ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাসির উদ্দিন ছিলেন ময়মনসিংহবাসীর প্রাণ

Nasir-Uddin-MMCHময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে বদলে দেয়ার কারিগর সাবেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাসির উদ্দিন আহমেদের বিদায়জনিত কারণে ময়মনসিংহবাসী তাদের এক আপনজনকে হারালো। বিদায় জনিত এ খবরে সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সর্বত্র বেদনার চাপ। হাসপাতালের চেহারা বদলে দেয়া এ কারিগরের কথা ময়মনসিংহবাসী কোনোদিন ভুলবে না। কোনোদিন ভোলারও নয়। সরকারি হাসপাতালের কার্যক্রমে এমন একজন মানুষের ছোয়া ভবিষ্যতে ময়মনসিংহবাসী পাবে কিনা তানিয়েও সন্দেহ আছে।

বৃহস্পতিবার (১৬ জুলাই) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাছির উদ্দিন আহমেদ তার শেষ কার্যদিবস শেষে রাতে সহকর্মীদের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এ সময়ের একটি ভিডিও নাছির উদ্দিন আহমেদ তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজে শেয়ার করেন। যা মুহূর্তের মধ্যেই ভাইরাল হয়ে যায়। অনেকেই তার বিদায়ে নিজেদের অসহায় বলা থেকে শুরু করে ব্যতিত হচ্ছেন।

পাঠকদের জন্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাছির উদ্দিন আহমেদের ফেসবুক পোস্টটি তুলে ধরা হলো-

‘বিদায় নিচ্ছি –

আসসালামু আলাইকুম সন্মানিত ময়মনসিংহ বিভাগবাসী। আজ বৃহস্পতিবার ১৬ জুলাই আমার শেষ কর্মদিবসে আমি আপনাদের সকল সহোযোগিতা ও ভালোবাসার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে শুকরিয়া আদায় করছি। আমার ভুল ভ্রান্তির জন্য সকলের কাছেই ক্ষমা চাই।

আমি সাধারণ নাগরিক থেকে ময়মনসিংহের সকল উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা, মধ্য পর্যায়ের কর্মকর্তা, শ্রদ্ধাভাজন অধ্যাপক, ডাক্তার, ইন্টার্ন চিকিৎসক, নার্সিং অফিসার, হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ, সকল কর্মচারীবৃন্দ, সাংবাদিক বৃন্দ,সমাজ কর্মী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ,পেশাজীবী নেতৃবৃন্দসহ সকলের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভালো কিছু হয়ে থাকলে তা আপনাদের সাহায্যে হয়েছে। আজ আমার শেষ কর্মদিবসে আপনাদের দোয়া চাই। আগামী ১৮ তারিখ শনিবার নতুন পরিচালককে দায়িত্বভার বুঝিয়ে দিয়ে আল্লাহ চাইলে ১৯ জুলাই এ শহর থেকে আপাতত বিদায় নিব। আগামী ৩০ জুলাই অবসরে চলে যাব। ভাল থাকুন আপনারা।

বিনীত,
ব্রিগেডিয়ার নাসির উদ্দীন আহমেদ, পরিচালক, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল’

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক জাকিউল ইসলাম বলেন, মে মাসের ২৮ তারিখ (বুহস্পতিবার) রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রেষণ-১ অধিশাখার উপসচিব মুহম্মদ আব্দুল লতিফ স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাসির উদ্দিন আহমেদের বদলীর বিষয়টি নিশ্চিত করেন। ওই প্রজ্ঞাপনে আরও জানান হয়, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাছির উদ্দীন আহমদকে সেনাবাহিনীতে প্রত্যাবর্তন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. ফজলুল কবিরকে এ হাসপাতালের নতুন পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালের ১ নভেম্বর মো. নাছির উদ্দীন হাসপাতালের পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। এ সময় হাসপাতালের ব্যাপক উন্নয়নে নগরীর বেসরকারি হাসপাতালগুলো রোগী শূন্য হয়ে পড়লে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় মালিকরা। নাছির উদ্দিন আহমেদের বদলীর জন্য উঠে পড়ে লাগেন তারা।

এরই প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের শেষের দিকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক নাছির উদ্দিন আহমেদের বদলির আদেশ আসে। বদলির আদেশের খবরে ফুঁসে ওঠে ময়মনসিংহবাসী। বদলির আদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে ময়মনসিংহবাসী মানবন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল করে।

সাধারণ মানুষের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ১৯ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাসিরের বদলি প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে চিঠি দেন ময়মনসিংহ সদর আসনের সংসদ সদস্য ও বিরোধী দলের নেত্রী রওশন এরশাদ।

পরে আগস্ট মাসের ১৬ তারিখে (বুধবার) নতুন পরিচালকের বদলি প্রত্যাহার বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। আবারও স্বপদে বহাল থাকেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাসির উদ্দিন আহমেদ।

