ময়মনসিংহ-ঢাকা মহাসড়কের চার লেন নির্মাণে পরিকল্পনাগত ত্রুটি ছিল : বাড়ছে দুর্ঘটনা

Mymensingh-Dhaka-Roadময়মনসিংহ-ঢাকা মহাসড়ক চার লেন নির্মাণ প্রকল্প ২০১০ সালের জুনে গ্রহণ করা হলে এক হাজার ৮১৫ কোটি টাকার এই মেগা প্রকল্পটি শেষ হয় ২০১৭ সালের জুনে। তবে ৮৭ কিলোমিটার এ মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা হলেও রয়েছে পরিকল্পনাগত ত্রুটি। ফলে এ মহাসড়কে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। এছাড়া মহাসড়কটিতে দ্রুতগামী যানবাহন কাক্সিক্ষত গতিতে চলাচল করতে পারে না।

ছয় লেনের এক্সপ্রেসওয়েতে উন্নীত করা হবে মহাসড়কটি
প্রাথমিকভাবে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৩৫৩ কোটি টাকা
জিটুজি-পিপিপি পদ্ধতিতে নির্মাণে আগ্রহী কোরিয়া, টোল আদায় করা হবে ২২ বছর

এর পরিপ্রেক্ষিতে মাত্র চার বছরের মাথায় মহাসড়কটিকে আরও প্রশস্ত করে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে আগ্রহ প্রকাশ করেছে দক্ষিণ কোরিয়ার ‘কোরিয়া ওভারসিস ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড আরবান ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন’ তথা কাইন্ড। দেশটির সঙ্গে জিটুজি-পিপিপি (সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব) পদ্ধতিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কোরিয়ান কর্তৃপক্ষ কাইন্ড এরই মধ্যে বাংলাদেশের পিপিপি কর্তৃপক্ষকে আগ্রহের বিষয়টি অবহিত করেছে।

সূত্রমতে, পিপিপিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য শিগগিরই একটি প্রস্তাব পাঠানো হবে অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে (সিসিইএ)। এরই মধ্যে প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করা হয়েছে। এছাড়া এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে। মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদনের পর এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে বিস্তারিত কার্যক্রম শুরু করবে কোরিয়ান কর্তৃপক্ষ কাইন্ড।

সিসিইএ’র প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ময়মনসিংহ-ঢাকা (জয়দেবপুর) সড়কটি জাতীয় মহাসড়ক এন-৩-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ মহাসড়কের মাধ্যমে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দেশের ছয়টি জেলার (গাজীপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, জামালপুর, শেরপুর ও কিশোরগঞ্জ) সড়কপথে যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এ মহাসড়কে যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী যানবাহনের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া সরকার কর্তৃক গৃহীত পরিকল্পনা অনুসারে উল্লিখিত ছয়টি জেলায় ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে এ করিডোরে যানবাহনের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পাবে।

এতে আরও বলা হয়েছে, ময়মনসিংহ-ঢাকা (জয়দেবপুর) মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ২০১৬ সালে ৮৭ কিলোমিটার এ মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত করারর কাজ শেষ হয়। কিন্তু এ মহাসড়কে দ্রুতগামী যানবাহনের পাশাপাশি অযান্ত্রিক ও ধীরগতির যানবাহনের চলাচলের কারণে মহাসড়কে প্রায়ই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে এবং দ্রুতগামী যানবাহন কাক্সিক্ষত গতিতে চলাচল করতে পারে না। এছাড়া মহাসড়কটি প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত (এক্সেস কন্ট্রোলড) না হওয়ায় এর পাশে গড়ে ওঠা হাটবাজার ও পার্শ্ববর্তী সড়কগুলোর যানবাহনের কারণে মূল মহাসড়কের যানবাহনের নির্বিঘ্নে চলাচল প্রায়ই ব্যাহত হয়।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের জয়দেবপুর থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত ৮৭ কিলোমিটার সম্পূর্ণ প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত এক্সপ্রেসওয়ে হিসাবে উন্নীত করার প্রস্তাব করেছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। এক্ষেত্রে চার লেনের উভয় পাশে দুটি ইমারজেন্সি লেন ও মহাসড়কের উভয় পাশে স্থানীয় যানবাহনের চলাচলের জন্য দুটি সার্ভিস লেন নির্মাণ করা হবে। এছাড়া ব্যস্ততম ইন্টারসেকশনে (মোড়ে) ইন্টারচেঞ্জ/ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হবে। পাশাপাশি এক্সপ্রেসওয়েটিতে আধুনিক সড়ক ব্যবস্থাপনার জন্য সার্ভিস এরিয়া, টোল প্লাজা ও ইন্টিলিজেন্ট ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম স্থাপন করা হবে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামছুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, এদেশে বিদ্যমান মহাসড়কের পাশে বাজার, শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্রভৃতি রয়েছে। আবার দ্রুতগতি ও ধীরগতির যানবাহনকে চলতে হয় পাশাপাশি। এতে কখনোই যানবাহন কাক্সিক্ষত গতিতে চলাচল করতে পারে না। তাই মহাসড়ক দুই থেকে চার লেনে উন্নীতকরণ কখনোই সমাধান নয়। যদিও ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে তা-ই করা হয়েছিল, যা ছিল ত্রুটিপূর্ণ পরিকল্পনা।

