মহাপ্রলয়ের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে?

[কেয়ামত বা মহাপ্রলয় কি অতি সন্নিকটে? কেয়ামতের আগে পৃথিবীতে যে সব লক্ষণ দেখা দেবে বলে রাসূল সা:-এর হাদিসে বলা হয়েছে সেসব কি এখন দেখা যাচ্ছে? এসব নিয়ে কথা বলেছেন সমসাময়িক বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ইসলামী স্কলার মুফতি ইসমাইল মেন্ক। আফ্রিকার দেশ জিম্বাবুয়ে থেকে ইউটিউবে মুফতি মেনক তার বক্তব্য তুলে ধরেছেন। তার ইংরেজি বক্তব্য থেকে অনুলিখন করেছেন শেখ নুরুল ইসলাম রানা।]

‘যখন কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে বা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে অনুপযুক্ত লোককে বসানো হবে, তখন তোমরা অপেক্ষা করো কেয়ামত অতি সন্নিকটে।’ এ কথাটির দু’টি অর্থ হতে পারে। আপনার একটি প্রতিষ্ঠান আছে, আপনার দেশ আছে, আপনি মসজিদের সাথে যুক্ত আছেন অথবা আপনি কোনো স্কুলের সাথে যুক্ত আছেনÑ তখন দেখবেন ওই সব স্থানে বসে আছে অনুপযুক্ত লোক। বড় বড় প্রতিষ্ঠানে বড় চেয়ারটি দখল করে আছে তারা, যারা ওই পদের যোগ্য নয়। এভাবে ওই অযোগ্য লোকের মাধ্যমে পুরো প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হবে। এটাই কেয়ামতের আলামত।

আপনি দেখবেন, কোনো মসজিদের চেয়ারম্যান, যিনি নিজে কখনো ইসলামের বিধিবিধানের পরোয়া করেন না অথবা আপনি দেখবেন কোনো স্কুলের সভাপতি, যার ক্লাস টু বা থ্রি পর্যন্তও বিদ্যা নেই। অথবা কোনো ফুটবল ক্লাবের ডাইরেক্টর, যিনি জীবনে কোনোদিনই ফুটবলে লাথিও মারেননি। কেয়ামতের লক্ষণ এর চেয়ে সহজ উদাহরণ আর কী হতে পারে।

যখন আপনি কোনো পদে বসবেন, আপনি যার উপযুক্ত নন- নিশ্চয়ই মনে রাখবেন তা ধ্বংস হবে। তাই যখন আপনি কোনো পদে বসবেন এবং দেখবেন, ওই পদে আপনি অনুপযুক্ত, তখন ছেড়ে দিন ওই পদ। উপযুুক্ত লোককে সেখানে বসান। আর দ্বিতীয় অর্থটি হলো এরকম যে, যখন দেখবেন আপনিই ওই পদে উপযুক্ত, তখন মূর্খরা আপনার সেই চেয়ার ছিনিয়ে নেবে। আপনাকে সেই পদে বসে থাকতে দেবে না। ছিনিয়ে নেবে আপনার চেয়ার। এটাও কেয়ামতের আলামত।

কেয়ামতের আরো আলামত আমরা দেখতে পাচ্ছি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে লক্ষ করলে দেখবেন, যিনি দেশ চালাচ্ছেন, তিনি দেশ চালাতে কতটা যোগ্য। আপনি তাকে একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন, যার উত্তর তিনি জানেন না। আজকের দিনে দেখেন, গণতন্ত্রের নাম করে মূর্খ লোকদের ক্ষমতায় বসানো হচ্ছে। কেননা তিনি জনপ্রিয়। অথচ তিনি জানেন না ইরাক কোথায়। অথচ তিনি পৃথিবীর শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রধান। এটাই ঘটছে। আর দেখেন ওই অযোগ্য লোকদের মাধ্যমে কত ধ্বংসযজ্ঞ চলছে। কারণটি হলো, তিনি জানেন না আসলে তার কী করা উচিত। তবে, জনপ্রিয় হতে কী কী করতে হয়Ñ এটা তিনি ভালো করেই জানেন। আর সেটাই তিনি করেন। তার কাজটি ঠিক হলো, কী ভুল হলো তা তিনি ভাবেন না।
রাসূল সা:-এর একটি শক্তিশালী হাদিস উল্লেখ করা যেতে পারে এখানে। তিনি আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন, কিভাবে জ্ঞানকে ছিনিয়ে নেয়া হবে এবং কিভাবে পৃথিবীতে মূর্খতা বৃদ্ধি পাবে। রাসূল সা: বলেন, ‘আল্লাহ জ্ঞানকে ছিনিয়ে নিবেন, এটা কেয়ামতের আলামত। জ্ঞান চলে যাবে আর জ্ঞানীদের মনে করা হবে মূর্খ। আর মূর্খকে মনে করা হবে জ্ঞানী।’

