন, মুসলিম পারিবারিক আইন ১৯৬১ পবিত্র কোরানের পরিপন্থী। এজাতীয় বক্তব্যের প্রতিবাদে পশ্চিম পাকিস্থানে মহিলারা মৌলবাদী নেতৃবৃন্দের কুশপুত্তলিকা দাহ করেন এবং ঢাকা ৬টি মহিলা সংগঠন একত্রে বেগম ক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলন করেন। ইডেন কলেজের ছাত্রী নেত্রী মতিয়া চৌধুরী তখন মহিলাদের দাবী সমর্থন করে বিবৃতি দেন।

১৯৬৪

১৯৬৪ সালের জানুয়ারীতে শামসুন্নাহার মাহমুদ নির্বাচক মন্ডলীর বিলের সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন। আইন পরিষদসহ নির্বাচকমন্ডলীতে ২৫ শতাংশ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত করার দাবি জানান। পূর্ব পাকিস্থানের সদস্য বেগম রোকাইয়া আনোয়ার। সেলিমা রইসউদ্দিন পূর্ব পাকিস্থান বিজনেস অ্যান্ড প্রফেশনাল ইউমেন্স ক্লাব গঠন করেন।

সূত্র : রনেশ দাশগুপ্তর “রহমানের মা ও অন্যান্য” , জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী : ২১শে ফেব্রুয়ারী

এসময় মেয়েরা কেন্দ্রীয় সরবারের সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অংশগ্রহনের অনুমতিদানের জন্য আন্দোলন করেছিলে ন। ‘৬৪-র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়ও সুফিয়া কামাল, সাানজীদা খাতুন, রোকেয়া রহমান কবীরের মত নারীনেত্রীরা দাঙ্গা বিরোধী কার্যক্রমে অংশ নেন।

সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিল অংশ ২য় খণ্ড

১৯৬৬

৬৬ এর ৬ দফায় সক্রীয় অংশগ্রহণ করেন নারীরা। যার একটি প্রামান্য চিত্র জাতীয় যাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। ঢা: বি: এর বটতলা থেকে পাঁচ হাজার ছাত্র ছাত্রী বিরতি শোক মিছিল সারা ঢাকা দক্ষিণ করে যেখানে ছাত্রী ছিল ৫০০।

২৪ জানুয়ারী- ১৯৬৯ সুফিয়া কামাল তার নিজ বাড়িতে নারী আন্দোলনের নেত্রীদের নিয়ে সভা করেন এবং ৭ ফেব্রুয়ারি মহিলাসমাজের শোকসভা আহ্বান করেন। ঐ দিন সন্ধ্যা ৭টা থেকে কারফিউ জারি করা হলে তার নেতৃত্বে সকাল ১০ টায় শহীদ মিনারে সমাবেশ করেন এবং আড়াই হাজার নারী মিছিল করে হাইকোর্টের সামনে দিয়ে নবাবপুর হয়ে বাহাদুরশাহ পার্কে যান।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে নারী গ্রন্থ, মালেকা বেগম

১০ ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯ গঠিত হয় ‘মহিলা সংগ্রাম পরিষদ। নেতৃত্বে-সুফিয়া কামাল। সংগঠনের আহ্বায়িকা ছিলেন মালেকা বেগম। ১৯৬৯ এর গণআন্দোলনে স্কুল, কলেজ, মেডিকেল কলেজ, ঢাকা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে নারী গ্রন্থ, মালেকা বেগম

১ সেপ্টেম্বর ১৯৬৯

বর্ণমালা সংস্কারের প্রতিবাদে ৪২ জন বুদ্ধিজীবীর বিবৃতিতে যারা স্বাক্ষর করেন, তাদের মধ্যে ছিলেন বেগম সুফিয়া কামাল, মিসেস লায়লা সামাদ ও নূর জাহান বেগম।

সূত্র : দৈনিক পাকিস্তান।

১৪ই ফেব্রুয়ারী ১৯৭০

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাই এসোসিয়েশন ২০০৯ ‘সৌরভে গৌরবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ শীর্ষক স্বারক গ্রন্থে ১ম খন্ডে ‘আমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাঙালির স্বাধীনতা’ নামক আব্দুর রবের একটি মূল্যবান লেখা রয়েছে, এতে জঙ্গী ছাত্রীদের নিয়ে ‘জয় বাংলা বাহিনীর এর ‘প্রীতিলতা ছাত্রী বাহিনী’ গড়ে তোলার কথা উল্লেখ করেন।

১৯৭০ সালের ৪ এপ্রিল

সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় “পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদ”।

মার্চ ১৯৭১

১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার নিন্দা করে মুসলিম ছাত্রীসংঘের সভানেত্রী শওকত আরা ও সাধারণ সম্পাদিকা শাহানা এক মুক্ত বিবৃতিতে অবিলম্বে অধিবেশন আহ্বানে দাবি জানান। ৫ মার্চ নিখিল পাকিস্তান মহিলা সমিতির পূর্বাঞ্চল শাখা সশস্ত্রবাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করার তীব্র নিন্দা করে। ৬ মার্চ কবি সুফিয়া কামালের সভাপতিত্বে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গনে ‘পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব বাংলার নারীসমাজ এই সভা থেকে চলমান গণ আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করেছিল।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে নারী, মালেকা বেগম