তিনি আরও বলেন, সড়কে যানবাহন চলাচল সক্ষমতা বাড়াতে টেকসই সমাধানের পথে যেতে হবে। এজন্য এক্সপ্রেসওয়ে বা এক্সেস কন্ট্রোলড সড়ক নির্মাণ করতে হবে। ভারত, চীনসহ বিভিন্ন দেশ এখন তা-ই করছে।

তথ্যমতে, ময়মনসিংহ-জয়দেবপুর মহাসড়কটির উভয় দিকে তিন মিটার প্রশস্ত দুটি ইমারজেন্সি লেনসহ ছয় লেনের এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হবে। আর এক্সপ্রেসওয়ে উন্নীত করার সময় মহাসড়কটির উভয় পাশে পাঁচ দশমিক ৫০ থেকে সাত দশমিক ৩০ মিটার প্রশস্ত সার্ভিস লেন নির্মাণ করা হবে। পাশাপাশি মহাসড়কে বিদ্যমান সেতু ও কালভার্টগুলো চাহিদা অনুসারে প্রশস্ত করা হবে। এজন্য ২০ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮০ কোটি টাকা। এছাড়া পরিষেবা সংযোগ লাইন স্থানান্তরে ব্যয় ধরা হয়েছে ১০০ কোটি টাকা।

এদিকে এক্সপেসওয়েটির মূল নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে দুই হাজার ৭৮১ কোটি টাকা। পরামর্শকসহ অন্যান্য খাত মিলিয়ে প্রাথমিকভাবে প্রকল্পটির মোট নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে তিন হাজার ৩৫৩ কোট ৩৬ লাখ টাকা। যদিও চূড়ান্ত হিসাবে এ ব্যয় বাড়তে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে নির্মাণ ব্যয় তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় প্রকল্পটিতে ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফাইন্যান্সিং (ভিজিএফ) প্রয়োজন হবে না।

এদিকে মহাসড়কে প্রবেশ করা ও বের হওয়ার জন্য সীমিত সংখ্যক গ্রেড-সেপারেটেড ইন্টারচেঞ্জ নির্মাণ করতে হবে। এসব স্থানে টোল প্রদানের মাধ্যমে যানবাহন মহাসড়ক ব্যবহার করতে পারবে। নির্মাণশেষে এ মহাসড়ক থেকে ২২ বছর টোল আদায় করবে দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ কাইন্ড। এজন্য তিনটি প্রতিষ্ঠানকে মনোনীত করেছে দেশটি। এগুলো হলো এসকে ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন, কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে করপোরেশন ও লোট্টে ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন।

এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মাণে এরই মধ্যে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করা হয়েছে। আর এর নির্মাণকাল ধরা হয়েছে তিন বছর। এক্ষেত্রে আগামী বছর শুরু হয়ে ২০২৪ সালে এ কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। আর এক্সপ্রেসওয়ে চালুর সময় মহাসড়কটিতে যান চলাচলের প্রক্ষেপণ ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ৮৬৭।

নকশা প্রণয়ন-নির্মাণ-অর্থায়ন-পরিচালনা-অর্থায়ন (ডিবিএফওটি) পদ্ধতিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে কোরিয়ান বিনিয়োগকারী। তবে প্রকল্পটির ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার কর্তৃক প্রণীত কারিগরি সম্ভাব্যতা যাচাই ও বাণিজ্যিক উপযোগিতা সম্পাদনের পর উপযুক্ত সরকারি-বেসরকারি কাঠামো প্রস্তাব করা হবে। আর সিসিইএ’র নীতিগত অনুমোদনের পর পিপিপি কর্তৃপক্ষের সহায়তায় প্রকল্পটির পরামর্শক নিয়োগ ও বিস্তারিত সম্ভাব্যতা যাচাই করা হবে।

Share this post

scroll to top