পৃথিবীতে যখন এ ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হবে তখন আল্লাহ জ্ঞানীদের মৃত্যুর মাধ্যমে তুলে নিবেন। তাই বর্তমানে আমরা দেখছি, একজন সক্রিয় আলেমের মৃত্যু হয়ে শূন্যতা সৃষ্টি হচ্ছে। সেই শূন্যতা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। তিনি দ্বীনি কাজ যে কঠিনভাবে করতেন, তার মৃত্যুর পর সবাই মিলেও ওই আলেমের শূন্যতা পূরণ করতে পারছেন না। দ্বীনের খেদমতকারী একজন ভালো আলেম যখন মারা যান, সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে দরকার পড়ে দশজন আলেমের এবং তারা সবাই মিলেও ওই বিজ্ঞ আলেমের সমতুল্য হতে পারেন না। আবার ওই দশজনের মধ্য থেকে একজন মারা গেলে তার শূন্যস্থান পূরণ করতে আরো নতুন দশজন আলেমের দরকার হয়। আবার সেই দশজনের একজন মারা গেলে, তার শূন্যস্থান পূরণ করতে আরো নতুন করে দশজনের দরকার হয়, যারা মিলেও ওই আগের একজনের সমপরিমাণ কাজের যোগ্য হয়ে উঠেন না। এই উদাহরণ থেকেই বরকতটা বুঝে নেয়া যায়।

আপনি যে এলাকায় আছেন, সেখানে হয়তো আছেন কোনো বিখ্যাত আলেম। তিনি যদি মারা যান, তার কাজ করতে বহু সংখ্যক আলেমের প্রয়োজন পড়বে। আপনি একজন লোক পাবেন না, যিনি একাই ওই আলেমের সমতুল্য কাজ করতে পারবেন, যদি না আল্লাহ এটার তৌফিক দান করেন। আসলে এখানে একটা শূন্যতা থেকেই যায়। এর একটি সুন্দর উদাহরণ হলো, রাসূল সা: নিজে। তার আছে লাখের ওপর সুন্নাহ। তিনি নিজেই সব সুন্নাহ পালন করে গেছেন। এর পর কী হয়েছে, সাহাবাদের সবাই মিলে তার সব সুন্নাহ মানার চেষ্টা করেছেন। এর পর অনেক সময় চলে গেছে। এখন ১০ কি ১৫টি সুন্নাহ পালন করতেই কষ্ট হয় আমাদের। অথচ লাখের ওপর সুন্নাহ রয়েছে, যা কি না রাসূল সা: একাই অনুশীলন করেছেন। আমরা নবী নই, আমরা রাসূলও নই। আর আমরা এসেছি ১৪০০ বছর পর। আল্লাহ আমাদের বরকত দান করুন।

এক হাদিসে এসেছে, কেয়ামতের আলামতের আরেকটি উদাহরণ হলো সময় সঙ্কুুচিত হয়ে যাবে। আপনারা কি জানেন, সময় সঙ্কুুচিত হওয়ার অর্থ কী? অনেক বছর আগে যখন আমি ছোট ছিলাম, দিন শুরু হতো অনেক আগে। আর দুপুরের আগে আমরা অনেক কাজ শেষ করে ফেলতাম। আর দিন শেষ করতাম অনেক অনেক কাজ করার মধ্য দিয়ে। আজ আমাদের সপ্তাহ পার হয়ে যায়, অথচ অর্জন করতে পারি না, যা আমরা আগে একদিনে অর্জন করতে পারতাম। এর কারণ হচ্ছে, সময়ের কোনো বরকত নেই, কোনো রহমত নেই। সময় সঙ্কুচিত হওয়ার আরেকটি মানে হলো, বছর পার হবে একটি মাসের মতো। মাস পার হবে একটি সপ্তাহের মতো, সপ্তাহ পার হবে একটি দিনের মতো, দিন পার হবে একটি ঘণ্টার মতো, ঘণ্টা পার হবে একটি মিনিটের মতো আর মিনিট পার হবে একটি সেকেন্ডের মতো। এটাই হলো সময়ের সঙ্কোচন। রাসূল সা: যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, আমরা তার মধ্যে দিয়েই পার হচ্ছি। প্রত্যেক রমজান পার হচ্ছে আগের রমজানের চেয়ে দ্রুত গতিতে। রমজানের চাঁদ দেখতে দেখতেই ঈদের চাঁদ উঠে যায়। এটাও কেয়ামতের আলামত।