‘বাঙালির জাতিয়তাবাদী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’ গ্রন্থে, ডঃ ফজলুর রহমান লিখেছেন, ‘‘৯ মার্চ চট্টগ্রামে জেএম সেন হলে মহিলা আওয়ামী লীগের সভা হয়। এতে বক্তৃতা দিয়েছিলেন মেহেরুন্নেসা বেগম সরাফত উল্লাহ, বেগম নাজনীন, বেগম কামরুন্নাহার বেগম মুছা খান, কুন্দপ্রভা সেন প্রমুখ।”

১১ই মার্চ চট্টগ্রামে পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে নগরে বিরাট মিছিল হয়। বিকেলে জে এম সেন হলে মহিলা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে এক বিরাট সভা হয়। ১২ মার্চ, চট্টগ্রাম মহিলা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে শহরে লাঠিমিছিল হয়। ১৬ মার্চ ১৯৭১ পূর্বে পাকিস্তান মহিলা পরিষদের উদ্যোগে বিকেল চারটায় ১২ নম্বর তোপখানায় মহিলাদের সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত।

সূত্র : দৈনিক পাকিস্তান, ২য় খন্ড, পৃ: ৮৩০।

১৭ মার্চ – ১৯৭১ ঢাকায় বিভিন্ন দল ও সংগঠনের অসহযোগ আন্দোলনকালীন কর্মসূচি পালন করা হয়। এদিন বিকেলে পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদের উদ্যোগে নিয়মিত কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত ও প্রাথমিক চিকিৎসা বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেয়।

সূত্র : ইত্তেফাক, সংবাদ, পূর্বদেশ।

শ্রমিক দলের সাবেক মন্ত্রী মিসেস জুডিথ হার্ট। ভারতে অনুষ্ঠিত অন্য এক সমাবেশে বোম্বাইয়ের বান্দ্রা সেন্ট জোসেফ কনডেন্টের ছাত্রী ইয়ং ক্রিশ্চিয়ান স্টুডেন্ট গ্রুপের সভানেত্রী কুমারী নোয়েলার ঘোষণা ৪ নভেম্বর (১৯৭১) অনুষ্ঠেয় এক পদযাত্রায় প্রায় ২ হাজার ছাত্রী বাংলাদেশের সমর্থনে অংশ নেবে।

সূত্র : বাংলার বাণী, ৭ম সংখ্যা।

১২ জুলাই ১৯৭১

বিশ্বের নারী সমাজের প্রতি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের অন্তিম আবেদন ‘বাংলার নারীদের বাঁচান’।

সূত্র : সংবাদপত্র : স্বাধীন বাংলা, ১ম বর্ষ ৭ম সংখ্যা

২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

নয়া দিল্লিতে আয়োজিত বাংলাদেশ সম্মেলনে যেসব বিশ্বনেতার অবদান ছিল, তাঁদের মধ্যে ছিলেন অসলোর মিসেস মিগরিড, সুচেতা কৃপালনী, বিজয়-লক্ষ্মী পন্ডিত প্রমুখ। সূত্র : সংবাদপত্র জয়বাংলা ১ম বর্ষ- ২০ সংখ্যা।

এছাড়াও মহিলা পরিষদের সদস্যরা পরাধীন দেশে মুক্তিকামী বাঙ্গালী নারীর উপর পাকসেনাদের অত্যাচারের বিভিন্ন আলোকচিত্র ও বিবরণ সহ ” To the conscience of people ” নামক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন।

২৩ মার্চ ১৯৭১

২৩ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবানে সারা দেশে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল। পল্টন ময়দানে পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে ১০ প্লাটুন বিশিষ্ট জয় বাংলা বাহিনীর এক প্লাটুনে ছিলেন ছাত্রী। তাদের প্রত্যেকের হাতে ছিল ডামি রাইফেল।

সূত্রঃ দৈনিক পাকিস্তান, ঢাকা, ২৪ মার্চ ১৯৭১

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রথম নারী গেরিলা স্কোয়াডের নেতৃী ফোরকান বেগম তার “স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে নারী” গ্রন্থে বলেন- ২৩ মার্চ আমরা স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বাহিনীর পাকিস্থানের বুকে পাকিস্থান ডে-এর বিপরীতে স্বাধীন বাংলাদেশ ডে পালন করি। মেয়েদের মধ্যে শামনুন্নাহার ইকু পতাকা হাতে প্যারেডের সামনে চলে, তারপর আমি সাকী আপা,কাওসার ঝুনুসহ অন্য মেয়েরা। আমরাই প্যারেডের নেতৃত্ব দেই। আমাদের অনুসরণ করে ছেলেদের দল।

