মাহফুজ উল্লাহ ছিলেন বিভক্ত সমাজের দিকনির্দেশক

সবাই যখন বিভিন্ন দলে বিভক্ত আমরা সাংবাদিকরাও বিভক্ত। এই বিভক্ত সমাজে মাহফুজ উল্লাহ ছিলেন একজন দিকনির্দেশক। বুধবার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবের মিলনায়তনে আয়োজিত সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহ স্মরণে দোয়া মাহফিলে বক্তারা এসব কথা বলেছেন। মাহফুজ উল্লাহর পরিবার এই মাহফিলের আয়োজন করে।

দোয়া মাহফিলে ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলে থাকতাম। তার অনেক স্মৃতি আছে। তার রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। মাহফুজ উল্লাহর স্মৃতির প্রতি অগাধ ভালোবাসা। তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করছি।

প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলে, আজকের আয়োজনটি ছিল দোয়া মাহফিল। কিন্তু আজ এটি একটি নাগরিক শোক সভায় রূপান্তরিত হয়েছে। এখানে জাতীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত আছে, সাংবাদিক নেতারা উপস্থিত আছেন। তিনি সারা জীবন তার নীতি আদর্শের জন্য সংগ্রাম করেছেন কিন্তু আত্মসমর্পণ করেননি। গত কিছুদিন হঠাৎ করে রোগাক্রান্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করেছেন। আসুন আমরা ভালোবেসে তার রুহের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করি।

জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, মাহফুজ উল্লাহ ভাই আমাদের ক্লাবের সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি সব ভালো-মন্দের সাথে ছিলেন। আমরা তার পরামর্শ নিতাম। মাহফুজ উল্লাহ এমন একজন মানুষ ছিলেন সবার সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। আর সবসময় তিনি হাসিমুখে কথা বলতেন। যেকোনো বিষয়ে যদি তার সমালোচনাও করা হতো তিনি তা সহজে গ্রহণ করতেন এবং যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করতেন।
আমরা এমন একজন মানুষকে হারিয়েছি যিনি একাধারে সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, কূটনৈতিকসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ভাবতেন। তার কাজগুলোর যথাযথ মূল্যায়নের মাধ্যমে আমরা তাকে সম্মান করতে পারবো।

জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ও দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক মোহাম্মদ সাইফুল আলম একজন মার্কিন ঔপন্যাসিকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, সৃষ্টিকর্তা যাকে পছন্দ করেন তাকেই ডেকে নেন। মানুষ সে জন্যই মারা যায়। এই অর্থে তিনি র্কীতিমান পুরুষ। মাহফুজ ভাইয়ের মৃত্যুতে একথা আমার বারবার মনে হচ্ছে, মাহফুজ উল্লাহ ভাই চলে গেছেন। গণতান্ত্রিক চিন্তা, অসাম্প্রদায়িক চিন্তার কারণে তিনি অনন্য অবস্থানে ছিলেন। আমরা তার জন্য দোয়া করবো।

দৈনিক মানবজমিনের সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, একজন মাহফুজ উল্লাহ মৃত্যু নেই। কারণ তিনি অনেক কিছুই রেখে গেছেন। তিনি কাউকেই আঘাত করে কথা বলতেন না। প্রথম যখন টকশো চালু হয়, আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তাকে অতিথি করার। তিনি ছিলেন উদার হৃদয়ের মানুষ। তার মৃত্যুতে আমরা লক্ষ করেছি দলমত নির্বিশেষে সবাই শোকাহত করেছে। সবাই যখন বিভক্ত আমরা সাংবাদিকরাও বিভক্ত। এই বিভক্ত সমাজে মাহফুজ উল্লাহ ছিলেন একজন দিকনির্দেশক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. এম শমশের আলী বলেন, আমি মাহফুজ উল্লাহ সরাসরি শিক্ষক ছিলাম। একটা জিনিস লক্ষ করতাম সে আন্দোলনে জড়িত থাকলেও ক্লাসে সে নিয়মিত আসত। একপর্যায়ে তার সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে। সে আমাকে বলেছিল রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প তো অনেক হয়েছে আমি একটা আপনার ইন্টাভিউ নব। সে অনেক কঠিন প্রশ্ন করলো। আমিও উত্তর দিলাম। কিছুদিন পর এসে সে বলল, স্যার নীলিমা ইব্রাহিম আপনার আর্টিকেলটি পড়েছেন। বললেন তুমি যেমন প্রশ্ন করেছ, তিনিও সে রকম উত্তর দিয়েছেন। অনেক স্থানে তার সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে। আজকের আয়োজন দেখলে বোঝা যায়, যারা দেশকে ভালোবাসেন, দশকে ভালোবাসেন তারাই আসছেন। মাহফূজউল্লাহ আমাদের জন্য উদাহরণ। আমি তার মাগফিরাত কামনা করছি। তার সন্তান পরিবার তার আদর্শে গড়ে উঠুক।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, মাহফুজ উল্লাহ আমার কাছে আমার ছোট ভাইয়ের মতো। তাকে তো আমরা সবাই দেখেছি। সম্প্রতি দুটি ঘটনার উল্লেখ করে বলতে চাই, যখন ঐক্যফ্রন্ট হয় তার ইশতেহার মাহফুজ উল্লাহ লিখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আপনি চান না সত্য প্রকাশ হোক। উসমানী সম্পর্কে যে যার মতো লিখছে। তিনি কর্ণেল উসমানী সম্পর্কে একটা বই লিখতে চেয়ে ছিলেন। আমাকে একটা দীর্ঘ ইন্টারভিউ দেয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু বসবো বসবো বলে আর বসা হলো না।  যদি বসে যেতাম তবে ভালো একটি জিনিস পেতাম। এখন দুঃখবোধ করছি।