কেয়ামতের আরেকটি আলামত হলো, লোকেরা বেশি বেশি তর্কবিতর্কে জড়িয়ে পড়বে শুধু চাঁদ দেখা নিয়ে। চাঁদ খুব বড় হয়ে উঠেছে। এই নিয়ে লোকেরা বিভক্ত হয়ে পড়বে। লোকেরা তর্কবিতর্ক করবে এই বলে যে, এটা প্রথম দিনের চাঁদ নাকি দ্বিতীয় দিনের চাঁদ। এই চাঁদের কারণে লোকেরা বিভক্ত হয়ে পড়বে। এই বিভক্তি শুধু বাহ্যিক কারণেই কিন্তু না, অন্তরেও তারা বিভক্ত হয়ে যাবে। অথচ একই দিনে ঈদ পালন করলেই কি ঐক্য হয়ে যায়? ঐক্য হবে তখনই, যখন প্রত্যেকে মনে করবে যে, আমার নিজের চেয়ে অন্যের প্রয়োজনটা বেশি। তাদের প্রয়োজনে পাশে দাঁড়ানো আমার কর্তব্য। যখন আপনি এটা বিশ্বাস করবেন, তখন এক সেকেন্ডের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি হয়ে যাবে। আমাদের সমস্যা হলো আমরা শুধু নিজেদের নিয়েই ভাবি। এটাও কেয়ামতের একটা লক্ষণ। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, লোকেরা যাদেরকে চিনে তাদেরকেই শুধু সালাম দিবে। আজকের দিনে আমরা কুশল বিনিময় করি না। আমরা সালাম দেই গাড়িকে। গাড়িটি খুব সুন্দর। অথচ ভেতরে যিনি বসা আছেন, তিনি কখনো পাঁচটা টাকা হাত বাড়িয়ে কাউকে দেন না।

অধিকার বঞ্চিতদের সাথে আপনি কিছু সময় দেন। তাদের সাথে হাসি মুখে কথা বলুন। এমন কোনো কথা বলবেন না, যা শুনে তারা কষ্ট পায়। ‘ভাই, আপনি কেমন আছেন, আপনার খবর কী? মাশাআল্লাহ। আলহামদুলিল্লাহ’- এভাবে কথা বলাবলি আজকাল কয়জনে করে? আজকের দিনে আরেকটি সমস্যা হলো আমরা বিরক্ত করি তাকে যার সম্পর্কে আমরা জানি। পরিচিত পেলেই হাত পেতে টাকা ধার চাই। আর টাকা পাওয়ার আশায় তাকে সালাম দেই। স্বার্থ ছাড়া কেউ কাউকে সালাম দেয় না। বলে- আমি তাকে সালাম দিলে সে আমার কাছে সুবিধা চেয়ে বসে। কেউ আমার দোকানে ঢুকলে আমি অন্য পথে পালিয়ে যাই। কারণ, আমি জানি, ওই লোক আমার কাছে ডিস্কাউন্ট চাইবে। তাই কখনো আপনি বিনা কারণে ডিসকাউন্ট চাইবেন না। কখনো বিনা কারণে অন্যকে নিজের বোঝা মনে করবেন না। আর যখন আপনি তার দোকানে যাবেন, আপনি পুরোপুরি মূল্য পরিশোধ করবেন। আর সে যখন আপনার দোকানে আসবে, সেও পুরোপুরি মূল্য দিয়ে পণ্য নিয়ে যাবে।