তিনি তার গ্রন্থে আরো উল্লেখ করেন ৭ই মার্চের ভাষণ, ২৩শে মার্চে আমাদের কুচকাওয়াজ ও বঙ্গবন্ধুর পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার বাস্তব রুপ লাভ করে। তাই ২৩ মার্চের ঘটনা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। যার অগ্রভাগে ছিলেন মেয়েরা।

১ এপ্রিল ১৯৭১

বাংলাদেশের মুক্তির সমর্থনে ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন হলে ভারতীয় ফেডারেশনের উদ্দ্যেগে মহিলাদের এক সভা হয়।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর। ১২ খন্ড পৃঃ৩১

১৯৭২

পাকিস্তানি দালালের বিচারের দাবী জানিয়ে মহিলাদের মিছিল ও বিক্ষোভ। তারা সরাসরি বঙ্গবন্ধুর কাছে দাবী তোলেন। উল্লেখ্য ১৯৭২ সালেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দালান আইন প্রণীত হয় এবং দালালের বিচার শুরু হয়।

সূত্র : জাতীয় জাদুঘরের মুক্তিযুদ্ধ গ্যালারী

গেরিলা যোদ্ধা হিসাবে নারীর ভূমিকা

গেরিলা আমরা আমরা গেরিলা, স্বাধীনতার রক্তে রাঙ্গা আমরা গেরিলা, আমরা নতুন প্রাণ, গাই স্বাধীনতার গান। আমরা নবীন প্রান, গাই শিকল ভাঙ্গার গান্, বাংলাদেশের আলোছায়ায় আমরা গরীয়ান।

জাগরনের এই গানটি থেকে মুক্তিযুদ্ধে গেরিলাদের যে আত্তিক দৃঢ়তার পরিচয় পাওয়া যায় তার অংশীদার নারীরাও। মুক্তিযুদ্ধে নারী গেরিলাদের কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হবে বেগম ফোরকানের কথা যার নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল প্রথম গেরিলা স্কোয়াড। তার নেতৃত্বে প্রথম দলে ছিলেন আটজন। তারা ফেব্রুয়ারী মাস থেকেই অস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন। নারীদের গেরিলা ট্রেনিংয়ের জন্য বিভিন্ন শরনার্থী শিবির থেকে শতাধিক মহিলাকে নির্বাচন করা হয়। প্রথম এদের বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র সর্ম্পকে ধারণা দেওয়া হয় এবং তাদের মধ্যে থেকে সুইসাইড স্কোয়াডের জন্য উচ্চতর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

পূর্বঞ্চালীয় হাই কমান্ড জনাব শেখ ফজলুল হক মনির নির্দেশে তাঁর সেকেন্ড ইন কমান্ড জনাব আ.স.ম. আব্দুর রব কিশোর তরুনী নেত্রীদের গেরিলা ও সুইসাইড স্কোয়াডের আধুনিক অস্ত্রের উচ্চতর প্রশিক্ষণ এর ব্যবস্থা করেছিলেন লেম্বুচোরা ক্যাম্প, আগারতলায়।

সূত্র: স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে নারী, ফোরকান বেগম।

যদ্ধ শুরু হওয়ার পরে সংগ্রামী যোদ্ধা মেয়েদের জন্য বাংলাদেশের তৎকালীন সংসদ সদস্যা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর পরিচালনায় ‘গোবরা ক্যাম্প’ চালু হয়েছিল। সেই ক্যাম্পে মেয়েরা অস্ত্র চালনা শিখতো। বিভিন্ন রাজণৈতিক দল ও ব্যাক্তি উদ্যোগে প্রায় ৩০০ তরুনী ও কিশোরী সংগঠক গোবরা ক্যাম্পে অবস্থান করতেন। এছাড়াও সিভিল ডিফেন্স ও নার্সিং এর প্রশিক্ষণ দেয়া হত সেখানে।

সূত্রঃ মুক্তিযোদ্ধে নারী মালেকা বেগম।

তারামন বিবি বীরপ্রতীক মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজীবপুর ট্রেনিং ক্যাম্পে রাধুনী হিসেবে যোগদেন। তখণ তিনি ১৪/১৫ বছরের কিশোরী। শরীরে শক্তিমত্তা ছিল অন্যরকম। কোন ভারী কাজেও তাকে পিছপা হতে দেখা যায়নি। পুরুষ সহযোদ্ধাদের পাশাপাশি সর্বদা অগ্রকদম ফেলে এগিয়েছেন। রাজীবপুর ওয়ার ফিল্ডে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ন গুপ্তচরবৃত্তির কাজ করে গেছেন। একের পর এক এসাইনমেন্ট সে পাকিস্থানী সেনাদের অবস্থানস্থল কোদালকাঠী ইউনিয়নে ঢুকে যেতেন। রাতের বেলা পাক সেনা শিবিরের কাছাকাছি ঢুঁ মেরে বের করে আনতেন সব হাঁড়ির খবর। তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই মুক্তিবাহিনী প্রথম পাকসেনা শিবিরে হামলা চালায়। এছাড়া ওই রনাঙ্গানে যুদ্ধ শুরুর আগে তারামন বিবি অসংখ্য বাঙ্গালী পরিবারকে পাকবাহিনীর কবল থেকে নিরাপদ স্থানে আনার এসাইনমেন্টও অংশ নেয়।