নাছির উদ্দিন আহমেদের সময়কালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যত উন্নয়ন

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, চিকিৎসা সেবা দিয়ে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। প্রতিদিন আউটডোর, ইনডোর ও ওয়ান স্টপ সার্ভিস মিলে গড়ে ৯ হাজার রোগীকে বিনামূল্যে শতভাগ ওষুধ, স্বল্প ফিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ চিকিৎসা সেবা দিয়ে এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করে হাসপাতালটি।

রোগীদের কল্যাণে বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম ২০১৭ সালে ১৯ নভেম্বর ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করা হয় এই হাসপাতালে। ওয়ান স্টপ সার্ভিস সারা দেশের একটি মডেল। সেবা পেয়ে রোগীরা শতভাগ সন্তুষ্ট।

বৃহত্তর ময়মনসিংহের ২ কোটি মানুষের শেষ ভরসাস্থল এই হাসপাতাল। এছাড়া গাজীপুর ও সুনামগঞ্জ জেলার মানুষও চিকিৎসা নিতে আসেন এই হাসপাতালে।

দেশের অন্যতম ৩টি হাসপাতালের মধ্যে একটি এই হাসপাতাল। পরিকল্পিতভাবে এটার পেছনে স্বতস্ফূর্তভাবে লেগে থাকার সার্বক্ষণিক তদারকি ও সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহযোগিতার ফলে এই মান অর্জন করা সম্ভব হয়েছে।

এক হাজার শয্যার হাসপাতালে গড়ে ৩ হাজারের অধিক রোগী ভর্তি থাকছে। এছাড়া হাসপাতালের আউডোরে প্রায় ৬ হাজার ও ওয়ানস্টপ সার্ভিসসহ জরুরি বিভাগে আরও প্রায় ৫০০ রোগী চিকিৎসা নিতে আসছে। এক হাজার শয্যার অনুমোদিত লোকবল দিয়ে বাড়তি এসব রোগীর চাপ সামাল দিতে প্রতিনিয়ত হিমশিম খাচ্ছেন কর্তব্যরত ডাক্তার, নার্স ও কর্মচারীরা।

তারপরও ডাক্তার, নার্স ও কর্মচারীদের আন্তরিকতার ফলে হাসপাতালের সেবাদান কার্যক্রম ও অগ্রযাত্রার জন্য দেশসেরা হাসপাতালের মর্যাদা লাভ করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আয়ও বাড়ে বহুগুণ। অনেকগুলো যুগান্তকারী পদক্ষেপের ফলে মানুষ শতভাগ সুচিকিৎসা পাচ্ছে।

যার নেতৃত্বে এত বড় সফলতা আসে তিনি হচ্ছেন হাসপাতালের বর্তমান পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাছির উদ্দিন আহমেদ। তিনি পরিচালক থাকা অবস্থায় দিনরাত শ্রম, ত্যাগ স্বীকারের ফলে হাসপাতালটি আজ এই পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে।

সর্বশেষ গত ২০১৮ সালে প্রসূতি সেবায় বিদ্যমান কার্যক্রমের জন্য পুরস্কার লাভ করে হাসপাতালটি। নামমাত্র ফিতে পরীক্ষাসহ বিনামূল্যের শতভাগ ওষুধ পেয়ে খুশি রোগীরা।

এসবের পাশাপাশি আধুনিক মানের এমআরআই ও সিটি স্ক্যান মেশিন স্থাপন, হেমোডায়ালাইসিস মেশিনে কিডনি রোগীদের সেবা, থ্যালাসেমিয়া, চক্ষু রোগীদের আধুনিক পরীক্ষার মেশিন সংযোজন এবং হৃদ রোগীদের জন্য বহুল প্রত্যাশিত ক্যাথল্যাব স্থাপন করেন তিনি। নিউরো সার্জারি ও ইউরোলজিসহ বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি সংযোজন করে রোগীদের ভোগান্তির অবসান ঘটিয়েছেন নাছির উদ্দন আহমেদ।

গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ইউজার ফি থেকে ময়মনসিংহ মেডিকেলের রাজস্ব আয় ছিল ৪ কোটি ২৯ লাখ ৩৭৩ টাকা, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে আয় হয় ৪ কোটি ৭২ লাখ ৯৪ হাজার ১৬৬ টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রাজস্ব আয় ছিল ৬ কোটি ৭ লাখ ৩৭ হাজার ৩৬৩ টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এই আয় ছিল ৮ কোটি ৩১ লাখ ১৪ হাজার ৭৯১ টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই আয় ছিল ৯ কোটি ৬০ লাখ ৯৮ হাজার ৬২৫ টাকা। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এক লাফে এই রাজস্ব আয় দাঁড়ায় ১৩ কোটি ৪ লাখ ৩৪ হাজার ৫৯২ টাকা।

Share this post

scroll to top