একে অন্যকে ভালোবাসুন। দুই টাকা পাঁচ টাকা ডিসকাউন্টের জন্য একে অন্যের সালাম বিনিময় বন্ধ করবেন না। পারিবারিক সমস্যা নিয়েও অনেক সময় আপনি আপনার ভাইয়ের সাথে বোনের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেন। কেন? এটাও কেয়ামতের আলামত। আমরা এখন কেয়ামতের জীবন্ত আলামত হয়ে গেছি। আপনি নিজে যদি বহু বছর যাবৎ পরিবারের লোকদের সাথে কথা বলা বন্ধ রাখেন, তাহলে আপনিই কেয়ামতের নিদর্শন। পরিবারের সাথে ভালো ব্যবহার করুন। সমস্যা থাকলে মিটিয়ে ফেলার উদ্যোগ নিন। আপনি ধনী লোককে সালাম দিন। কিন্তু গরিব বা অধিকার বঞ্চিতদের সালাম দেন না। এটাও কেয়ামতের আলামত। কুশল বিনিময় করুন সময় নিয়ে, যদিও সে শিশু হয়। রাসূল সা:-এর একটি সুন্নাহ হলো, তিনি একটু বেশি সময় কাটাতেন শিশুদের সাথে। পরে দেখা গেছে, সেই সব শিশু পৃথিবীর সেরা হয়েছিল। তাদের মনে পাহাড় সমান আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছিল। আপনি যখন নিজে বড় হয়েও ছোটদের সালাম দিবেন, তাকে অভিনন্দন জানাবেন, তখন শিশুর আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাবে। অথচ আজকের দিনে আমরা অন্যের শিশুকে বাঁকা চোখে দেখি। তাদের হেয় করার চেষ্টা করি। সে কারণে অন্যরাও আমার সন্তানকে হেয় চোখে দেখে। এ কারণেই আজকের দিনের নেতাদের দেখেন, তারা হীনম্মন্যতায় ভোগেন এবং একে অন্যের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। কেয়ামতের আলামত এটাও।

রাসূল সা: বলেছেন, লোকেরা মসজিদে সালাত আদায় করবে; কিন্তু একজন লোকও সালাতে মনোনিবেশ করতে পারবে না। কেয়ামতের আগে একনিষ্ঠ হয়ে সালাত আদায়ের যোগ্যতা তুলে নেয়া হবে। লোকদের মাথা ভরা থাকবে অপ্রয়োজনীয় জিনিসে। টেলিফোনের আলাপে, কম্পিউটার গেম, অপ্রয়োজনীয় খোশগল্পে ভরা থাকবে সবার মাথা। পাপ আমাদের পুরো সালাতের মাধুর্য নষ্ট করে দিবে। এটা কেয়ামতের আলামত।

রাসূল সা: বলেছেন, শিগগিরই অন্যান্য জাতি মিলে তোমাদের এমনভাবে ঘিরে ধরবে যেন একদল নেকড়ে একখণ্ড মাংসপিণ্ডের চার দিকে অবস্থান করছে। অর্থাৎ অন্য জাতি আসবে এবং মুসলমানদের আক্রমণ করবে। আজ আমরা এটাই দেখতে পাচ্ছি। কিছু দেশ আছে যেখানে মুসলমানদের প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। শুধু মুসলমান নাম ও মুসলিম পরিচয়ের কারণে। রাসূল সা:-এর একটি হাদিস আছে যেখানে বর্ণনা করা হয়েছে, ‘এমন দিন আসবে যখন একখণ্ড আগুন হাতের মুঠোয় ধরে রাখার মতোই কঠিন হয়ে পড়বে ঈমান ধরে রাখা।’ আজ আপনি হিজাব পরে নিজের বাড়িতে ঢুকুন। আপনার পিতা বলবেন, মা এখনো তুমি অনেক ছোট, তোমার হিজাব পরার দরকার নেই। আপনার ওই পিতাই হলো কেয়ামতের আলামত।

আজ ঈমান ধরে রাখা বড় কঠিন। আপনি দাঁড়ি রাখছেন, আপনার স্ত্রী আপনাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। হিজাব পরছেন, নিজের লোকেরাই আপনাকে বাঁকা চোখে দেখবে। আজ যদি আপনি কোনো পার্টিতে যেতে না চান তা হলে আপনার আত্মীয়রাই বলবেন, মানুষটা বড় সেকেলে, বড় কট্টরপন্থী হয়ে যাচ্ছে। এটাই হলো কেয়ামতের আলামত। কেয়ামতের যেসব আলামত আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি, সেসব আলামত চিনুন এবং বুঝে চলার চেষ্টা করুন যেন আলামতগুলো আমাদের সমাজে ফুটে না উঠে। আল্লাহর সন্তুষ্টিকেই প্রাধান্য দেয়ার চেষ্টা করুন।

Share this post

scroll to top