একাত্তরের গেরিলা যোদ্ধা আলমতাজ বেগম ছবি মুক্তিযুদ্ধ শিবিরে যোদ্ধাদের রান্নাবান্নার পাশাপাশি অস্ত্র চালনা ও গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন। ৭/৮ একসময় পাক সেনারা ঘিরে ফেলেছিল ঐ মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পটি। ৭/৮ দিন অবরুদ্ধ অবস্থায় যুদ্ধ করেছিলেন তিনি।

বরিশালের মুলাদী থানার কুতুব বহিনীতে করুণা বেগম অন্য মহিলাযোদ্ধাদের সাথে অস্ত্র শিক্ষা নিয়েছিলেন। এই বাহিনীর অধীনে ৫০ জন মহিলা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি এই বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। ছদ্মবেশে থেকে শত্রু ছাউনির ওপর গ্রেনেড নিক্ষেপ করে অপারেশন চালিয়েছেন। এছাড়াও স্টেনগান রাইফেল চালানো এবং যে কোন ধরণের বিস্ফোরক দ্রব্য সর্ম্পকে বিশেষ প্রশিক্ষণ লাভ করেছিলেন।

পুরুষের পোশাক পরে যুদ্ধ করেছিলেন আলেয়া বেগম। তিনি চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা থানা কমান্ডের ইউনিট কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। “রাইফেল বন্ধুক এস.এম,জি এস,এল অর সবকিছু চালানোতেই আলেয়া সমান পারদর্শী ছিলেন। শত্রুপক্ষের শক্তি ও অবস্থান বুঝে তাদের মোকাবেলা করার জন্য এসব সমরাস্ত্র হাতে নিয়ে তিনি ছুটতেন। নিমিষে ঝাঁঝরা করে দিতেন পাক হানাদার ও তাদের দোসরদের বুক। গুড়িয়ে দিতেন শত্রুর ঘাঁটি। একাধিক সম্মুখ সমরে তার ছিল উজ্জ্বল উপস্থিতি। তিনি ভারতের চাপড়া ট্রেনিং ক্যাম্পে যুদ্ধ কৌশল ও সমরাস্ত্র চালানো শেখেন।

পিরোজপুর জেলার “অপারেশন স্বরুপকাঠীর বাহিনীর অকতোভয় দুই নারী মুক্তিযোদ্ধা বীথিকা বিশ্বাস এবং শিশির কনা গ্রেনেড চার্জ করে উড়িয়ে দিয়েছিলেন গানবোর্ড। নৌকা থেকে পানিতে নেমে সাঁতরে কচুরিপানার সাথে মিশে ভাসতে ভাসতে ভিড়েছিলেন লঞ্চের গায়ে। ছুড়ে মেরেছিলেন গ্রেনেড। পিরোজপুরে এক অখ্যাত গ্রামের মেয়েগুলো হয়ে উঠেছিলে এক একজন দুর্ধর্ষ গেরিলা। বীথিকা গেরিলা ও গুপ্তচরবৃত্তির ট্রেনিং দেয়ার জন্য মেয়েদের সংগ্রহ করে আনতো। শেষ পর্যন্ত প্রায় ১০০ মেয়েকে ট্রেনিং দেয়া হয়েছিল।

সূত্র: দৈনিক জনকন্ঠ, ১৩ ডিসেম্বর ১৯৯৮

ভাবনার বিষয় হচ্ছে বিভিন্ন ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে এতো মেয়েরা ট্রেনিং নিয়েছে যুদ্ধ করেছে কোথাও থেকে ৫০/১০০ অথবা ৩০০ বা তারও বেশি এভাবে হাজার হাজার নারীরা ট্রেনিং নিয়েছেন যুদ্ধ করেছেন। অথচ তালিকাভুক্ত নারী মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ২০৯ জন।

মুক্তিযুদ্ধে নারী সংগঠক

নারীদের মধ্যে যারা সংগঠক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন তাদের মধ্যে বেগম মতিয়া চৌধুরী, জাতীয় পরিষদের সদস্য বেগম নূরজাহান মুরশিদ, তৎকালীন জাতীয় সংসদ সদস্য মমতাজ বেগম অন্যতম। পরবর্তীতে মমতাজ বেগম “মহিলা আওয়ামীলীগ সেচ্ছাসেবক বাহিনী” নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। মহিলা সংগ্রাম পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বেগম, আমেনা পন্নী, জাহানার আঙ্গুর, সেলিনা হোসেন, আয়শা খানম, মুনিরা আক্তার, রোকেয়া বেগম প্রমুখ উল্লেখযোগ্যভূমিকা পালন করেছেন।