মাহফুজউল্লাহর ভাই অধ্যাপক ড. মাহবুবউল্লাহ বলেন, আজ পহেলা মে আমার মায়েরও মৃত্যুবার্ষিকী। আপনারা মাহফুজ উল্লাহ জন্য যেমন দোয়া করবেন আমার মায়ের জন্যও দোয়া করবেন। একই সময় তিনি ছোট ভাইকে স্বরণ করে একটি শোকগাঁথা কবিতাও পড়ে শোনান।

মাহফুজউল্লাহর স্মৃতিচারণ করে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন তার কন্যা ডাক্তার নুসরাত হুমায়রা, ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী, সাবেক রাষ্ট্রদূত আনোয়ার হোসেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডক্টর মুস্তাহিদুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ড. আসিফ নজরুল, ঢাকা বাংলা চ্যানেল (ডিবিসির) প্রধান নিবার্হী কর্মকর্তা মঞ্জুরুল ইসলাম, দৈনিক ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত প্রমুখ।

দোয়া মাহফিলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস-চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল অবসরপ্রাপ্ত রুহুল আলম চৌধুরী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, অধ্যাপক ডাক্তার এ জেড এম জাহিদ হোসেন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিব, শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক ডক্টর ওবায়দুল ইসলাম, সহ-প্রচার সম্পাদক কৃষিবিদ শামীমুর রহমান শামীম, নির্বাহী কমিটির সদস্য আবু নাসের মোহাম্মদ রহমতউল্লাহ, জহির উদ্দিন স্বপন, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার লুৎফর রহমান, কল্যাণ পার্টির সাহিদুর রহমান তামান্না প্রমুখ অংশ নেন।

দোয়া মাহফিলে মোনাজাত পরিচালনা করেন ড. এম শমশের আলী।

৬৯ বছর বয়সী মাহফুজউল্লাহ গত ২ এপ্রিল হৃদরোগে আক্রান্ত হলে তাকে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করে আইসিইউতে রাখা হয়েছিল। এরপর স্কয়ারে কয়েক দিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য ১১ এপ্রিল এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ব্যাংককে নিয়ে বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি হৃদরোগ, কিডনি ও উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। এর আগে ব্যাংককে একবার তার বাইপাস সার্জারিও হয়েছিল। তিনি ২৭ এপ্রিল বাংলাদেশ সময় ১০টা ৫ মিনিটে ব্যাংককে ইন্তেকাল করেন।

সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহ ১৯৫০ সালে নোয়াখালী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত ‘লাঙল’ এবং ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার প্রকাশক কমরেড মুজাফফর আহমদ ছিলেন তার নানা।

মাহফুজউল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যা ও সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী হিসেবে ঊনসত্তরের ১১ দফা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। পরে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ছাত্র রাজনীতির কারণে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে তাকে ঢাকা কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়।

তিনি ছাত্রাবস্থাতেই সাংবাদিকতা পেশার সাথে জড়িয়ে পড়েন। বাংলাদেশের একসময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় সাপ্তাহিক বিচিত্রার ১৯৭২ সালে জন্মলগ্ন থেকেই তিনি এ পত্রিকার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। মাঝে চীন গণপ্রজাতন্ত্রে বিশেষজ্ঞ হিসেবে, কোলকাতাস্থ বাংলাদেশ উপদূতাবাসে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ এবং সাংবাদিকতা বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। রেডিও ও টেলিভিশনে অনুষ্ঠান উপস্থাপনাও করেছেন তিনি। সর্বশেষ ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগে তিনি শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন।

মাহফুজউল্লাহ আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত একজন সক্রিয় পরিবেশবিদ। তার হাত ধরেই বাংলাদেশে পরিবেশ সাংবাদিকতা শুরু হয়।

লেখক হিসেবেও মাহফুজউল্লাহ প্রসংশিত ছিলেন। তার লেখা ৫০-এর অধিক বই পৃথিবীর বিভিন্ন নেতৃস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে সংগৃহিত আছে। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে- ‘প্রেসিডেন্ট জিয়া অব বাংলাদেশ: আ পলিটিক্যাল বায়োগ্রাফি’, ‘যাদুর লাউ’, ‘যে কথা বলতে চাই’, ‘অভ্যুত্থানের ঊনসত্তর’, ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন: গৌরবের দিনলিপি (১৯৫২-৭১)’, ‘উলফা অ্যান্ড দ্য ইনসারজেন্সি ইন আসাম’, ‘স্বাধীনতার প্রথম দশকে বাংলাদেশ’। গত বছরের শেষ দিকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে লিখেন- ‘বেগম খালেদা জিয়া: হার লাইফ হার স্টোরি’।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top