এছাড়াও মহিলা সংগ্রাম পরিষদের নেত্রী কবি বেগম সুফিয়া কামাল, ডঃ নীলিমা ইব্রাহীম, জাহানারা ইমাম নেতৃস্থানীয় সংগঠক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

বাংলাদেশের সংগ্রামী নেত্রী আশালতা সেন (১৮৯৪-১৯৮৬)যুদ্ধের সময় নিউইয়র্কে ছিলেন বিশ্বব্যাংকে কর্মরত তার ছেলে সমর সেনের বাড়ীতে। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রবাসীদের সংগঠিত করেন। বয়সের ভার অগ্রাহ্য করে তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের ভবনের সামনে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সমাবেশে ভাষন দেন এবং অনসনকারীদের সাথে যোগ দেন।

সূত্রঃ আবুল মাল আব্দুল মুহিত এর “স্মৃতি অম্লান ১৯৭১”

সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে স্বাধীনতার পরে ভেতরে বেশ কয়েকজন সচেতন নারী সংগঠক ছিলেন নিয়ে শুরু করেন নির্যাতিত নারীদের উদ্ধার কাজ। গড়ে ওঠে নারী পূনর্বাসন সংস্থা। এটাও ছিল আরেক মুক্তিযুদ্ধ। ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ও সামরিক কর্মকান্ড চললেও তার অন্তিম পর্ব শুরু হয় নির্যাতিতাদের পূনর্বাসনের কাজ শুরু করার ভেতর দিয়ে যা চলছে এখনও ।

সূত্রঃ সুমনা শারমীন ও মুন্নী সাহা “ ধর্ষিতা বোনের শাড়ি এই আমাদের রক্তাক্ত জাতির পতাকা, ঢাকা, সাপ্তাহিক কাগজ পত্রিকা ১৯৯৯ পৃঃ ১১-১৭

মুক্তিযুদ্ধে উদ্ভুত অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের গর্ভজাত সন্তানের সমস্যা, চিকিৎসা, সেবা ও পুনর্বাসনও করেছেন তাঁরা। এ বছরের মধ্যে সংসার পরিত্যক্ত পাঁচ হাজার মেয়ের ঠিকানা হলো ঢাকায় ২০ নম্বর ইস্কাটনে স্থাপিত নারী পুনর্বাসন সংস্থায়। বহু মেয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। তারা বেশিরভাগ সময় কাঁদতেন, কখনো চিৎকার করতেন আবার নিশ্চুপ হয়ে যেতেন। তাঁদের স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে আপ্রাণ উদ্যোগ নিয়ে ছিলেন সংগঠকেরা।

সংগঠেকরা সারা পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ করে আগ্রহী ব্যক্তিদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন যুদ্ধশিশুদের। মাদার তেরেসার দায়িত্বে তুলে দেওয়া হয়েছিল অসংখ্য যুদ্ধশিশুকে।

চিকিৎসা ও সেবা কর্মে নারীর অবদান

আহত সৈনিকদের সেবার মাধ্যমে বাঁচিয়ে তুলতে বহু ছাত্রী ও নারীরা আত্মনিয়োগ করেছেন। ‘বাংলাদেশ নার্সিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্যাম্প গুলিতে।

বর্তমান কমিউনিউটি ক্লিনিকের পরিচালক এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ডঃ মাকদুমা নার্গিস রত্না যুদ্ধকালীন সময়ে কমুনিষ্ট পার্টির একজন সদস্য হিসাবে নারী আন্দোলন সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। একজন সংগঠক হিসেবে জনমত তৈরী ও শরানার্থীদের মনোবল বৃদ্ধির কাজে নিয়োজিত ছিলেন। এছাড়াও নারী সংগঠকদের সাথে যোগাযোগ করে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সাহায্যে সংগ্রহ করেন।

সূত্রঃ নারী প্রগতিতে ঢাঃ বিঃ ও রোকেয়া হল সেলিনা চৌধুরী।

ডঃ ফৌজিয়া মোসলেম আগরতলায় মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের চিকিৎসকের এবং চিকিৎসা ক্যাম্প পরিচালনা করেন। এছাড়াও জনমত তৈরি ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করেন।

সূত্রঃ নারী প্রগতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রোকেয়া হল

মুক্তিযোদ্ধাদের মায়ের ভূমিকাঃ

‘উইমেন ফর উইমেন’- এর গবেষক অধ্যাপক ডঃ নুরুন্নাহার ফয়জুন্নেসা “একাত্তরের প্রছন্ন প্রচ্ছদ” এ সংকলিত করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের মায়েদের কথা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে প্রকাশিত বহু বইয়ের মধ্যে এই বইটিতে প্রথমবারের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের মায়েদের কথা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। সীমিত সাধ্যে লিপিবদ্ধ করা স্বল্পসংখ্যক মায়ের সাক্ষাৎকারের বিবরণ এই বইয়ে থাকলেও বইটির গবেষকদের কাছে জাতি কৃতজ্ঞ থাকবে।

“দেশের কোটি কোটি সন্তান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। মায়েরা সন্তানদের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষায় চোখের পানি ফেলতেও দ্বিধা করেছেন। বাড়িতে বাড়িতে গ্রামে-গঞ্জে মায়েরা মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য নিজেদের ঘরের দা-বটি নিয়ে প্রস্তুত থাকতেন। এই দৃঢ় সংকল্প নিয়ে যে মিলিটারী রাজাকার মেরে তবেই নিজেরা মরবেন। তাঁদের সবাই কেবল মুক্তিযোদ্ধাদের মাই নন নিজেরাও মুক্তিযোদ্ধা।

সূত্রঃ ‘মুক্তিযুদ্ধে নারী’ মালেকা বেগম

মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যেক মায়ের রুপ এক ও অভিন্ন। তারা ত্যাগী, সহনশীল ও অসীম ধৈর্যশীলা।

শহীদ জননী জাহানারা ইমাম মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রেরণা দানকারী নারী হিসাবে স্মরনীয় হয়ে থাকবেন। তিনি স্বেচ্ছায় তার পুত্র রুমীকে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত করে দেন। তাকে বলেন “যা তোকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য উৎসর্গ করলাম” রুমী মায়ের সে কামনা পূর্ণ করেছিলেন। প্রশিক্ষণ শেষে দেশের ভেতরে গেরিলা যুদ্ধে শহীদ হয় রুমী। জাহানারা ইমাম মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন। অস্ত্রের হেফাজত করেছেন। ইঞ্জিনিয়ার স্বামী শরীফ ইমামের সহায়তায় ব্রিজ কালভার্টের তালিকা বা ব্রীজের নানান খুঁটিনাটি সংগ্রহ করেন। তথ্য সংগ্রহ ছিল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রাথমিক পর্যায়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন কাজ। গেরিলা যুদ্ধে তিনি ছেলে রুমী ও তার সহযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন নানাভাবে। “একাত্তরের দিনগুলি” মুক্তিযুদ্ধের একটি দলিল হিসাবে এবং একজন নারীর বেদনাদগ্ধ জীবন কাহিনী হিসাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। শুধু যুদ্ধেই তাঁর ভূমিকা বললে শেষ হবে না তাকে নিয়ে বলা। তাঁর নেতৃত্বে ১৯৯২ সালে ২৬ মার্চ গণ আদালতে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচার শুরু হয়েছিল।

৩০ লাখ শহীদ মুক্তিযোদ্ধার মা অপেক্ষা করেছেন যুগের পর যুগ ধরে তাঁদের সন্তানদের প্রতীক্ষায়। মনে একটিই জিজ্ঞাসা “খোকা, তুই কবে আসবি, কবে ছুটি? অথবা কোন মা সেই রেল লাইনের ধারে মেঠো পথটির পাড়ে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে আছেন খোকা তার কবে আসবে। আবার কেউ শোকে নিথর হয়েছেন। কেউ হয়েছেন মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন। আর সন্তানদেরও দেশ স্বাধীন করে তার মায়ের কাছে ফিরতে চাওয়ার আকুলতা আমরা খুঁজে পাই “একাত্তরের চিঠিগুলি থেকে”।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কর্মে নারী

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নারী গবেষক ও সাহিত্যকেরাও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও মুক্তিযোদ্ধা। সাহিত্য সাধনায় বাংলাদেশের নারীরা মুক্তিযুদ্ধে বিষয়ে গবেষণা করেছেন, সাহিত্য রচনা করেছেন। মালেকা বেগম এর মুক্তিযুদ্ধে নারী গ্রন্থের ১৫২ পৃষ্ঠায় সুফিয়া কামাল, নীলিমা ইব্রাহিম, জাহানারা ইমাম, রাবেয়া খাতুন, বেগম মুশতারী শফী সহ মোট ২২ জন গবেষকের নাম উল্লেখ করেছেন। যেখানে মুক্তিযুদ্ধের উপর প্রায় ২০০ টি গ্রন্থ রচিত হয়েছে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা ও অবদানের কথা যেসব গ্রন্থে পাওয়া যাবে তাঁর একটি নির্বাচিত তালিকায় (২০০-২০১ পৃষ্ঠায়) মোট ৩৯ বইয়ের নাম উল্লেখ করেছেন। উল্লেখ্য মুক্তিযুদ্ধে সর্বাধিক পঠিত তিনটি বই আমি বীরাঙ্গনা বলছি (নীরিমা ইব্রাহীম) একাত্তরের দিনগুলি (জাহানারা ইমাম) মা (আনিসুল হক) যা রচিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকাকে কেন্দ্র করে।

নিলীমা ইব্রাহিম : নারী পুনর্বাসন কার্যক্রমের সাথে জড়িত ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ নীলিমা এব্রাহিম, নির্যাতিত নারীদের কয়েকজনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে “আমি বীরাঙ্গনা বলছি,” নামের একটি প্রামাণ্য গ্রন্থও তিনি লিখেছেন।

১৯৭২ সালে যখন পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিরা ভারতের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছিল, তখন তিনি খবর পান, প্রায় তিরিশ- চল্লিশজন ধর্ষিত নারী তাদের সঙ্গে দেশত্যাগ করছেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় এবং বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় তাঁদের সঙ্গে দেখা করেন এবং তাদেরকে বাংলাদেশে থেকে যাওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু আপনজন কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে তারা দেশ ত্যাগে অনড় ছিলেন। তাঁদের ভেতর ১৪- ১৫ বছরের এক কিশোরীও ছিল। নীলিমা ইব্রাহীম এই কিশোরীকে বলেছিলেন, “তুমি আমার বাড়িতে থাকবে আমার মেয়ের মতো। তবু সে রাজি হয় নি। বলেছে, আপনি যখন থাকবেন না, তখন আমার কি হবে? যখন সবাই জানবে পাকিস্তানিরা আমাকে স্পর্শ করেছে তখন সকলেই আমাকে ঘৃণা করবে।’ মেয়েটি জানতো যে, পাকিস্তানিরা ওকে নিয়ে বিক্রি করে দেবে কিন্তু তারপরও ওখানে কেউ তাকে চিনবে না বলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

“আমি বীবাঙ্গনা বলছি “গ্রন্থে যাদের উল্লেখ আছে তাঁরা সকলেই মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শিক্ষিত পরিবারের সন্তান, যাঁদের মুক্তিযুদ্ধে নয় মাস আটক রাখা হয়েছিল পাকিস্তানিদের বিভিন্ন বাঙ্কারে। নারীদের ওপর পাকিস্তানি সেনাদের পৈচাশিক অত্যাচারের বিবরণ রয়েছে নীলিমা ইব্রাহীমের গ্রন্থের সর্বত্র।

বীরঙ্গনাদের তালিকা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন “স্বয়ং বঙ্গবন্ধু এই তালিকা ধ্বংস করে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন, কারণ তিনি এটি উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন যে, আমাদের সমাজ এদের স্বাভাবিকভাকে গ্রহণ করার মত উদার নয়। বঙ্গবন্ধু আন্তরিকভাবে চেয়েছিলেন নারীরা যেন স্বাভাবিক পারিবারিক জীবনে ফিরে যেতে পারেন।”

‘বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব’ নামের গ্রন্থে নীলিমা ইব্রাহিম উল্লেখ করেন, “যে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে মুজিব বঙ্গবন্ধুতে পরিণত হয়েছিলেন। তার সে পথ কি নি:সঙ্গ যাত্রার ছিল? না, কোনও রমনী তার হৃদয় মন, মনন, মানসিকতা, অন্তরের সবটুকু নির্যাস, দেহের শ্বেদ ব্যয় করে তার হাত ধরে কখনও পেছনে কখনও সামনে থেকে চলেছিল।

অথচ সেখানে তাঁর অবদান না থাকলে শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু হতেন কিনা, সে বিষয়ে আমার অন্তত, সন্দেহের অবকাশ আছে। দেশ বরেণ্য নেতা শুধু নন, দু:খী মানুষের বন্ধু মুজিব দিন কাটিয়েছেন মিটিং মিছল, দাবি, স্লোগান আর কারাবাসে। মনে হয় শেষ স্থানটিই তাঁর সর্বাধিক প্রিয় ও মোটামুটি স্থায়ী ঠিকানা ছিল। সেখানে ছিল পড়াশুনার সুযোগ ছিল স্থির মস্তিস্কে। পরবর্তী কর্মসূচী সিদ্ধান্ত গ্রহণ আর কিছু বন্ধু বান্ধব নিয়ে তাস খেলা। বাইরে এ জীবন ছিল তাঁর কল্পনাতীত। কিন্তু এ সময় তাঁর বৃদ্ধ মা- বাবা, সন্তানদের কেমন করে দিন কেটেছে এ নিয়ে নেতার খুব বেশি দুশ্চিন্তা ছিল বলে মনে হয় না। তিনি ব্যস্ত থাকতেন তার সংগঠন ও তার পরিচালনার কাজে যার অনেকটা পরবর্তীতে ফজিলাতুন্নেছাই করেছেন।”

মুক্তিযুদ্ধে নারী শব্দসৈনিক

মুক্তিযুদ্ধে শব্দ সৈনিকদের অনুপ্রেরণা আজও যেন জেগে উঠে মুক্তিযোদ্ধাদের হৃদয়ে। জাতীয় জাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্যালারিতে মোট ৮৮ জন শব্দ সৈনিকদের মধ্যে ১১ জন নারী শব্দ সৈনিক রয়েছে। তাদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো কল্যাণী ঘোষ, মালা খান, শাহিন সামাদ, বুলবুল মহালানবীশ, রূপা ফরহাদ, নাছরীন আহমেদ, নমিতা ঘোষ, মঞ্জুলা দাশ গুপ্ত, শিলা ভদ্র, উমা খান। মুক্তিযোদ্ধকে কেন্দ্র করে প্রায় ৬০ টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচিত্র নির্মিত হয়। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছে তার কেন্দ্রীয় চরিত্র রয়েছে নারী। যেমন: সেলিনা হোসেনের “হাঙ্গর নদী গ্রেনেড”, খান আতাউর রহমান এর ‘জীবন থেকে নেয়া’ হুমায়ূন আহমেদের ‘আগুণের পরশ মণি’, নাসির উদ্দিন ইউসুফ এর ‘গেরিলা’। যদিও ১৯৭১- ৯০ পর্যন্ত এদেশের পত্র পত্রিকা সিনেমা নাটকে মেয়েদের হয়ে ধর্ষিতা, নির্যাতিতা অথবা ছেলে, স্বামী বা প্রেমিকের জনন্য প্রতীক্ষারতা নারী চরিত্র হিসেবেই শুধু আঁকা হয়েছিল। তবে নব্বই এর পরে এর ভিন্নরূপ চোখে পড়ে।

সূত্র : বাংলার নারী সংগ্রামের ইতিহাস অদিতি ফাল্গুনী।

জাতি যখন সংকটের মোকাবেলা করে, নারী তখন দুর্ভোগের স্বীকার হয় সবচেয়ে বেশি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় নারী সমাজেরও পোহাতে হয়েছে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। এই সংকটের ভিতর দিয়ে যে স্বাধীনতা এসেছে সে স্বাধীনতায় ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি,সামাজিক সাম্যের এবং যুদ্ধপরাধীদের বিচারের প্রতিশ্রুতি। সেই প্রতিশ্রুতির পূর্ণতা পেয়েছিল আমাদের সংবিধানের চার মৌলনীতি এবং যুদ্ধপরাধীদের বিচারের জন্য দুটি আইন পাশের মাধ্যমে। এছাড়া সংবিধানে ৪৭/৩ ধারায় মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ এবং আর্ন্তজাতিক আইনের অন্যান্য অপরাধের জন্য অপরাধীকে শাস্তির বিধান সম্পর্কে নিশ্চিত করা হয়েছে। যুদ্ধপরাধীদের জন্য যে দুইটি আইন পাশ করা হয় তা হল: একটি পাক বাহিনীকে যুদ্ধাপরাধী সংগঠনে সহযোগিতা দানকারী দালালদের বিচারের জন্য “১৯৭২ সালের দালাল আইন” এবং অপরটি ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইবুনাল এ্যাক্ট ১৯৭৩”।

১৯৭৩ সালের আইনটিতে ‘অপরাধ’ শব্দটির ব্যাখ্যায় জেনেভা কনভেনশন ও অন্যান্য আর্ন্তজাতিক দলিল অনুসরণ করা হয়েছিল। যদিও এ অনুসারে আজও ট্রাইবুনাল গঠন করা হয়নি। তবে আইনটি এখনও কার্যকর রয়েছে।

১৯৭২ সালের পাকিস্তানি দালালদের বিচারের দাবী জানিয়ে মহিলাদের মিছিল ও বিক্ষোভের প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু নেতেৃত্বে দালাল আইন প্রণীত হয় এবং অনেক দালালের বিচার শুরু হয়। এর আওতায় দায়ের করা অসংখ্য মামলা ১৯৭২ সালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আইনটি বাতিল করার মাধ্যমে অকার্যকর হয়ে যায়। তাছাড়া যুদ্ধের পর পর যুদ্ধবন্দিদের দ্রুত পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো এবং সাধারণ ক্ষমার আওতায় দেশীয় দালালের অর্ন্তভূক্তি পুরো বিষয়টাকে দুর্বলতর করে দেয়। যদিও গুরুতর ও সুনির্দিষ্ট অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সাধারণ ক্ষমার আওতা বহির্ভূত রাখা হয়েছিল। কিন্তু তা এক ধরণের ধোঁয়াশার মধ্যে নিপতিত হয়।

‘আর্ন্তজাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)’ এর ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের আগ্রহ এবং ১৯৯৮ সালে রোম সংবিধিতে স্বাক্ষর প্রদান, পাশাপাশি অনুসমর্থন করার প্রক্রিয়া চলার সূত্রে এসব বিষয়ে ২০০০ সাল থেকে মনোযোগ দেওয়া হতে থাকে। ফলে গণহত্যা ও নারী ধর্ষণ যুদ্ধ কালীন অপরাধের বিষয় হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচার করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ ২০১০ সালের ২৩ মার্চ আর্ন্তজাতিক অপরাধ আদালতের রোম সংবিধিতে অনুসমর্থন করেছে। শুরু হয়েছে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ।

আশাকরি ‘বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ’ নারীর ভূমিকা ও অবদান বিষয়ে রাষ্ট্রিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বীকৃতি আদায়ের যে সংগ্রাম ১৯৭২ সাল থেকে আজ অব্দি করে যাচ্ছে তার সুফল একদিন আসবে।

Share this post

scroll to top